Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আপনাকে মশারি খাটাতেই হবে

অভিমত

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : লেখার শুরুতে চিকুনগুনিয়ায় যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সুস্থতা কামনার পাশাপাশি আল্লাহ যেন সবাইকে সুস্থ রাখেন সেই সাহায্য প্রত্যাশা করছি। চিকুনগুনিয়া নামটি শুনলেই মনের ভিতরে ভীতি চলে আসে। এ সম্পর্কে দু’ চার কথা না বললেই নয়। ১৯৫২ সালে তানজানিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম এ জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেখানকার মাকোন্ডে নৃ-গোষ্ঠির নিজস্ব ভাষা কিমাকোন্ডে অনুযায়ী এর নামকরণ করা হয়। তাদের ভাষায় চিকুনগুনিয়া অর্থ কুঁচিত হওয়া বা গিঁটের ব্যথ্যায় কুঁকড়ে যাওয়া। রোগতত্ত¡ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম এই রোগের ভাইরাসটি ধরা পড়ে। এরপর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে লক্ষ করা গেলেও তেমন প্রভাব ছিল না। তবে এই বছর ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি এক জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় প্রতি ১১ জনে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত! এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবপিকটাস প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু বহন করে থাকে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায়। বিশেষ করে ভোরে ও সন্ধ্যায় বেশি কামড়াতে পছন্দ করে। কারো রক্তে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন নেগেটিভ থাকলে চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। চিকুনগুনিয়া থেকে পলিআরথ্রাইটিস হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, বমি ভাব, অনিদ্রা, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথাসহ শরীরে র‌্যাশ ওঠে। দীর্ঘমেয়াদি জয়েন্টের ব্যথা ইনফ্লামেটরি আরথ্রাইটিসের লক্ষণ। যখন পাঁচ বা তার চেয়েও বেশি জয়েন্ট আরথ্রাইটিসে আক্রান্ত হয় তখন তাকে আথ্রাইটিস বলে। এ সময়ে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না। দুর্বলতা, মাংশপেশিতে ব্যথা, হাড়ের জোড়গুলোতে ব্যথা থাকে। ডেঙ্গু জ্বর ও চিকুনগুনিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো ডেঙ্গু জ্বরে হাড়ের জোড়গুলি ফুলে যাওয়া থাকে না। এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে একজন বা তার চেয়েও কম। তবে এ রোগে আক্রান্তদের অনেকেই বলেছেন, যার চিকুনগুনিয়া হয়নি তাকে এর কষ্টের কথা বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। চিকিৎসকদের মতে, এ রোগের তেমন কোনো ওষুধ নেই, শুধুই প্যারাসিটামল। নির্দিষ্ট কোনো প্রতিকার না থাকায় পানি দিয়ে শরীর মুছা, সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকা, শরবত জাতীয় তরল পান করা, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ইতোমধ্যে যারা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও তাঁর স্ত্রী, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, গাজীপুর সিটি মেয়র আবদুল মান্নান ও মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিশেষ ব্যক্তিরা অসুস্থ হলে পত্রিকায় নিউজ হয়। সরকারি চিকিৎসকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। একজনের জন্য দশজন চিকিৎসক হন্য হয়ে ছুটে বেড়ান। তাদের চিকিৎসা করার সামর্থ্য, ক্ষমতা ও রুজি-রোজগারের অর্থ মজুদ আছে। তারা আর্থিক কষ্ট পাবেন না হয়তো, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট নিশ্চয়ই পাচ্ছেন। কিন্তু যারা নি¤œ আয়ের মানুষ তারা শারীরিক, মানসিক কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক দিক থেকে বড়ই কষ্ট পাচ্ছে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, দিনে কাজ করলে পরিবারের রাতের খাবার ব্যবস্থা হয় তাদেরতো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিশ্রামে থাকার সুযোগ নেই। অভুক্ত থেকেই তাদের জীবন চলে যায়। কে আছে পাশে দাঁড়াবার? এসব মানুষের অবস্থা কী হবে, তা কি নগর পিতারা গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন?
রোগতত্ত¡ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর কর্মকর্তারা বলেছেন, বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত ডেঙ্গু মশা ও চিকনগুনিয়োর প্রভাব সেপ্টেস্বরের আগে কমার সম্ভাবনা নেই। তাহলে জনসাধরণের উপায় কী হবে। তারা কি মশার আক্রমণ সইতেই থাকবে। খবরে প্রকাশ, গণমাধ্যমের স্বরবে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে শুক্র ও শনিবারে ডিসিসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সে ছুটি যদি মাঠ পর্যায়ে কাজে ব্যবহার না হয় তাহলে লাভ কী! সেবার নাম করে সময়ক্ষেপণ, ফটোসেশসন, কিংবা জনগণের টাকায় পকেট ভারী হলে তাকে সফল বলা যায় না। উত্তরের মেয়র সাহেব বলেছেন ‘আপনার ঘরে গিয়ে আমি মশারি খাটাতে পারব না’। আপনি যদি মশারি খাটাতে না পারেন, তাহলে মশা মারতে এমন কর্মী নিয়োগ করুন। যারা দুই হাত দিয়ে মশা মারবে, মশক নিধনের খাতের টাকা আত্মসাৎ করেবে না, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টাকার ভাগাভাগি করবে না এবং ওষুধের বদলে শুধু পানি ছিটাবে না। সেটাও কি আপনি পারবেন না? আপনার অধস্তনদের বলেন, তারা যেন একটু মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে ঘুরে মানুষের দুর্ভোগ স্ব-চোক্ষে দেখে।
চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। নগরের সাধারণ মানুষও মন্ত্রীর সাথে একাত্বতা পোষণ করে সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের আন্তরিকতার ঘাটতির নানা কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। নগরের সেবা থেকে বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠকের মন্তব্য পড়লেই সহজে বুঝা যায়। মশার কামড়ে জনগণ অতিষ্ঠ। মশা মারার ফগার ম্যান কোন দিক দিয়ে যায় তা অধিকাংশ এলাকার লোকজন জানে না। মশা মারার ওষুধ প্রতিটি এলাকার সবখানে পৌঁছে না। ফগার ম্যানদের সবখানে দেখা না গেলেও কমিশনার কার্যালয় ও তার বাড়ির আশে পাশে, ক্ষমতাসীন দলের নেতার বাড়ির কাছে এবং সংবাদকর্মীদের আনাগোনা যেখানে বেশি তাদের সেখানে খুব সহজেই দেখা যায়। মশা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলা হলেও মাঠ পর্যায়ে এর চেহারা ভিন্ন। ডিসিসির চেষ্টা সত্তে¡ও মশা কতটা দূর হয়েছে তা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকার বরাদ্দ দিলেও মশার ওষুধ পানিতে পরিণত হয়ে যায়। কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, ‘জলে গেল মশা মারার ৩৬ কোটি টাকা’। গত পাঁচ বছরে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে ১১৬ কোটি টাকা খরচ করলেও কর্তৃপক্ষের দিকে অনিয়মের অভিযোগ বরাবরের মতোই আছে।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ। বাসা বা বাড়ির বাইরের মশা মারার দায়িত্ব নগর পিতার সেটা সবারই জানা। বাইরে মশা থাকলে তা তো বাসার ভিতরে আসবেই, এটাই স্বাভাবিক। অল্প পানি আর কয়েকটি দিন সময় পেলেই মশা বংশ বৃদ্ধি করে ফেলে। রোগ প্রতিরোধে বাড়ির আঙ্গিনা, আশপাশ নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ডাবের খোল, ফুলের টব, পরিত্যাক্ত টায়ার ও এসি-ফ্রিজের পানি জমতে দেয়া যাবে না। কোনভাবেই যাতে মশা বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য সচেতন হতে হবে। শুধু নগর পিতা নয় কারোর পক্ষেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশারি খাটানোর মতো এমন কঠিন কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারাই সবচেয়ে বড় সচেতনতা। মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার বিকল্প নেই। নগরবাসী একটু সচেতন হয়ে মশা জন্মানোর পরিবেশ ধ্বংস করলে আশা করা যায় মশার আক্রমণ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে। নিজেরা সচেতন হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন অবশ্যই আসবে। কর্তৃপক্ষ মশা নিধনে চেষ্টা করুক বা না করুক আপনাকে মশারি খাটাতেই হবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • শেখ ইব্রাহিম ২৭ জুলাই, ২০১৭, ১০:৪৫ পিএম says : 0
    শায়খ আব্দুল কাহহার আল্লাহ আপনাকে বারাকাহ দিন আমিন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন