Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ছয়টি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ

| প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবুল কাসেম হায়দার : মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আমাদের বিতর্ক অহেতুক ও নিরর্থক। প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে অর্থনীতির চলমান হালচাল বোঝা যায় না। আর ৭ শতাংশের অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা যে বলা হয়, অতটা গতিশীল মনে হয় না দেশের অর্থনীতির অন্য সুচকগুলোকে। সৌভাগ্য বলি আর অনুকূল পরিবেশ বলি, গত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমল থেকে দেশে বড় কোন রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি, কৃষি উৎপাদন ও ব্যাহত হয়নি। বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যের দাম কম ছিল। এ সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন পোক্ত হয়েছে, প্রবাসী আয়ও একসময় ছিল গড়ে জিডিপির ১০ শতাংশের মতো। বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্য দেশগুলোকে যেমন টানাপোড়নে থাকতে হয়, পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের যৌথ অবদানে তা থেকে মুক্ত বাংলাদেশ। তার ওপর বাড়তি সুবিধা হচ্ছে ভালো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির আড়ালে অর্থনীতির বড় দুর্বলতাগুলো ঢাকা পড়ে আছে। অর্থনীতির এই সকল দুর্বলতার মধ্যে একটি হচ্ছে আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা। রাষ্ট্রখাতের ব্যাংকগুলোতে যে সকল সমস্যা রয়েছে তা ধীরে ধীরে সংক্রমিত হচ্ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। অথচ ব্যাংক হচ্ছে আর্থিক খাতের হৃৎপিন্ড। হল মার্ক, বিসমিল্লাহসহ অন্যান্য কোম্পানি কত টাকা নিয়ে গেল এবং এই টাকা জিডিপির তুলনায় কত কম বা বেশি, সেই পজিশনটা বড় বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে এ সবের মাধ্যমে পুরো আর্থিক খাতই প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থনীতির দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে, মূল্যায়নহীন বড় অবকাঠামো নির্মাণ। বড় অবকাঠামো আমাদের বেশ প্রয়োজন রয়েছে। তবে এগুলোর মূল্যায়নের কাজটিও দরকার এবং প্রকল্পের ভেতরেই এ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন রয়েছে। পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে আমরা করে ফেললাম, বেশ ভালো কথা, তার মানে এই নয় যে, একবার বললাম মেট্রোরেল করব, আবার বললাম কর্ণফুলীতে টানেল হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ বাস্তবায়নের একটা পরিকল্পনা থাকা খুবই দরকার, যার খুব অভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো না থাকাটা আমাদের অর্থনীতির তৃতীয় বড় দুর্বলতা। এই ক্ষেত্রে বড় ব্যাপার হচ্ছে আস্থার অভাব। অর্ধেক জীবন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, বাকি অর্ধেক বাংলাদেশে এ রকম বহু মানুষ আমাদের দেশে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের উদাহরণ আমরা দিতে পারি। ফিলিপাইন অনেক সম্ভাবনার দেশ হওয়ার পরও উন্নতি করতে পারেনি। কারণ, ফিলিপাইনের লোকেরা নিজেদের সম্পদ জমা রাখত যুক্তরাষ্ট্রে। আর থাইল্যান্ডের শিল্পপতিরা কখনোই তাদের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যাননি। দেশটি এগিয়েছে নিজের শক্তিতে। সম্পদ পাচার রোধে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশকেও এ রকম খেসারত দিতে হবে। ব্যাংক খাত থেকে লুটপাটের ৫ হাজার কোটি টাকা কোথা থেকে কোথা গেছে, ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমেই তা বের করা যায়। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন জেল গেটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, এত টাকা গেল কই, এর কোনো মানে নেই। দেশে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়োজন। তা না হলে দীর্ঘ মেয়াদী সুফল আমরা পাবো না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ছয়টি উপাদানের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা।
(১) শাসকদের বৈধতার জন্য জনকল্যাণে দৃশ্যত কাজ করার তাগিদ : বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দল অংশ গ্রহণ করেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ হয়নি। দেশে ও বিদেশে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনিই। তারপরও সরকার গঠন করা হয়েছে। শাসক দল বৈধতা অর্জন না করতে পারলেও দেশ তো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। তাই দেশে আস্থার সঙ্কট রয়েছে। বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। বুকে শক্তি কম রয়েছে। তাই জনকল্যাণে বেশ দৃশ্যমান কাজ বর্তমান সরকারকে করতে হবে। যে কাজ হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনহিতকর। মানুষ সেই কাজ দেখে সরকারকে ভালো বলবে। কাজ হবে দুর্নীতিমুক্ত, ঘুষ ও অনিয়মমুক্ত। তবেই সরকারের সত্যিকার দেশের প্রতি দরদের নমুনা ফুটে উঠবে।
২) অংশগ্রহণমূলক বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা : বর্তমানে দেশে সকল দলের অংশগ্রহণমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনিই। তাই নির্বাচন ছাড়াই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অধিকাংশ সংসদ সদস্যই নির্বাচিত। ভোটারগণ ভোট দিতে পারেননি। দেশে-বিদেশে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। তারপরও সরকার গঠিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের মনে শান্তি নেই। নেই রাজনৈতিক প্রশান্তি, স্থিতি ও স্বস্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ ধরনের সরকার উপযুক্ত নয়।
তাই বর্তমান সরকারকে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিগত নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে। সে আন্দোলন সফলতা লাভ করতে পারেনি। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কৌশলে এগিয়ে গিয়ে যেনতেনভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হয়। দেশ চালাচ্ছে সরকার কিন্তু কেন যেন শান্তি নাই। রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজমান। এই অবস্থার অবসান সরকারও চায়। সরকার কীভাবে বিরোধী দলকে আস্থায় আনবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
৩) স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে জবাবদিহিতা থাকা : যে কোন দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুশাসন। যে কোন দল দেশ শাসন করবে। এটা নিয়ম। নির্বাচনের মাধ্যমে যে কোন দল ক্ষমতায় আসবে। দায়িত্ব নেয়ার পর শাসন ব্যবস্থার মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় শাসনের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকা খুবই কঠিন কাজ। নিজের দলের লোকদেরকে আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলিত রাখা খুবই কঠিন। সুশাসন কায়েম করতে হলে আইনকে তার নিজ গতিতে চলার সুযোগ দিতে হবে। আইনের শাসনের জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে সৎ, নিরপেক্ষ, দৃঢ়চেতা বিচারক নিয়োগ। বিচারক সৎ, নিরপেক্ষ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত না হলে কোনক্রমেই আইনের শাসন কায়েম করা যাবে না। আমাদের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিজ দলের মধ্যে সুশাসন কায়েম করতে পারছি না। দলের কর্মী, নেতাদের ক্ষেত্রে কোন অভিযোগ এলে তার সমাধানে আমরা সুবিচারের ব্যবস্থায় নিতে পারি না।
৪) অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা : আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো রাজনীতির সঙ্গে একাকার হয়ে পড়েছে। তাই দেশের অর্থনীতি আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির মূল বিষয়সমূহকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকসমূহকে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রাখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকসমূহে নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকসমূহে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দ্রæত বন্ধ করতে হবে। পেশাগত যোগ্যতা, সৎ ও স্বচ্ছ ব্যক্তিদের ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। সরকারি ব্যাংকসমূহকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। কুঋণ কমানোর জন্য ব্যাংকসমূহে আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। অর্থ লুটকারীদের চিহ্নিত করে ঋণ আদায় নিশ্চিত করে শাস্তির বিধান জারি রাখতে হবে।
৫) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা সমুন্নত রাখা : রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে প্রধানতম প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন কমিশন।
এখন বাংলাদেশে বিচার বিভাগে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই কথা সরকার খুব শক্তভাবে বলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে মনে হয়, ব্যাপারটি অনেকটা উল্টো। এখনও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে একটি সমতাসূচক পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক আজও শেষ হয় নাই। সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন হয়নি। এখন নির্বাচন কমিশন তার নিজস্ব আইন বলে শক্তভাবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। ব্যক্তিচরিত্র, যোগ্যতা, সততা, নিরপেক্ষতা এই ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অন্যতম গুণাবলী হওয়া প্রয়োজন। এই সকল গুণাবলী অর্জন না করতে পারলে নির্বাচন কমিশন কখনও মানুষের হৃদয়ে স্থান লাভ করতে পারবে না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সততা, নিরপেক্ষতা, দক্ষতা এই প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত করতে পারে। সরকার কমিশনের কাজে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ যাতে না করতে পারে তা নির্ভর করে কমিশনের সততার উপর। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কমিশন নিয়োগ বন্ধ করা দরকার। দলীয় ব্যক্তিদের খুশি ও সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য নিয়োগ এই ক্ষেত্রেও সমস্যা। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে এই কমিশন কখনও নিরপেক্ষ হবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন এখনও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন জরুরি। সৎ, যোগ্য, স্বচ্ছ ব্যক্তি ব্যতীত এই কমিশন সমুন্নত হবে না।
৬) সক্রিয় ও শক্তিশালী গণমাধ্যম থাকা : সক্রিয় ও শক্তিশালী গণমাধ্যম একটি দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সক্রিয় ও শক্তিশালী গণমাধ্যম অত্যন্ত জরুরি । পৃথিবীর যে সকল দেশে গণমাধ্যম সক্রিয় ও শক্তিশালী সেই সকল দেশে গণতন্ত্রও শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনৈতিক উন্নতিও ঐ সকল দেশে দেখার মতো হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দেশের বৃহত্তম স্বার্থে গণমাধ্যম সক্রিয় ও গতিশীল হওয়া আবশ্যক। নিরপেক্ষ গণমাধ্যম দেশের স্বার্থে দরকার। দেশের ও বিদেশের খবর নিরপেক্ষভাবে জাতির সামনে পেশ করা গণমাধ্যমের মূল কাজ। সমাজে রাষ্ট্রে অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির তথ্য জাতির সামনে নিয়ে আসা সত্যিকার গণমাধ্যমের মৌলিক কাজ। এই কাজ থেকে গণমাধ্যম দূরে সরে গেলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের মানুষ কল্যাণ লাভ করতে পারে না। দেশে এখন গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সকল কর্মকান্ডে ধীর ও স্থবিরতা চলে আসে। অর্থনৈতিক বিন্যাসের চর্চা বন্ধ হয়ে পড়ে।
লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন