Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত চীনের সাথে সীমান্ত উত্তেজনায় ভুটানকে ব্যবহার করছে

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তিব্বত.সিএন : দোকলাম অঞ্চল নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্প্রতি বিরোধ চলছে। ভারত দাবি করেছে যে চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়াদং কাউন্টির এ অঞ্চলটি ভুটানের এবং চীন তা গ্রাস করার চেষ্টা করছে। এ দাবি ঐতিহাসিকভাবে যাচাইকৃত নয়। সিকিম ও তিব্বত বিষয়ে গ্রেট ব্রিটেন ও চীনের মধ্যকার চুক্তিতে চীনা তিব্বত ও ব্রিটিশ নিয়›িত্রত সিকিমের সীমানা সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত হয়েছে যাতে দোকলাম চীনের অংশে পড়েছে। ১৮৯০ সালে চীনের তৎকালীন কিং সরকার ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ঐ সীমান্ত চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্তে পরিণত হয়।
ভারত দাবি করে যে অঞ্চলটি ভুটানের এবং সে চীনের সাথে তার বর্তমান বিরোধের অজুহাত হিসেবে ভুটানকে ব্যবহার করছে।
চীনা সমাজ বিজ্ঞান একাডেমিতে চীনের সীমান্ত এলাকার ইতিহাস ও ভূগোল গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ঝাং ইয়ংপান গেøাবাল টাইমসকে বলেন যে চুক্তিটি মানা আইনত বাধ্যতামূলক এবং ঐতিহাসিক দলিল বা বাস্তবতা যাই হোক, দোকলাম যে চীনের সে ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই।
তিনি বলেন, ভারত ভুটানকে রণাঙ্গনে ঠেলে দিতে চাইছে। তবে আসলে চীন ও ভুটানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক
রয়েছে।
চীন ও ভুটান ১৯৮৪ সাল থেকে সীমান্ত আলোচনা চালিয়ে আসছে। গত আগস্টে দু’দেশের মধ্যে ২৪ তম সীমান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চীনের ভাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ ঝেনমেন বলেন যে এই আলোচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে।
একই প্রতিষ্ঠানের আরেক জন গবেষক সুন হংনিয়ান বলেন, দোকলামকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো ভূূখন্ডগত বিরোধ নেই। ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
ঝাং বলেন, দোকলামে চীনা অবকাঠামো নির্মাণ কাজের গতি যদিও ধীর , কিন্তু লাসা-শিগাৎসে রেলপথ, ইয়াদং কাউন্টিতে সড়ক এবং নাথুলায় রাস্তা নির্মাণ শেষ হলে এ অঞ্চলে চীন কৌশলগত প্রাধান্য লাভ করবে বলে ভারত উদ্বিগ্ন।
ভারত আরো উদ্বিগ্ন যে চীন যেহেতু দোকলামে অবকাঠামো জোরদার করছে , সে কারনে বড় রকমের যুদ্ধের সময় সে শিলিগুড়ি করিডোরের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। ভারতীয় মিডিয়া কর্তৃক প্রায়শই চিকেন নেক বা মুরগির গলা নামে আখ্যায়িত এ করিডোর এতই সংকীর্ণ যে একটি স্থানে এটি মাত্র ২৭ কি মি চওড়া। এ করিডোর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলকে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত করেছে।
অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য
মাত্র ৭ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যা ও আয়তনে সুইজারল্যান্ডের চেয়ে ছোট দেশ ভুটানের সর্বত্র ভারতের প্রভাব বিস্তৃত। ভুটানের রাজধানী থিম্পুর সরু রাস্তার পাশে সারবাঁধা হোটেল ও রেস্তোরাঁ। স্থানীয় মুদ্রা ছাড়াও প্রতিটি ব্যবসা কেন্দ্রে ভারতীয় রুপি গ্রহণ করা হয় যার বিনিময় হার ১ঃ১। গেøাবাল টাইমসের সাংবাদিক যখন গত বছর ভুটান সফর করেন তখন ভারতে নোট বাতিলের ঘটনা ঘটেছিল। ভুটানি ব্যবসায়ীরাও প্রত্যাহারকৃত নোট নিতে অস্বীকার করেন।
ভুটানের পর্যটন আইনে বলা হয়েছে বিদেশীরা শুধু সরকার অনুমোদিত ট্যুর গ্রæপের সাথে বা একজন ট্যুর গাইড নিয়েই শুধু ভ্রমণ করতে পারবেন। ভুটানে গেøাবাল টাইমসের সাংবাদিক দক্ষিণ ভারতের বাঙ্গালোর থেকে আসা কয়েকজন যুবেেকর দেখা পান। তারা তাকে বলেন, তারা ভুটানে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারেন। যেহেতু ভারত ভুটানের পররাষ্ট্র ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে , সে কারণে ভুটান দেশটির কোনো কর্মকান্ডের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে না। ভুটানের অনেক বিলাসবহুল হোটেল ভারতীয় হোটেল গ্রæপ দ্বারা পরিচালিত, হোটেলগুলোর সব কর্মচারীও ভারতীয়।
জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের সুধা রামচন্দ্রনের চীন ও ভারতের সাথে ভুটানের সম্পর্ক বিষয়ে লেখা এক নিবন্ধ অনুযায়ী ভুটানের আমদানির ৭৯ শতাংশ আসে ভারত থেকে এবং তার রফতানির ৯০ শতাংশের বাজার ভারত। ভারত হচ্ছে ভুুটানের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। ভারত ভুটানের অবকাঠামোরও নির্মাতা যেমন পানিবিদ্যুত প্ল্যান্ট।
ভুটানের সামরিক বিষয়ে ভারতের হিন্দু পত্রিকায় এক নিবন্ধে বলা হয়, ভারতের সামরিক বাহিনী ভুটানকে যে কোনো ধরনের বৈদেশিক হুমকি যা চীনা সামরিক বাহিনী দিতে পারে, থেকে রক্ষার দায়িত্বে আছে। ঐ নিবন্ধ অনুযায়ী, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ড ও পূর্বাঞ্চলীয় বিমান কমান্ড ভুটানের সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়া ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষণ দল ভুটানি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভিক্টর লীর লেখা চলতি ঘটনা বিষয়ক সাময়িকী দি ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুযায়ী ২০১৪ সালে তার ভুটান ভ্রমণের সময় ভারতীয় সৈন্যদের দেখা পাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
তিনি লিখেছেন, “ অক্টোবরের শেষদিকে ভুটানের পারো শহরে আমি ৬শ’ ভারতীয় সৈন্যের একটি সেনাঘাঁটি অতিক্রম করি। ভুটানের তীব্র শীতের দিনগুলোতে তারা দেশে ফেরার গোছগাছ করছিল। সূর্যোদয়ের ঠিক পরপরই একই রাস্তায় আমি ভারতীয় বিশেষ বাহিনীর সৈন্যদের একটি দলের সম্মুখীন হই। তিনি ভারতীয় সৈন্যদের সাথে ১২০ জন ভুটানি সৈন্যকেও দেখতে পান যারা ভারতীয়দের কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল ।
ভারতের প্রতি অতি নির্ভরশীলতার কারণে ভুটানের পক্ষে কূটনৈতিক স্বাধীনতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৯৪৯ সালে ভারত ও ভুটান একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যাতে ভুটান ভারতকে তার পররাষ্ট্র নীতির নির্দেশনা প্রদানে সম্মত হয়।
সুন গেøাবাল টাইমসকে বলেন, ভারতের প্রতি ভুটানের আনুগত্য ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্য। ব্রিটিশরা তিব্বতে প্রবাব বিস্তারের লক্ষ্যে নেপাল, সিকিম ও ভুটানকে নিয়ন্ত্রণ করত। এগুলো আগে ছিল চীনের কিং সা¤্রাজ্যের সামন্ত রাজ্য (১৬৪৪-১৯১১)। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ভারত স্বাভাবিকভাবেই এসব রাজ্যের মালিক হতে চেয়েছিল। ২০০৭ সালে ভুটানে রাজনৈতিক সংস্কারে ভারত ও ভুটানের মধ্যকার বন্ধুত্ব চুক্তি সংশোধন করা হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ে ভারতের দিক নির্দেশনা অপসারণ করা হয়। তবে এখনো ভুটানের পররাষ্ট্র সম্পর্ক ভারতের জাতীয় স্বার্থের ক্ষতিকর হতে পারে না।
বর্তমানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যের কারো সাথে ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেনি। প্রায় ৫০টি দেশের সাথে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। তবে অল্প কয়েকটি দেশেরই ভুটানে দূতাবাস আচ্ েযেমন ভারত,বাংলাদেশ ও কুয়েত।
কৌশলগত গুরুত্ব
হিমালয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও বিশে^র সর্বাপেক্ষা জনবহুল দু’টি দেশের মাঝে সংকুচিত হয়ে থাকা ভুটানের বিরাট কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। দি ডিপ্লোম্যাট দেশটিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখ রেখা বলে উল্লেখ করেছে।
ভুটানের সরকারী কর্মকতারা ভুটান-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন । তাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে , সিকিমের বেলায় যা ঘটেছে, ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়, ভুটানের বেলায়ও তা ঘটতে পারে। দেশটি যখন একুশ শতকে প্রবেশ করেছে ভুটানের রাজা তার রাজনৈতিক ক্ষমতার বেশিরভাগই ত্যাগ করেছেন এবং গণতন্ত্র সরকারকে অধিকতর কর্তৃত¦ দেবে এ আশায় পার্লামেন্টারি নির্বাচন চালু করেছেন।
দি ডিপ্লোম্যাটের মতে, বহু বিশ্লেষকই মনে করেন যে ভারত নির্বাচনী ফল প্রভাবিত করতে এবং ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপারে জনগণের মত পরিবর্তন করতে তার অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ভুটানের ২০১৩ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হয় যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলের চীনের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করার প্রচেষ্টার জবাব হিসেবে নির্বাচনে তার সরকারের পরাজয় ঘটাতে ভারত ভুটানে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাসোলিন ও কেরোসিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ ব্যবহার করে। পরে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ভারতের নয়া প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম বিদেশ সফরের দেশ হিসেবে ভুটানকে বেছে নেন এবং উপহার হিসেবে আগের বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশী সাহায্য ও ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেন।
নয়া দিল্লী ভুটানের অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্র কব্জা করে রেখেছে। যদিও দেশটি তার সার্বভৌমত্ব জোরদার করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভুটানের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পথ বন্ধুর হতে বাধ্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ