Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাবার দুশমনদের ধ্বংস অনিবার্য-১

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রূহুল আমীন খান : রমযানুল মোবারকের শেষ শুক্রবার জুমআতুল বিদার পবিত্র দিনে বিশ্ব মুসলিমের প্রাণকেন্দ্র মক্কা মুয়াজ্জমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহিমান্বিত ঘর কাবা শরীফের সন্নিকটে আত্মঘাতী বোমা হামলার যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে তাতে আমরা দারুণভাবে আহত হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি, যারপরনাই স্তম্ভিত হয়েছি। এই অনুভ‚তি শুধু আমাদের নয়, প্রতিটি মুসলিমের, গোটা মুসলিম উম্মার। কারণ কাবা-মসজিদুল হারাম ও মুসলমান একাত্ম, এক প্রাণ। কাবা আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি। মুসলমানের জীবন কাবাকেন্দ্রিক। কাবা বিশ্বমানবতার ঐক্যের প্রতীক। আল্লাহর ঘর কাবা আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে চিরন্তন সেতুবন্ধন। আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, রহমাতের বাস্তব রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাবা। দাঁড়িয়ে থাকবে মহাপ্রলয় পর্যন্তÑ অনন্তকাল। পাথর নির্মিত যে কাবা মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান, কাবার পরিসর শুধু ঐ টুকুতেই নয় সীমাবদ্ধ। যমিনের সর্বনি¤œ দেশ থেকে সপ্তম আসমানস্থিত বায়তুল মামুর পর্যন্ত ব্যাপৃত, বিস্তৃত। মুসলমান সে যেখানেই থাকুক না কেন সমুদ্রতলদেশে কিংবা মহাকাশের কোনো নভোযানে ঐ কাবার দিকেই মুখ করে সে সালাত আদায় করে, আল্লাহর হুজুরে লুটিয়ে পড়ে সিজদায়। লুটাবে অনন্তকাল।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তুমি যেখান থেকেই বের হও না কেন, মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরাও। এটা নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক আল্লাহর নিকট থেকে প্রেরিত সত্য। তোমরা যা করো সে সম্বন্ধে আল্লাহ অনবহিত নন। তুমি যেখান থেকেই বের হও না কেন মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন সে দিকে মুখ ফিরাবে। সূরা বাকারা ২ : ১৪৯, ১৫০ আয়াত।
বস্তুত মূল কাবা গৃহ, এ গৃহ বেষ্টিত মসজিদ, মাকামে ইব্রাহীম, যমযম ক‚প এ নিয়েই মসজিদে হারাম।
আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আরো কারণ এই যে, বিশ্বব্যাপী চলছে যখন চরম অশান্তি ও উত্তেজনা, মুসলিম উম্মাহ যখন শতধা বিভক্ত, সর্বত্র সন্দেহ-অবিশ্বাস, চলছে মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাতÑ এই অনৈক্য-অশান্তির মাঝে কেবলমাত্র একটি জায়গা যেখানে নিরাপত্তার, ঐক্য ও মিলনের সেটিকেই করা হচ্ছে ধ্বংসের পাঁয়তারা। আজও যেখানে বিবদমান দেশের সংঘাতমুখর মানুষেরা এসে ভুলে যায় সব দুশমনী, ভুলে যায় বর্ণভাষা, আঞ্চলিক সীমারেখার ব্যবধান, লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, হাজির হে প্রভু হাজির আমি তোমার দরবারে নিবেদনের গুঞ্জন; একই পোশাক পরিধান করে এই দোয়া উচ্চারণ করে, আবর্তিত হয় কাবাকে কেন্দ্র করে, নীল আসমানের শামিয়ানা তলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়, করে আল্লাহর হুযুরে আত্মনিবেদন, আত্মসমর্পণ, লুটিয়ে পড়ে তাঁর সমীপে সিজদায়, মিলায় হাতে হাত, মিলায় বুকে বুকে, সব দুশমন, সব ভেদ-বৈষম্য ভুলে একটি মাত্র পাথর হাজরে আসত্তয়াদের চুম্বনের মাধ্যমে ঢেলে দেয় প্রাণের আকুিত, অন্তরের সবটুকু আবেগ, মোহব্বত, ভালোবাসাÑ এই মহামিলন, এই মানবতার মহাঐক্য বিনষ্ট করতে চায় কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? এ তো শুধু একটি চুম্বনমাত্র নয়। এখানেই তো চুম্বন করেছেন বাবা আদম, নবী ইবরাহীম, ইসমাঈল থেকে সব নবী-রসূল। চুম্বন করেছেন আল্লাহর পেয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা:) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, ইমাম, মুজতাহেদীন সর্বযুগের সর্বসেরা আল্লাহর বান্দাগণ, পাথরে চুম্বনের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তো হয় তাদের অধরেও চুম্বন দেয়া। বাবা আদম থেকে এ পর্যন্ত এবং অনাগতকাল পর্যন্ত একটি যোগসূত্র গড়ে তোলাÑ কারা চায় এই ঐক্যসূত্র ছিন্ন করতে? তাদের চেয়ে ঘৃণ্য শান্তির দুশমন, মানবতার শত্রæ আর কে হতে পারে? স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন: ‘যে কেউ আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা প্রদান করে ও তাদের বিনাশ সাধনে প্রয়াসী হয় তাদের চেয়ে বড় সীমা লংঘনকারী আর কে হতে পারে?....পৃথিবীতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ভোগ ও পরকালে তাদের জন্য মহা শাস্তি রয়েছে। ২. সূরা বাকারা : ১১৪ আয়াত। আল্লাহ ঘোষিত এই মহা শাস্তি তাদের ভোগ করতেই হবে, নাই নাই নিস্তার। আল্লাহ বলছেন : ‘আলামতারা কাইফা ফাআলা রাব্বুকা বি আস্হাবিলফিল....তুমি কি দেখনি যে তোমার রব (আল্লাহ) হস্তিবাহিনীর সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছিলেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি? তাদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে (আবাবীল) পাখি পাঠিয়েছেন যারা তাদের উপরে পাথর-কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিল। অতঃপর তিনি তাদের চর্বিত-ভক্ষিত ঘাসের মতো করে দেন। ১০৫. সূরা ফীল।
কাবা ধ্বংসের জন্য এই হস্তিবাহিনী নিয়ে এসেছিল কাবা বিদ্বেষী বাদশাহ আবরাহা। প্রথমে সে ছিল আবিসিনিয়ার স¤্রাটের সেনাপতি। ইয়েমেন অধিকার করে স্বাধীন রাজা হয়ে বসে। সে দেখল তার দেশসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের তীর্থ যাত্রীরা যাচ্ছে মক্কার কাবায়। এতে তার তত্ত¡াবধায়কদের সম্মান ও মর্যাদা খ্যাতি যেমন দুনিয়াজোড়া, তেমনি আর্থিক দিক থেকে লাভবানও হচ্ছে তারা। বিদ্বেষ জাগল তার কাবার প্রতি। সাধ জাগল ইয়েমেনের রাজধানী সানায় কাবার অনুরূপ এক কাবা নির্মাণের। যেই ভাবা সেই কাজ। সানায় নির্মাণ করল সে এক নকল কাবা। আহŸান জানাল সবাইকে তার এই কাবায় এসে হজ করতে। কিন্তু সাড়া মিলল না তার সেই আহŸানে বরং ঘটল আর এক বিপত্তি। কে যেন রাতের অন্ধকারে তার কাবায় প্রবেশ করে মলমূত্র ব্যাগ করে একাকার করে দেয় পুরো ঘর। অনুসন্ধানে জানতে পারল যে লোক এমনটি করেছে সে মক্কার বাসিন্দা। বিদ্বেষব‎িহ্নত ঘৃতাহুতি হলো এই তথ্য। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠল সে। প্রতিশোধ নেব আমি। ধ্বংস করে দেব মক্কার ঐ কাবা। সেনা-সৈন্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে সে অগ্রসর হলো কাবা ধ্বংসের অভিযানে। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে র্শিবির গাড়ল এসে মক্কার প্রান্তদেশে, হারাম সীমা-সংলগ্ন ওয়াদিয়ে বতনে মুহাস্সাবে। পরিকল্পনা হলো, এখানে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকালে হারমের সীমানা চিহ্ন পেরিয়ে অভিযান চালাবে মক্কায়, ধ্বংস করবে কাবা।
হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ ও কাবা ধ্বংসের জন্য বাদশাহ আবরাহা আসছে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। ভীতসন্ত্রস্তÍ হয়ে পড়ল মক্কাবাসী। তার মোকাবেলা করবে এমন শক্তি-সামর্থ্য তাদের নেই। সিদ্ধান্ত হলো, আক্রমণকালে বাড়িঘর ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে উঠে প্রাণ বাঁচাবে তারা। প্রিয় নবী সা:-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব তখন কোরেশদের প্রধান নেতা, কাবার প্রধান অভিভাবক। দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি ছুটে গেলেন কাবায়, প্রবেশ করলেন অভ্যন্তরে। হৃদয় ফেটে যাচ্ছে তাঁর। আবেগাপ্লুত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কাবার খুঁটি, কান্নাভেজা কণ্ঠে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন তিনি কাবার মালিকের দরবারে। বলতে লাগলেন : আমরা জানি কারো ঘর শত্রæ আক্রমণ করলে সে তার মোকাবেলা করে নিজ ঘর রক্ষা করে। তোমার ঘর ধ্বংস করার জন্য আসছে আবরাহা। সাধ্য থাকলে আমরা তোমার ঘর কাবাকে রক্ষা করতাম। কিন্তু সে সাধ্য আমাদের নেই। হে ঘরের মালিক, তুমি তোমার ঘর কাবাকে রক্ষা করো। এভাবে করুণ ফরিয়াদ জানিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
ওদিকে বতনে মুহাসসাবে শিবির সন্নিবেশিত করে আবরাহা অপেক্ষা করতে লাগল। তার সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল পার্শ্ববর্তী প্রন্তরে সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছিল আবদুল মুত্তালিবের একটি উটের পাল। আবরাহা বাহিনী তা লুট করে নিয়ে গেল। সংবাদ পেয়ে আবদুল মোত্তালিব ছুটে গেলেন উট উদ্ধারের জন্য আবরাহার শিবিরে। কোরেশদের মহান নেতা মুত্তালিবের ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক ভাবগম্ভীর সৌম্যকান্তি দেখে অভিভ‚ত হলো আবরাহা। স্বাগত জানিয়ে, সম্মানে আসন দিয়ে জিজ্ঞাসা করল তাঁর আগমনের হেতু। আবদুল মুত্তালিব বললেন, আপনার সৈন্যরা আমার ২০০ উট লুট করে নিয়ে এসেছে এখানে, তাই ফেরত নিতে এসেছি আপনার কাছে। এ উত্তর প্রত্যাশিত ছিল না আবরাহার কাছে। সে বলল, আপনি কোরেশ নেতা, মক্কা ও কাবার অভিভাবক, আগামীকাল আমি মক্কায় অভিযান চালাব, আপনাদের কাবা ধ্বংস করব। আমি ভেবেছিলাম কাবা রক্ষার আবেদন জানাবেন আপনি আমার কাছে। তা না করে সামান্য ক’টি উট ফেরত চাইতে এসেছেন আপনি! শান্ত ধীরকণ্ঠে আবদুল মুত্তালিব বললেন, হ্যাঁ, উটই নিতে এসেছি। কারণ উটের মালিক আমি। উটগুলো উদ্ধার করা আমার কাজ। কাবার মালিক যিনি তিনিই রক্ষা করবেন তাঁর ঘর কাবা। আবরাহা ফেরত দিলো উটগুলো এবং আবদুল মুত্তালিব সেগুলো নিয়ে ফিরলেন মক্কায়। প্রভাত হলো। আবরাহা অভিযানের নির্দেশ ছিল। অগ্রে হস্তিবাহিনী। পুরোভাগে তার প্রধান রাজহস্তি মাহমুদ। অগ্রসর হলো মাহমুদ। অগ্রসর হলো তার পশ্চাতে অন্য হস্তিরা ও বিশাল বাহিনী।



 

Show all comments
  • বুলবুল আহমেদ ১৪ জুলাই, ২০১৭, ১:০১ পিএম says : 0
    অসাধারণ একটি লেখা। লেখক ও দৈনিক ইনকিলাবকে অসংখ্য মোবারকবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ