ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
কে. এস. সিদ্দিকী
উপমহাদেশের বিখ্যাত সাধক কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানা শামসুল ওলামা হযরত শাহ সুফী ছফিউল্লাহ (রহ.) ছিলেন সকলের কাছে ‘দাদাজী কেবলা’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র তার হাজার হাজার শাগরিদ, ভক্ত-অনুসারী এখনো হয়তো জীবিত আছেন। ভারতের মতো এদেশেও তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় প্রায় চল্লিশ বছর যাবত অধ্যাপনায় নিয়োজিত থাকায় বাংলাদেশের অসংখ্য ছাত্র তার কাছে অধ্যয়ন করা ছাড়াও আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন। অনেকে তার হাতে বয়াত হয়েছেন, মুরিদ হয়েছেন এবং তরিকার অনুসরণে এদেশেও তা প্রচার করেন। এখানে তার খলিফাও ছিলেন কয়েকজন। তিনি আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার শেষদিকে সর্বোচ্চ পদ হেড মাওলানা পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। হাজার হাজার কারামত বা অলৌকিক ঘটনার অধিকারী হযরত দাদাজী ছিলেন কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, মোজাদ্দেদিয়া প্রভৃতি সিলসিলা বা তরিকার অনুসারী। এজন্য বাংলাদেশে তার অনুসারী-ভক্তদের সংখ্যা ও অগণিত। তিনি বাংলাদেশে অবস্থান না করলেও তার আদর্শ ও শিক্ষার প্রচারকারী অনুসারীগণ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তার ফয়েজপ্রাপ্ত হয়ে এখানে তবলীগ প্রচারে লিপ্ত থাকেন। এই সাধক আলেম সমাজ ও আধুনিক শিক্ষিত সুধীমহলের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সম্মানের পাত্র। যারা তার ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন তারা হযরত দাদাজী কেবলার বহু অলৌকিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তার কিছু কিছু পুস্তক-পুস্তিকায় বর্ণিত হয়েছে এবং অবর্ণিতও রয়ে গেছে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা।
হযরত দাদাজী ছিলেন বিগত শতকের একজন শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক সাধক সংস্কারক, ইসলামী শিক্ষাবিশারদ এবং কামেল পীর। যাদের হক্কানি আলেম বলা হয়, তিনি ছিলেন তাদের একজন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসী। আনুমানিক ১৮৭০ সালে তিনি সীমান্ত প্রদেশের মরদান জেলার সোওয়াত স্টেটের ‘মারতন’ তহশিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হযরত শাহ আবদুর রহমান ওরফে বাবা জওয়াদ শাহ ছিলেন বিখ্যাত সাধক, মাতাও ছিলেন ওলি। তার পূর্বপুরুষগণ সোওয়াত স্টেটের টাড়া গ্রামে বসবাস করতেন। কোন কারণবশত সেখান থেকে তারা সোওয়াত স্টেটের গ্রামে চলে আসেন। কিন্তু দাদাজী কেবলা কলিকাতায় চলে আসেন এবং ১৮/১ ছকু খানসামা লেনে বসতি স্থাপন করেন।
দাদাজী কেবলার প্রাথমিক শিক্ষা তার মামা শাহ সুফী তালেব শহীদ (রহ.) নিকট শুরু হলেও পরবর্তী শিক্ষা কোথায়, কার কাছে, কীভাবে হয় তার কোন বিবরণ পাওয়া যায় না বলে কোন কোন রচনা হতে জানা যায়। এ কারণে বলা হয় যে, বাল্যকাল থেকেই তিনি কোন আধ্যাত্মিক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে থাকেন এবং এরূপ বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার শিক্ষা হয় কুতুবুল কাওনাইন, গাওছুছ ছাকালাইন, হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর কাছে। অবশ্য কারো কারো মতানুযায়ী তিনি ছিলেন জন্মগত ওলি এবং তার মামার কাছেই তিনি জাহেরি ও বাতেনি জ্ঞানলাভ করেন। তার মামা ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাধক আলেম। তার ইন্তেকালের পর দাদাজী কেবলা মাঝে মাঝে স্বপ্নযোগে তার কাছ থেকে শিক্ষালাভ করতেন বলেও বর্ণিত আছে। তার জীবনের এটি এক বিরল বিস্ময়কর ঘটনা।
জন্মগতভাবেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। একজন জবরদস্ত আলেম, দার্শনিক, পবিত্র কোরআনের বিশেষজ্ঞ হওয়ার সাথে অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়েও তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সাধনা জগতে তার প্রসিদ্ধি লাভ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তার মামা শাহ সূফী তালেব শহীদ (রহ.) এর ইন্তেকালের পর তিনি অধিকাংশ সময় বনে-জঙ্গলে অতিবাহিত করেন এবং তার মামার মাজারেও পড়ে থাকতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর এবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকতেন। বনে-জঙ্গলে, মরুভূমি ঘুরে বেড়ানোর সময় বহু আধ্যাত্মিক সাধকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের কাছ থেকে তিনি ফয়েজ লাভ করেন। এক সময় তিনি গভীর রাতে শব্দ শুনতে পান, তাকে এক অজ্ঞাত স্থান হতে সেখানে যাওয়ার জন্য ডাকা হচ্ছে। বারবার এই ডাক শুনে ভয়ে-বিস্ময়ে তিনি সেদিকে অগ্রসর হতে থাকেন। শব্দ আসছিল একটি কবর হতে। এটি এক বৃদ্ধ ব্যক্তির ডাক। হাতে চুড়ি পরা, মাথায় মেয়েদের মত লম্বা চুলধারী বৃদ্ধকে দেখতে মেয়েলোক মনে হচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন পুরুষ বিশিষ্ট সাধক-বুজুর্গ। কবরে বসেই তিনি সাধনায় লিপ্ত এবং তিনি হামযা বেগম বাবা নামে পরিচিত। মেয়েদের মত পোশাক পরতেন বলে তাকে এই নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই হামযা বেগম বাবার কাছে ইলমে লা দুনী বা আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান অর্জন করে দাদাজী কেবলা কামেলপীরে পরিণত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি আল্লাহর প্রেমে আসক্ত হয়ে আবারও বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। দাদাজী কেবলার বয়স যখন ১৮ বছর তখন তিনি ঘুরতে ঘুরতে পেশোয়ার জেলার বামখিল গ্রামে উপনীত হন। সেখানে অবস্থান করতেন হযরত শাহ সুফী মাওলানা আবদুল হক (রহ.) ওরফে লালাজী কেবলা। দাদাজী তার দরবারে উপস্থিত হয়ে তার হাতে বায়াত হন এবং তার কাছ থেকে মারেফতের জ্ঞানলাভ করেন। অল্প দিনের মধ্যে হযরত লালাজীর ইন্তেকাল হলে তার সুযোগ্য পুত্র হযরত শাহ সুফী মাওলানা আবদুল কাইয়ুম ওরফে বাবা সাহেব হতে তিনি ফয়েজ লাভ করেন। তার খেদমতে কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি পদব্রজে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেন। প্রথমে তিনি রামপুর রাজ্যে অবস্থান করতে থাকেন। অতঃপর আবদুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি তাকে কলিকাতায় আসার পরামর্শ দেন। সেখানে আলিমুদ্দীন খানের বাসায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তার বাসা ছিল কলিকাতার ৯নং এছানি বাগান লেনে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, রামপুরে অবস্থানকালে দাদাজী কেবল মাওলানা মনোয়ার আলী রামপুরীর কাছে হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন বলে মরহুম মাওলানা নুর মোহাম্মদ আজমী তার মেশকাতের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।
দাদাজী কেবলা কলিকাতায় আসার সময় আবদুল্লাহ আলিমুদ্দীন খানের কাছে একখানা পত্র দিয়েছিলেন। তিনি যখন কলিকাতায় পৌঁছেন, তখন আলিমুদ্দীন তার নিজ বাড়ি ঢাকায় গিয়েছিলেন এবং কলিকাতায় তার পুত্র মৌলভী আবদুর রহমান ছিলেন। তিনি দাদাজীকে তার বাড়িসংলগ্ন মসজিদে থাকতে দিয়েছিলেন। এই সময়ের একটি ঘটনা। আবদুর রহমান একটি সমস্যায় পড়েছিলেন যার সমাধান কেউ দিতে পারছিল না। দাদাজী কেবলাকে সমস্যার কথা বলার সাথে সাথে তিনি তার সমাধান দিয়েছিলেন। আবদুর রহমান এতে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তার পিতা আলিমুদ্দীন কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করলে তাকে সব ঘটনা বলেন। এই ঘটনার পর দাদাজীকে তারা নিজ গৃহে নিয়ে আসেন। তারা তার প্রতি অত্যন্ত উত্তম আচরণ ও অধিক যতœবান ও সচেতন থাকেন। এটি ১৯০১ সালের ঘটনা।
১৯০৪ সালের এপ্রিল মাসে হযরত দাদাজী কেবলা প্রথম যখন কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে মাদরাসা চরম উন্নতির দিকে ছিল। শিক্ষার সকল বিষয়ে যুগশ্রেষ্ঠ আসাতেজায়ে কেরাম শিক্ষক মÐলী অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিল। তাদের মধ্যে কেবল শামসুল ওলামা খেতাবে ভূষিত ছিলেন অনেকে এবং তারা হচ্ছেন বিখ্যাত তফসীর- তফসীরে হক্কানির লেখক হযরত মাওলানা আবদুল হক হক্কানি দেহলবী, হযরত মাওলানা ফজলুল হক রামপুরী, মাওলানা বেলায়েত হোসেন কালকাক্তবী, হযরত মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী, হযরত মাওলানা লুৎফর রহমান বর্ধমানী, বহু আরবি কেতাব লেখক হযরত মাওলানা সাদাত হোসেন সাহারানপুরী, হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব বিহারী, মীর মোহাম্মদ শাহারানপুরী, হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ টুংকী, হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ বদায়ুনী, হযরত মাওলনা ওয়াসিউদ্দীন প্রমুখ।
তার খ্যাতির কথা শুনে ১৯০৪ সালে আলিয়া মাদরাসার ইংরেজ প্রিন্সিপাল ড. বাট তাকে সিনিয়র শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ১৯২৭ সালে তাকে হেড মাওলানা করা হয়। ১৯২৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই মতান্তরে ৮ জুলাই তিনি কলিকাতায় ইন্তেকাল করেন। ১৮নং চক্ক খান সামান লেনে তাকে দাফন করা হয়।
বর্তমান বাংলাদেশ জন্ম লাভেরও ৬ দশক পূর্বে দাদাজী কেবলা দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশে তার আগমনের কথা জানা যায় না, তার ইন্তেকালের পরপরই দেশ ভাগ হয়ে যায়। বড় ভাইয়া নামে খ্যাত মাওলানা আবদুল গফুর ছিলেন দাদাজী কেবলার বড় সন্তান এবং যোগ্যউত্তরসূরী। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন। তরিকত শাস্ত্রে তার উপাধি ছিল রইসুল আওলিয়া ও সিরাজুম মালেকীন। ১৯০৭ সালে রবিউস সানি মাসের একাদশ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। এদিন বাংলা-ভারতে গাউসুল আজমের আশেকগণ বড়বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। তাই বড় ভাইয়ার জন্য দিনটি গৌরবের। তিনি পিতার নিকট হতে মুন্ডুক ও মারেফতের সকল স্তর অর্জন করেন। পিতার জীবদ্দশায় তার সুনাম খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
দাদাজী কেবলার নিকট কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত বাঙালি ছাত্রদের সংখ্যাও ছিল বিপুল যাদের মধ্যে ফখরুল মোহাদ্দেসীন উপাধিধারী শিক্ষাপ্রাপ্ত উলামায়ে কেরাম ছিলেন। উল্লেখ্য, তার অধ্যাপনাকালের শেষ পর্ব অর্থাৎ টাইটেল জামাত তিন বছর মেয়াদী ছিল এবং এ সনদের নাম ছিল ফখরুল মোহাদ্দেসীন। পরবর্তী কালে টাইটেল দুই বছর মেয়াদী হওয়ার পর সনদের নামকরণ করা হয় মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন (এম.এম) মোমতাজুল ফোকহা (এম.এফ) ইত্যাদি যা বর্তমানেও প্রচলিত। দাদাজী কেবলা ও তার সহকর্মী অধ্যাপকগণের অনেকেই ছিলেন শামছুল উলামা উপাধিতে ভূষিত এবং তারও ছিল এই একই উপাধি।
শামসুল উলামা হযরত শাহ সূফী ছফিউল্লাহ দাদাজী কেবলা (রহ.) এর সুদীর্ঘ অধ্যপনা জীবনে যারা তার জাহেরী ও বাতেনী (ইলমী ও রুহানী) ফয়েজ লাভ করে ধন্য হয়েছেন তাদের অধিকাংশই এ দ্বীনী আধ্যাত্মিক শিক্ষার মশাল হাতে নিয়ে সারাদেশে তা ছড়িয়ে দেয়ার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তাদের মধ্যে খ্যাতনামা অনেকে এখন হয়তো বেঁচে নেই, যারা বেঁচে আছেন, তাদের খবর কে রাখে? তবুও বলতে হয়, দাদাজী কেবলার ইলমী আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী মাশায়েখ উলামা তার মশাল হাতে নিয়ে দ্বীন ইসলামের আলোক বর্তিকা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার শাগরিদ খলিফা, মুরীদ, ভক্ত অনুসারীদের সংখ্যা এখনো কিছু না কিছু নানাস্থানে বিদ্যমান আছে, যাদের সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো কিছু জানি না। ৭ জুলাই কিংবা ১৮ শাবান দাদা কেবলার ওফাত দিবস ছাড়াও যে কোন দিন তাকে স্মরণ করার আয়োজন করা হলে তাঁর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য বের হয়ে আসতে পারে। এটি দাদাজী কেবলার উত্তরসূরিদের দ্বীনি ও নৈতিক দায়িত্ব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।