ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মীম মিজান : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাধারে ভাষাপন্ডিত, জ্ঞানতাপস, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক, সম্পাদক, অভিধান প্রণেতা ও শিক্ষক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার কাছে চিরঋণী। এই জ্ঞানতাপস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি বেশ আমুদে ছিলেন বলে সবাই তাকে ‘সদানন্দ› নামে ডাকতেন। ৪ বছর বয়সে গ্রামের মক্তবে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। তাদের পরিবার ছিল আরবি, ফারসি ও উর্দুতে শিক্ষিত। শহীদুল্লাহর বাবা ৫টি ভাষা জানতেন। ১০ বছর বয়সে শহীদুল্লাহকে হাওড়া জেলার সালদিয়া মাইনর স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলে তিনি আরবি-ফারসির বদলে সংস্কৃতিকেই বেছে নিয়েছিলেন এবং সংস্কৃতিতে বরাবরই প্রথম হতেন। একজন মুসলমান ছাত্রের এই কৃতিত্ব দেখে স্কুলের হিন্দু শিক্ষকরা অবাক হয়ে যেতেন!
যখন তিনি স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিলো তার দারুণ নেশা। নানা বিষয়ে জানার ছিলো তার প্রচÐ আগ্রহ। এই সময় থেকেই তিনি ভাষা শেখার প্রতি মনোযোগী হন। স্কুল জীবনেই তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি এবং উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। সংস্কৃতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কারণেই পরবর্তীতে তিনি এমএ পড়ার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেন। কিন্তু সংস্কৃতের হিন্দু শিক্ষক সত্যবৃত সামশ্রমী একজন মুসলমান ছেলেকে সংস্কৃতের শাস্ত্র ‘বেদ’ পড়াতে কিছুতেই রাজী হলেন না। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্তে¡ও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি দিল্লী হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহকে সংস্কৃতি পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য একটি সাবজেক্ট চালু করে তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী ‘ভাষাতত্ত¡ বিভাগ’ নামে নতুন একটি ফ্যাকাল্টি চালু করেন। শহীদুল্লাহ সেখানেই ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে সংস্কৃতে এমএ পাস করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি নবগঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর দু‘বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাঙলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলী বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্তে¡ মৌলিক গবেষণার জন্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা ছিলো নিরন্তর। বাংলা সাহিত্যের কাল নির্ধারণে তিনি যে মত প্রকাশ করেছেন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা সেই মতকেই এযাবৎ গ্রহণ করে আসছে।
বহুভাষাবিদ এই পÐিত নতুন এবং পুরানো ভাষা মিলিয়ে মোট চব্বিশটি ভাষা জানতেন। তার মধ্যে রয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, সিংহলি, জার্মান, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল ইত্যাদি। গবেষণার পাশাপাশি তিনি কিছু গল্পও লিখেছেন। রয়েছে শিশুতোষ গ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন দীওয়ানে হাফিজসহ ইকবালের শিকওয়াহ ও জওয়াবে শিকওয়াহ গ্রন্থ। ইকবালের জীবন ও সাহিত্য নিয়েও গ্রন্থ রচনা করেছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, যা এখনও অদ্বিতীয় হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে পদ্মাবতী অন্যতম। তিনি স্বনামধন্য কিছু পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। বাংলা ভাষা চর্চার যে ভিত্তি তিনি দাঁড় করিয়ে গেছেন, সেই ভিত্তি রয়েছে এখনও মজবুত। লেখক, গবেষক, সম্পাদক, শিক্ষক, সংগঠক সব শাখাতেই তিনি যেমন ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন; তারপর সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে (১৯১৫-১৯) নিযুক্ত হন। এখানে তিনি পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত¡াবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী (১৯১৯-২১) হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে (১৯২১) যোগদান করেন। এর পরে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে কর্ম সম্পাদন করেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি আর দেশি-বিদেশি ভাষায় লেখা তার প্রবন্ধের সংখ্যা কয়েকশ।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মূল্যায়ন :
১. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বাংলা ভাষার প্রথম সহজবোধ্য ‘বাংলা ব্যাকরণ’ লিখলেন তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশী হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আপনার বাংলা ব্যাকরণখানি পড়ে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্যাকরণখানি সকল দিকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ছাত্রদের উপকার হবে। বইখানি আমার শান্তি নিকেতনের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের দেব। তাঁরা তা শ্রদ্ধাপূর্বক ব্যবহার করবেন।’
২. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিশু-কিশোরদের জন্য ‘আঙুর› পত্রিকা বের করার পর একে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, আপনার মত এত বড় পÐিত, যাহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই, যিনি বেদ-বেদান্তের অধ্যাপক, ফার্সি ও আরবি যার নখদর্পণে, যিনি জার্মান ব্যাকরণের জটিল ব্যুহ ভেদ করিয়ে অবসর রঞ্জন করে-তিনি একটি ‘আঙুর’ হাতে নিয়া উপস্থিত!
৩. বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ বলেন, ‘ড. শহীদুল্লাহর মন ছিল চির সবুজ, চির নমনীয়। সনাতন আচার তার মনে কখনো বন্ধন হয়ে দাঁড়ায় নাই। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিজয় অভিযানে তিনি নির্ভীক পতাকাবাহী সৈনিকরূপে অনাগত ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবেন।’
লেখক: এম ফিল গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।