Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

পল্লী অঞ্চলের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন

| প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. ওসমান গনি : দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে দেশের পল্লী অঞ্চলকে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এক দশক আগেও দেশের পল্লী অঞ্চলের যে অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ইতোমধ্যে তা পরিবর্তন হয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলতে পারলে আগামী ১০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান হবে অনেক উন্নত। সরকার পল্লী অঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের দেশজ আয়ের (জিডিপি) ২১ দশমিক ৪১ শতাংশ এসেছে পল্লী অঞ্চলের কৃষি খাত থেকে। মাত্র ৬ বছরের মাথায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান নেমে এসেছে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশে। এক দশকের বেশি সময় ধরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হলেও কৃষিতে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ শতাংশের ঘরে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও শিল্পের সুবাতাস লাগায় কৃষির অবদান কমে এলেও ক্রমেই চাঙ্গা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সুবাদে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে পল্লী অঞ্চল।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫। এর মধ্যে শহর অঞ্চলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২২ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৬টি। আর পল্লী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৯টি। এ হিসাবে মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৭১ দশমিক ৪৮ শতাংশের অবস্থান পল্লী অঞ্চলে। অপরদিকে শহর অঞ্চলে অবস্থান ২৮ দশমিক ৫২ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। পল্লী অঞ্চলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির হার শহরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বলে প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে।
২০০৩ সালে পল্লী অঞ্চলে মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২১ হাজার ৭২৮। ওই সময় মোট প্রতিষ্ঠানের ৬২ দশমিক ৬১ শতাংশ ছিল গ্রামে। আর শহরে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৪২৪। এ সময়ের মধ্যে শহর অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে প্রতি বছর ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পল্লী এলাকায় প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলের এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।
বিদ্যুৎ সুবিধার স¤প্রসারণ ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারনে সা¤প্রতিক সময়ে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে পল্লী অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ সময়ে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিতেও নেয়া হয়েছে ব্যাপক উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের সুফল হাতেনাতে পাওয়া গেছে বলে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। সংস্থার সদর দফতর থেকে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ বসতবাড়ির ২ কিলোমিটারের মধ্যে উন্নত সড়ক ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এর হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। এতে আরও বলা হয়, প্রতিবেশী দেশ নেপালে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ উন্নত সড়কের সুবিধা পাচ্ছে। আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় এর হার মাত্র ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়াসহ অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ উন্নত সড়ক ব্যবস্থার সূচকে এগিয়ে আছে অনেক অনেক দূরে।
শুরু থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষি খাত। তবে স¤প্রতি কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। তার কারন হলো বর্তমান সময়ে দেশের পল্লী অঞ্চলে শিল্পায়নের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষিনির্ভরতা অনেকটাই কমে এসেছে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সুবাদে এখন গ্রাম থেকে সহজেই দেশের যেকোন শহরে পণ্য আনা-নেয়া করা যাচ্ছে।বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ও উন্নত হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি ধরে রাখতে পারলে আগামী দিনগুলোতে শহরমুখী মানুষের শ্রোত কমে আসবে বলেও মনে করেন দেশের বিজ্ঞমহল। পল্লী অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্যতা দূর করতে একাধিক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে সরকার চালু করছে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত। এ খাতে এরই মধ্যে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের সুফল ধরে রাখতে এরই মধ্যে দেশে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গঠন করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স সংগ্রহ করার পর প্রধানমন্ত্রী প্রথম ধাপে ১০০টি শাখা উদ্বোধন করেছেন। অবশিষ্ট ৩৮৫ উপজেলায় শাখা খোলাসহ অন্যান্য যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে।
পল্লী অঞ্চলে শিল্পায়ন উৎসাহিত করতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নতুন করে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর আওতায় আগামী ৫ বছরে দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর ফলে পল্লী অঞ্চলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। গ্রামের মধ্যে শহরের নাগরিক জীবনের স্বাদ পৌঁছানোর লক্ষ্যে পল্লী জনপদ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর আওতায় সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং রংপুর বিভাগে একটি করে মোট সাতটি এলাকায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
পল্লী অঞ্চলে শিল্পায়নে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জমি। এ সমস্যার সমাধানে দেশব্যাপী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব অঞ্চল স্থাপনে প্রাধান্য পাচ্ছে পল্লী অঞ্চল। তাছাড়া দেশের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয় এ মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করেছে। দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি ঝুঁকি কমিয়ে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
দেশের হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এতে ৫৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ঋণ দেবে। এ বিষয়ে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করেছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ জেলার ১২, ময়মনসিংহের ১, নেত্রকোনার ১০, সুনামগঞ্জের ৫, হাবিগঞ্জের ৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক উপজেলায় পানি ব্যবস্থাপনার কাজ হবে।
দারিদ্র্যতা দূর করতে ৯৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্যের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পটির আওতায় ৩৩ হাজার ৬০০ সুবিধাভোগীকে ৬০ দিনব্যাপী কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
কৃষি প্রযুক্তি স¤প্রসারণের মাধ্যমে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে অর্থনীতির গতি আনতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। চর, হাওর ও দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার দরিদ্র কৃষকের সুবিধা দিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৭৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে আদর্শ গ্রাম গঠন করা হবে। কাজ চলবে ২১ জেলার ৮০ উপজেলায়। সরকারের এ উদ্দ্যোগের পাশাপাশি দেশের পল্লী অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বেসরকারি সংস্থা সমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। পল্লী এলাকার উন্নয়নের জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অতি সহজে পল্লী এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যাবে। সাথে সাথে জাতীয় অর্থনীতিরও পরিবর্তন হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলে আমরাও এগিয়ে যাব। পরিবর্তন হয়ে যাবে আমাদের জীবনমানের।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন