Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজপুত কাহিনী

| প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মুজিবুর রহমান মুজিব : ড. ভি. এ. স্মিথের মতে, ‘রাজপুতরা একটি মিশ্র জাতি। তাঁদের কেউ কেউ গুরজর ও হুনদের মত বহিরাগত আক্রমণকারীদের পরবর্তী বংশধর এবং অন্যরা হলো গোন্দা ও ভায়ার মতো প্রাচীন গোত্রগুলির বংশ।’ রাজপুতগণ অবশ্য নিজেদেরকে সগৌরবে সূর্য্যবংশী, চন্দ্রবংশী, অগ্নিবংশী এবং যুগবংশী হিসাবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করেন।
প্রাচীনকালে রাজা প্রতাপসিং রাজস্থানে এসে বসতি স্থাপন করে শতদ্রæ নদীর তীরবর্তী স্থানে বাথিন্দায় দুর্গ নির্মাণ করেন, বাথিন্দাকেই রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। প্রতাপ সিং পেশোয়ার পর্যন্ত দখল করে এক বিশাল সা¤্রাজ্য স্থাপন করেন। দশম শতাব্দী পর্যন্ত রাজপুতগণ সগৌরবে পাঞ্জাব শাসন করেন।
রাজপুত জাতি প্রাচীন ভারতবর্ষের মধ্যযুগ পর্যন্ত একচ্ছত্র রাজশক্তি হিসাবে শান শওকত মান মর্যাদার সঙ্গে রাজ্য শাসন করেন। রাজপুত রাজ শক্তির মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম জাতি ছাড়া কেউ ছিল না। ক্রমাগত মুসলিম অভিযানে রাজপুত রাজাগণের নির্বিবাদে রাজ্য শাসন হুমকির সম্মুখীন হয়। সপ্তম শতাব্দীতে মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ে রাজপুতগণ শংকিত হন। স্বেচ্ছায় ধর্ম্মান্তরিত হতে থাকেন। দশম শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মাহমুদ সতেরো বার উত্তর-পশ্চিমে ভারত আক্রমণ করে রাজপুত রাজাগণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ করে দেন। ১১৯২ সালে গজনীর সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরী দিল্লির সর্বশেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে মধ্য ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।  
প্রাচীন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ছিল বরাবরই উর্বর ভূমি। এই অঞ্চলব্যাপী রাজপুতদের রাজ্যপাঠ-জনবসতি। ভারতবর্ষে বহিরাগত অভিযানকারীগণ ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ভারতে অভিযান চালাতেন। রাজপুতগণকে আরব, মোঙ্গঁল, মুঘল, তুর্কি, আফগান হামলার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্ট্যোনলি উলপার্ট তাঁর New History of India-তে বলেন, The Rajputs were the vanguard of Hindu India in the face of the Islamic an Slaught.
দিল্লি সালতানাতের পরাক্রমশালী শাসক সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির উপর্যুপুরি আক্রমণের সম্মুখীন হন রাজপুত জাতি। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১৩০১ সালে রন থম্বোর, ১৩০৩ সালে চিতোর, ১৩০৫ সালে মান্দু এবং সম্পদশালী হিন্দু রাজ্য দেবগিরি অভিযান করে বিজয়ী হলে রাজপুতদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। ১৫২৬ সালে পানি পথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের লোদী বংশীয় শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে তুর্কী বীর বাবর ভারতে মুঘল সা¤্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। মুঘলদের রাজপুত নীতি ছিল ভিন্ন ধর্মী ও ব্যাতিক্রমী। শক্তি নয় সমঝোতা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে রাজ্য শাসনের নীতি গ্রহণ করেন ভারতের মুঘল সম্রাটগণ। এ ব্যাপারে মুঘল সম্রাট আকবর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আকবর আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেন রাজপুতগণকে। অনেক রাজপুত রাজকন্যা মুঘল হেরেমে মহারানী হিসাবে মুঘল হেরেমকেই শুধু আলোকিত করেননি রাজ্য শাসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আকবর নিজে রাজপুত রাজকন্যা বিয়ে করেছেন। পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীঁরকেও রাজপুত রাজ কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন।
ক্রমাগত মুঘল-মুসলিম অভিযান এবং শিখ-মারাঠা জাতির উত্থানে ক্রমশ শক্তিশালী রাজপুত জাতির শক্তি লোপ পেতে থাকে। আত্মহনন এর মতো অমানবিক, পাশবিক ও পৈশাচিক কর্মকান্ড ‘সাকা’ ও ‘জোয়াহার’ ও রাজপুত জাতিকে বাঁচিয়ে-টিকিয়ে রাখতে পারেনি। রাজপুত পুরুষদের আত্মহনন সাকা এবং মহিলাদের আত্মহনন জোয়াহার নামে অভিহিত হতো। রাজপুতগণ মুসলিম বিদ্বেষী হলেও বিজয়ী মুসলিম শাসকগণ ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক, পরধর্মসহিষ্ণু এবং সংবেদনশীল। সেই দ্বাদশ শতাব্দিতে দিল্লির শেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের তিন লক্ষাধিক সেনাবাহিনীকে হারিয়ে গজনীর সুলতান মোহাম্মদ ঘোরী এবং দিল্লির দাস বংশীয় প্রথম শাসক কুতুব উদ্দিন আইবেকের নমনীয় মনোভাব ও ধর্মীয় সহানুভূতি ও সহনশীলতার প্রমাণ মেলে ‘হিমু দি হিন্দু হিরো অব মেডাইবেল ইন্ডিয়া’য়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, Ghori continued the figures of the goddes Laksmi on his coins, Kutubuddin Aibek allowed the Rajput princess o rule over delhi, ajmir and gwaliar even after to conquest of those regions.
রাজপুত জাতি প্রসঙ্গে সাধারণ্যে স্বচ্ছ ধারণা নেই। এই জাতির মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, শিখও আছেন। একটি তথমতে ১৯৩১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী উপমহাদেশে হিন্দু রাজপুত ছিলেন ৮৬ লক্ষ, মুসলিম রাজপুত ২১ লক্ষ এবং শিখ রাজপুতের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার।
রাজপুতগণ মুঘল আমলে যেমনি আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন ঠিক তেমনি সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন। মুঘল সম্রাটগণ মুসলিম রাজপুতগণকে নবাব, খান, মালিক, চৌধুরী, মির্জা, ইত্যাদি সম্মানসুচক খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। যুগবংশী ধর্মান্তরিত মুসলিম রাজপুতগণ পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে বসবাস করতেন। এরা নামের শেষে জানজুয়া পদবী ধারণ করতেন। পাক সেনা প্রধান আসিফ নেওয়াজ জানজুয়া একজন মুসলিম রাজপুত।
লেখক : সিনিয়র অ্যাডভোকেট, হাই কোর্ট এবং সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব



 

Show all comments
  • মোঃ মেহের উল্লাহ ইমরান ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৩:৩৫ পিএম says : 0
    ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ টপিকস গুলি সহজ ভাবে উপস্থাপন করলে উপকৃত হব। ধন্যবাদ ইনকিলাব কতৃপক্ষ কে।
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাঃ আমিনুল ইসলাম ১ মার্চ, ২০২০, ৪:৩৬ পিএম says : 0
    মুসলিম ইতিহাস ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ুক। এ মহান উদ্দোগকে স্বাগত জানাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন