Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিরাপদে নেই নারী ও কন্যাশিশু

| প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জি. কে. সাদিক : বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পথে-ঘাটে, পরিবহনে, কর্মস্থলে, পার্কে কোথাও নিরাপদে নেই নারী। সর্বত্র তারা লাঞ্চিত-অপমানিত হচ্ছে। গত ২৮ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর থেকে দেশজুড়ে আবার ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যম থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে আর এটা মানতে পারছি না যে, আমরা কোন সভ্য সমাজের জীব। জন্মদিনের পার্টি তাও আবার রাতে হোটেলে। বাসা থেকে রাতে না ফেরার কথা বলে বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার, বিদেশি মদে পার্টি করা, ডিজে পার্টি করা এমন রেওয়াজ-রীতি গত ৫ থেকে ১০ বছর আগেও আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিলো না। আধুনিকতার নামে এসব অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে। আমাদের যুবক-যুবতীদের চরিত্রকে করছে কুলষিত। সমাজ ক্রমেই ভোগবাদী হয়ে উঠছে, নৈতিকতা উপেক্ষিত প্রায়। সামাজিক অবক্ষয় চরমে।    
তনু হত্যা নিয়ে দেশজুড়ে যে আন্দোলন হয়েছে সে রকম আন্দোলন ইতোপূর্বে দেখিনি। সারাদেশের প্রত্যেকটা স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তনু হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে, র‌্যালি হয়েছে, আলোচনাসভা হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে। আজও বিচার হয়নি। হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সর্বত্রই বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে নারীর জীবন। গত ২০ মে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ‘বিশ্ব নিরাপদ নগরী দিবস’ উপলক্ষে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে, রাজধানীর ৫৬ শতাংশ নারী ভালো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ঘরের বাইরে যেতে চান না। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে পরিবহনে উঠতে পারে না ৫৮ শতাংশ নারী। ২২ দশমিক ৫ শতাংশ নারী বাস সহকারী, চালক অথবা সহযোগীর কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হন। ঢাকা শহরের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো নিরাপদ নয় মনে করেন ৪২ শতাংশ নারী। এ চিত্র থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, বর্তমানে গোটা দেশ যেন নারীর জন্য বসবাসের আযোগ্য হয়ে পড়েছে। চর্তুদিকে নারী নির্যাতনের মহোৎসব চলছে। কোন প্রতিকার নেই, নেই কোন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
গত ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরে ৭ বছরের মেয়েকে নিয়ে বাবার ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কতটা বিচারহীনতার সমাজে আমরা আছি। ৭ বছরের একটা শিশু নিরাপদ নয় নরপশুদের হাত থেকে। কতটা নৈতিকতাহীন সমাজের জীব আমরা তা ভাবতেও কষ্ট হয়। ৭ বছরের ধর্ষিতা শিশুর বাবা স্থানীয় ইউপি সদস্যের কাছে বিচার চেয়ে পাননি। শ্রীপুর থানার পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাকে মানসিক ভারসাম্য হীন বলে থানা থেকে বের করে দেয়া হয়। কোথাও বিচার পাননি। তার অপরাধ কী ছিলো? কেন ইউপি সদস্য তার বিচার করলো না? পুলিশ কোন প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে বের করে দিলো? কেন আজও বিচার নিশ্চিত করা হলো না ধর্ষক নরপিশাচের? তবে কী বলব এটা আইন হীনতার রাজ্য। যদি আইন থাকে তাহলে ধর্ষক, ইউপি ও পুলিশের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কী অপরাধ ছিলো সে মেয়েটির ও তার বাবার?
গত ২৯ এপ্রিলের কয়েক দিন আগে রাজধানীতে রাজপথ থেকে এক তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করা হয়। নারায়ণগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এক গার্মেন্টস কর্মী। চালকসহ বাসের প্রায় সব কর্মচারীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় সে গার্মেন্টস কর্মী। সারাদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠে, কিন্তু আজও বিচার নিশ্চিত হয়নি অপরাধীদের। প্রায় প্রতিনিয়ত ধর্ষণের এরূপ ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা যাচ্ছে। চলন্ত বাসে, ট্রেনে, প্রায়ই ঘটছে এমন ঘটনা। ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে সেটা ভাইরাল করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভিডিও ভাইরাল মানে সেটা একটা প্রমাণ আর প্রামণ থাকার পরও বিচার না হলে তো ধর্ষণকারী আর কিছু দিন পরে Youtube চ্যানেলে ধর্ষণের ভিডিও আপলোড করে সেখান থেকে ইনকামের সোর্স বের করবে। কারণ সে নিশ্চিত যে তার বিচার হবে না। আর এমনটাই তো দেখছি। একদিকে কোন বিচার হবে না, অন্যদিকে ধর্ষিতা কোন বিচার চাইতেও পারবে না। কারণ বিচার চাওয়ার কারণে অনেক হতভাগা বাবাকে প্রাণও দিতে হয়েছে। লক্ষীপুরের ঘটনা সবার জানা। মেয়ের ধর্ষণের বিচার দাবি করার কারণে মেয়ের বাবাকে হত্যা করে বখাটে। আর এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ধর্ষণের নগরী বলা হয় দিল্লীকে, এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশকে বলা হবে ধর্ষণের দেশ। গত ২৭ মে একটি দৈনিক পত্রিকাতে দেখলাম যে, মেয়েকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদে বখাটের হাতে বাবা ও মেয়ে আহত হয়েছে। এরকম ঘটনা নিত্যদিনে চিত্র।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬০২ জন নারী ও শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৮ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছ। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৫ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে। ৬০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২৫ জন নারী বিভিন্নভাবে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য মতে গত এপ্রিল মাসে ৪৯ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জন নারী আর ৩২ জন কন্যা শিশু ও এক জনের পরিচয় অজ্ঞাত। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে দেশে ১০ হাজার ১৯৪ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৬ জন, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ১৫৩ জন, হত্যা করা হয় ৫৯০ জনকে।  
গত ২১ মে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সে প্রতিবেদনে কন্যা শিশুর প্রতি নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমতো সচেতন অভিভাবকদের কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়ার মতো। সে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত ১৮, ১৯ ও ২০ মে এই তিন দিনে ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়েছে ১৭ জন। এর মধ্যে ১৩ জনই শিশু। যাদের বয়স ৪ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে বিশেষ করে সংবাদপত্র সমূহে এই রকম শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। দৈনিক সংবাদ পত্রগুলো দেখে একটা হিসাব করেছি যে, প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫টির মতো শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কখনো প্রতিবেশীর কাছে, কখনো আতœীয়ের হাতে, কখনো বা পরিবারের সদস্যের হাতে এমনকি বাবা, ভাইসহ আপন জনদের কাছেও কন্যা শিশু নিরাপদ নয়।
ঢাকা মেডিকেলের ওসিসি ও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের মোট ৮টি ওসিসি সেন্টারে গত ৪ বছরে ২৬ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এদের মধ্যে ৮৫ ভাগই হলো ধর্ষণের শিকার। ঢামেকে গত ৪ বছরে ১ হাজার ৪৯৮ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। যার মধ্যে ২০১৩ সালে ২১৯ জন, ২০১৪ সালে ২৯৭ জন, ২০১৫ সালে ৪৬৯ জন এবং ২০১৬ সালে ৫১৩ জন চিকিৎসা নিয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১৬৩ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে।  
কেন ক্রমাগতভাবে ধর্ষণ বেড়ে চলছে? মনে করি দুটা কারণে ধর্ষণ বেড়ে চলছে এবং এর নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। প্রথমত হলো, নৈতিকতার অভাব বা অবক্ষয়, অন্যটি হলো সুশাসনের অভাব। এই দুটি কারণে ধর্ষণের লাগামহীনতা রোধ করা যাচ্ছে না। অন্য আরো কারণ থাকতে পারে তবে এই দুটাকেই প্রধান হিসেবে মনে করি। মানুষ ভুল করবে বা তার নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটবে। অপরাধ হবে এটাও স্বাভাবিবক। তবে এর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও আইনের শাসন থাকতে হবে। সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্যেই তো আইন।
শিশু পরিবারে যে শিক্ষা লাভ করে, এটা তার বাকী জীবনে প্রভাব ফেলে। যে পরিবারে নৈতিকতা, শালীনতা, শ্লীলতার শিক্ষা নেই সে পরিবারে জন্মগ্রহণ করা শিশুর কাছ থেকে নৈতিক আচরণ পাওয়া অসম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারে তথাকথিত আধুনিকতার নামে, প্রগতিশীলতার নামে ছোট থেকেই শিশুদের চরিত্রকে নৈতিকতাহীন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে সমাজে নৈতিকতা বলে কিছু থাকবে না, কোথাও কেউ নিরাপদে থাকতে পারবে না। বস্তুত নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে আমরা এক ভোগবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে চলছি। আমাদের বুঝতে হবে যে, নৈতিকতাহীন সমাজে সুখে থাকতে পারে না। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে নৈতিক করে তোলে, মানুষকে করে সহনশীল, নারীর প্রতি শ্রদ্ধশীল হতে শিখায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা একেবারেই উপেক্ষিত।
অন্যদিকে আইনের শাসন দেশে নেই বললেই চলে। নৈতিকতা হারিয়ে পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া হয়েছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর নয় লাগাম টানতে। পুলিশ বাহিনী হয়ে পড়েছে প্রভাবশালীদের রক্ষীবাহিনী। সমাজের প্রভাবশালী মহলের কাছে আইন হয়ে পড়েছে অসহায়। প্রভাবশালী মহল আইন, বিচার, শাসন সব কিছুকে প্রভাবিত করছে ক্ষমতার দাপটে। অসহায় ধর্ষিতা বিচার চেয়ে বিচার পাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে ৯৮ শতাংশ ধর্ষণের বিচার হয়নি। ভূয়া মামলার ভিড়ে আর রাজনৈতিক মামলার ভিড়ে ধর্ষণের মামলা মামুলি একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সারাদেশে যখন চলছে ধর্ষণ নিয়ে তোলপাড় ঠিক এমন সময় রাজধানীর অভিযাত এলাকাগুলোতে চলছে টাকার বিনিময়ে ধর্ষণ।
গ্রাম থেকে শহরের হাইপ্রোফাইলের মানুষের চরিত্র হয়ে উঠেছে নারীর প্রতি হিংস্রা, নৈতিকতাহীন। আর সমাজ এগিয়ে চলছে অন্ধাকার গন্তব্যে। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, অবক্ষয় রোধ করতে হবে। অন্যথায় দেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন