Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্টের পরে আউশ ও আমন নিয়ে উৎকন্ঠায় কৃষক

প্রতিক‚ল আবহাওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত নৌযানে দক্ষিণাঞ্চল থেকে মানুষ কর্মস্থলে ফিরছে

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম

আবহাওয়া বিভাগের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস অনুযায়ী স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত নিয়ে আষাঢ়ের প্রথম পনের দিন সহ অতিবর্ষনের জুন মাস অতিক্রান্ত হল দক্ষিণাঞ্চলে। গতমাসে স্বাভাবিক ৪৮৩মিলিমটারের স্থলে বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫১০মিলিমিটার। আবহাওয়া বিভাগ থেকে এসময়ে বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী, ৪৩৫থেকে ৫৩০মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্ভাবাস দেয়া হয়েছিল। তবে ঈদের আগের দিন থেকে পরের দুটি দিন বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে আবহাওয়া মোটামুটি অনুকুল থাকলেও আষাঢ়ী বর্ষন আবার আসছে। আজ সকালের পরবর্তি ৪৮ঘন্টায় বরিশাল ও খুলনা সহ উপক’লীয় এলাকায় ‘বৃষ্টিপাতের প্রবনতা বাড়তে পারে’ বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। পাশাপশি ঈদে কর্মস্থলমুখি ভীড়ে ঠাশা বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো নদী বন্দরকে ১নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে অস্থায়ী দমকা হাওয়া সহ হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টিপাতের সম্ভবনার কথাও বলেছে আবহাওয়া বিভাগ।
ঈদের পরে গত বুধবার থেকেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্বম বরিশাল নদী বন্দর সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলমুখি যাত্রীর ভীড় ক্রমশ বাড়ছে। আবহাওয়া কিছুটা বিরূপ থাকার মধ্যেই গতকাল বরিশাল নদী বন্দরে জন¯্রােত অনেকটাই ঢলে রূপ নেয়। ১৮টি বেসরকারী যাত্রীবাহী নৌযানের সাথে একটি ক্যাটামেরন বরিশালÑঢাকা রুটে এবং বিআইডবিøউটিসি’র দুটি নৌযান চাঁদপুর হয়ে ঢাকায় গেছে। বরিশাল বন্দর থেকে এসব নৌযানে প্রায় ৩০হাজার যাত্রী আরোহন করে। বৈরী অবহাওয়ার মধ্যেও বেশীরভাগ নৌযানেই ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। বিআইডবিøউটিএ আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় নৌযানগুলোতে ওভারলোডিং বন্ধে তৎপড় থাকলেও জনশ্রোত সামাল দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে এবার পর্যাপ্ত নৌযান থাকায় ‘পরিস্থিতি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় যথেষ্ঠ অনুকুল’ বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল।
এদিকে লঘুচাপের বর্ধিতাংশ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকা অতিক্রম করে বিহার থেকে উত্তরÑপূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে বলে আবহাওয়া বিভাগ থেকে বলা হয়েছে। মওশুমী বায়ু সারা দেশে মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারী অবস্থায় রয়েছে বলেও জানান হয়েছে। আজ সকালের পরবর্তি ৪৮ঘন্টায় বরিশাল সহ সারা দেশেই বৃষ্টিপাতের প্রবনতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। আষাঢ়ের প্রথমপক্ষসহ জুন মাসটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হলেও তাপমাত্রার পারদও মাস যুড়েই ছিল স্বাভাবিকের ওপরে। গতকালও হালকা থেকে মাঝারী বর্ষনের মধ্যে বরিশালে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৩ডিগ্রী সেলসিয়াস।
গত মার্চ ও এপ্রিলে বরিশালে স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ১৫২% ও ১৬০%-এর মত বেশী বৃষ্টিপাত হলেও মে মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৫.৯% কম । গতমাসে স্বাভাবিক ৪৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা জানিয়ে আবহাওয়া বিভাগ থেকে ৪৩৫থেকে ৫৩০মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্ভাবাস দেয়া হলেও তা অতিক্রম করে। গত ২১জুন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বরিশাল মহানগরীতে প্রায় ১২০মিলিমিটার রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। ঐদিন সন্ধা ৬টার পূর্ববর্তি ২৪ঘন্টায় বরিশালে দেশের সর্বোচ্চ ১৪৪মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যা ছিল বরিশালে সা¤প্রতিককালের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। ১৯জুন দুপুরেও মহানগরীতে মাত্র আড়াই ঘন্টায় ৫৮মিলিমিটারের মত বৃষ্টি হয়েছিল। গত ফেব্রæয়ারী, মার্চ ও এপ্রিলের অতিবর্ষনে এবার দক্ষিণাঞ্চলে গোল আলু, তরমুজ,মুগডাল, মিষ্টি আলু সহ সবজির ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় হাজার কোটি টাকা।
কৃষি স¤প্রসারন অধিদফ্তরের মতেই মার্চের বর্ষনে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা। ভোলাতে এক গোল আলু চাষি নিজের জমির ভয়াবহ ক্ষতি সহ্য করতে না পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মার্চের ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই গত ২০থেকে ২৪এপ্রিল প্রায় ৩৩০মিলিমিটার বর্ষনে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি সেক্টরে আরো ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে এসময়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠীর মাঠে থাকা প্রায় সাড়ে ৩লাখ হেক্টর জমির ফসলের মধ্যে ১লাখ ৪২হাজার হেক্টর প্লাবিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ১লাখ ৪১হাজার হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ। ডিএইর হিসেব অনুযায়ী এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৪২হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যা মোট ফসলী জমির প্রায় ১২%। এহিসেবে এবারের অতিবর্ষনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ১লাখ ১৫হাজার টন ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এপ্রিলের বিপর্যয়ে মিষ্টি আলুর অবস্থানই ছিল শীর্ষে। ঐ বর্ষনে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ২৯হাজার টন মিষ্টি আলুর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর পরেই অবস্থান শাক-সবজির। এবারে ২৪হাজার টন শাক-সবজির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয় দক্ষিনাঞ্চলে। এছাড়া প্রায় ১৯হাজার টন মুগডাল, ১৬হাজার টন মরিচ, দেড় হাজার টন তিল, সারে ৫হাজার টন সয়াবিন ও প্রায় ৭হাজার টন চিনাবাদামের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেড়শ টনের মত সূর্যমূখী উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
তবে মার্চ ও এপ্রিলে দুদফার বর্ষনে প্রায় দেড় লাখ টন তরমুজের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয় দক্ষিণাঞ্চলে। এর মধ্যে গত এপ্রিলের অতিবর্ষনে তরমুজের উৎপাদন ক্ষতির পরিমান প্রায় সাড়ে ৭হাজার টন। এছাড়া প্রায় ৫শ টন বোরা ও ৪হাজার টন স্থানীয় ও উফশী আউশ ধানের উৎপাদন ক্ষতি হয়। শুধুমাত্র তেল বীজের উপদান ক্ষতির পরিমানই ছিল প্রায় ১৫হাজার টন। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রতিবছর উৎপাদিত বিপুল পরিমান সয়াবিন তেল বীজ দেশের বিভিন্ন পোল্ট্রী ফিড-এর পুষ্টিকর খাবার উপাদান হিসেব ব্যবহ্রত হয়।
গত এপ্রিলে দ্বিতীয় দফার অতিবর্ষনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে ভোলাতে প্রায় ৭৭হাজার হেক্টর, পটুয়াখালীতে প্রায় ৩৫হাজার হেক্টর, বরগুনাতে পনের হাজার হেক্টর, বরিশালে প্রায় ২০হাজার হেক্টর, পিরোজপুরে ২৭০হেক্টর এবং ঝালকাঠীতে প্রায় ৩হাজার হেক্টর জমির ফসল কমবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আষাঢ়ী বর্ষনের পরে শ্রাবন ধারা দক্ষিণাঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ সহ কৃষি ব্যবস্থার জন্য কতটুকু সহায়ক হয় তা এখন দেখার বিষয়। এবার দক্ষিণাঞ্চলে সংশোধীত লক্ষমাত্রা অনুযায়ী প্রায় ২লাখ ১০হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়েছে। যা এখন মাঠে রয়েছে। এছাড়া আসন্ন খরিপÑ২ মওশুমে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৭লাখ হেক্টর জমিতে প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমন আবাদের লক্ষে বীজতলা তৈরী করছে কৃষকগন। যা থেকে প্রায় ১৬লাখ টন চাল পাবার লক্ষ স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এবারের দফায় দফায় অতিবর্ষন বিগত রবি মওশুমের মত আউশ ও আমন উৎপাদন পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদদের মধ্যেও।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ