Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রামের প্রবাসীরাই ‘অর্থমন্ত্রী’

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ঈদ-রমজানে অগণিত পরিবারে আনন্দ ওদের কষ্টার্জিত আয়ে : অর্থনীতি সচলে অবদান ব্যাপক
শফিউল আলম
সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীর গ্রাম হচ্ছে হাটহাজারীর শিকারপুর নজুমিয়া হাট। গ্রামটিতে আটটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় গত এপ্রিল-মে থেকে জুনে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে শুধুমাত্র প্রবাসীদের পরিবার-পরিজনের কাছে পাঠানো অর্থ তথা রেমিটেন্স বাবদ। আর এই বিপুল অঙ্কের লেনদেন পবিত্র রমজান মাস ও ঈদকে ঘিরে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের সূত্রে একথা জানা যায়। একই ভাবে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ঈদ বাজার ও পুরো রোজায় অগণিত পরিবারে চলছে ভরণ-পোষণ। এর পাশাপাশি ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির মতো সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণ করছে অনেকখানি। প্রবাসী লাখ লাখ চট্টগ্রামের সন্তান তাদের কষ্টার্জিত আয়ের যে সিংহভাগ স্বদেশে পরিবারবর্গের কাছে পাঠাচ্ছেন সেই অর্থের প্রবাহ রক্ত সঞ্চালন করে প্রবাসী-পরিবারের বাইরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। যেমন- আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-দুস্থজনদের কষ্টের ভার লাঘব, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, জনহিতকর কাজসহ অনেক ক্ষেত্রেই।
সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকেই চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে ‘দুবাই ওয়ালাদের এলাকা’। আর সা¤প্রতিককালে চাটগাঁর লোকমুখে বিশেষত প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে প্রচলিত কথায় আছে, প্রবাসীরাই ‘অর্থমন্ত্রী’। তাদের আয়-রোজগারের উপর নির্ভর করে অসংখ্য পরিবার। ঘরে ঘরে কিছুটা হলেও স্বচ্ছন্দে জীবনযাপনের জন্য শ্রম-ঘামের অর্থ তারা অকাতরে জোগান দিয়ে থাকেন। অনেক প্রবাসী মাহে রমজান ও ঈদ পরিবার-পরিজনের সাথে কাটানোর জন্য দেশের বাড়িঘরে এসে গেছেন এবং এখনো আসছেন। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে এ সময়ে আসা বিমান যাত্রীদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ঈদে ছুটে আসছেন। যদিও প্রবাসীরা বিমানবন্দরে নাজেহাল হওয়াই যেন ‘নিয়ম’। প্রবাসীদের মাধ্যমে অনেক হতদরিদ্র পরিবারে অর্থের প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ছে। রোজার মাসে যাকাত আদায় করার উত্তম। প্রবাসীদের দেয়া যাকাতের অর্থ যাচ্ছে সমাজের অভাবী-বঞ্চিতদের হাতে। অনেক প্রবাসী ঈদ ও রোজায় দেশে আসতে না পারলেও যাকাত, দান-খয়রাতের জন্য পারিবারিক বাজেটের পৃথক বরাদ্দটা ঠিকই পাঠিয়ে দেন। এতে করে সমাজের বিত্তবান ও মধ্য, নি¤œ-বিত্তশ্রেণির অর্থ প্রবাহ চলে যাচ্ছে হতদরিদ্রদের কাছে। শুধুই তাই নয়; চট্টগ্রাম নগরীতে ঈদ বাজারে মার্কেট, শপিংমলগুলোতে বেচাকেনায় গতি সঞ্চার করে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের আয়-উপার্জন চট্টগ্রামের অর্থনীতির চাবিকাঠি। বলা যায় চালিকাশক্তি। প্রবাসীদের মেধা, শ্রম-ঘামের বিনিময়ে দেশে আসছে হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স। তাই বলা হয়Ñ ‘প্রবাসীদের টাকা, ঘুরছে দেশের চাকা’। চট্টগ্রামে বন্দরভিত্তিক কর্মকাÐ, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরই প্রবাসীদের আয়ের অবস্থান সবচেয়ে বড়। সউদী আরবসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে সিংহভাগই বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোক। যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ লাখ। চট্টগ্রাম আর মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে যুগ যুগ ধরে সেতুবন্ধন রচনা করে আসছেন চাটগাঁর লাখ লাখ প্রবাসী। কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়; ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, মালয়েশিয়াসহ দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকায় হরেক কর্মক্ষেত্রে থাকা বাংলাদেশীদের উল্লেখযোগ্য চাটগাঁর সন্তান।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী অঞ্চলের বাসিন্দারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, মিরসরাই এবং মহানগরীর বিশেষত পতেঙ্গা, হালিশহর, চান্দগাঁও, বাকলিয়া এলাকার লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে বেশি সংখ্যক কর্মরত। আবার স›দ্বীপের অনেকে থাকেন আমেরিকায়। সউদী আরবের রিয়াদ, মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, জেদ্দা, তায়েফ, দাম্মাম থেকে শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ, আবুধাবী, মস্কট, আল-আইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি শহর-নগর অথবা উপশহরে বাংলাদেশী প্রবাসী চট্টগ্রামের লোকজন গত ৬০ বছরেরও বেশিকাল যাবৎ পাড়ি জমিয়েছেন। আত্মীয়-প্রতিবেশীর হাত ধরে তারা পাড়ি দেন। সেখানে কর্মদক্ষতার সাথে নিজেদের বলিষ্ঠ অবস্থান জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন। আরব দেশসমূহে ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা খাতসহ সরকারি-বেসরকারি চাকরি ছাড়াও সা¤প্রতিককালে তেল ও গ্যাস খাত, রাসায়নিক শিল্পকারখানা, ফ্যাশন ওয়্যার, পরিবহন খাত, নির্মাণ শিল্প, নগরায়ন, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি-খামার শিল্পখাতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা তথা চট্টগ্রামের নাগরিকগণ সাফল্য ও সততার স্বাক্ষর রেখে আসছেন। তবে সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে এখন দুর্দিন চলছে।
তবে এর পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আধুনিক নজরকাড়া উপশহর গড়ে তোলার মতো দুরূহ কাজে পারদর্শিতা ও প্রশংসা কুড়িয়ে আসেন চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী অধ্যাপক এম আলী আশরাফ, সউদী আরবে নামীদামী হাসপাতালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ আবুল কালাম, রিয়াদে অধ্যাপনায় মোঃ শওকত হোসেন। এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে প্রচুর।
প্রবাসীদের জোগানো অর্থে বৃহত্তর চট্টগ্রামে গত চার দশকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি-খামার। অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা-মক্তব, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, এতিমখানা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেবাধর্মী ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ জনকল্যাণমূলক কাজে প্রবাসীদের অবদান রয়েছে ব্যাপক বিস্তৃত। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাÐকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রবাসীরাই রক্ত সঞ্চালন করে চলেছেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে চাটগাঁর বেশ কয়েকজন প্রবাসী আলাপচারিতায় জানান, শত সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা ঈদ ও রমজানে দেশের বাড়িঘরে পরিবারবর্গের কাছে অর্থ প্রেরণ করে আসছেন। যা তাদের সারাবছরের আয়ের সিংহভাগ। শুধু পরিবার নয়; গরিব আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-পড়শীদের কিছুটা হলেও স্বস্তির সাথে ঈদ রোজা পালনে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের কথা তারা কখনও ভুলে যান না।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ