Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজানে বায়তুল্লাহ প্রতিমামুক্ত হয়

| প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


কে. এস সিদ্দিকী
(১৬ জুন প্রকাশিতের পর)
২০ রমজান মক্কা বিজিত হওয়ার দ্বিতীয় দিন রাসুলুল্লাহ (স.) ছাফা পর্বতে দাঁড়িয়ে এই খোতবা প্রদান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর হামদ-ছানা বর্ণনা করেন এবং বলেন, হে লোক সকল! আল্লাহ মক্কাকে আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন মর্যাদাবান করেছেন। এ স্থান আল্লাহ কর্তৃক হেরম বানানোর ফলে হেরম হয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত হেরম হিসেবেই থাকবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামতে ঈমান আনবে তার পক্ষে এখানে রক্তপাত করা জায়েয নয় অথবা এখানে বৃক্ষ কর্তন করা। যদি কোনো ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)এর কারণে এখানে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয় তাহলে তাকে বলে দাও যে, আল্লাহতাআলা কেবলমাত্র তার রাসূলুল্লাহ (স.)কে অনুমতি দিয়েছিলেন। আল্লাহ তোমাদেরকে অনুমতি দেননি। আমার জন্য দিনের একটি অংশে এখানে যুদ্ধ হালাল করা হয়েছে কিন্তু আজ আবার তার হুরমত (মর্যাদা) পূর্বমত কায়েম হয়ে গিয়েছে এবং যারা এই সময় উপস্থিত আছে, তাদের উচিত এ খবর অনুপস্থিতদের পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া।
এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের পর রাসুলুল্লাহ (স.) মক্কার আশেপাশের এলাকাগুলোকে প্রতিমামুক্ত করতে মনোনিবেশ করেন। আল্লাহর ঘর খানাই-কাবা প্রতিমামুক্ত হওয়ায় আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত প্রতিমাগুলো শিরকের নিদর্শন বা প্রতীক হিসেবে কায়েম থাকতে পারে না। এজন্য তিনি বিষয়টি গুরুত্ববহ মনে করে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর দূরদর্শী এ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মক্কার বাইরে যেসব প্রধান প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেগুলোর ধ্বংস সাধন করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল লাত, মানাত এবং উযযার প্রতিমা। কোরআনে একই আয়াতে এ তিনটি মূর্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, লাত ও উযযা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে’ (সূরা আন-নাজম, আয়াত (১৯-২০)।
তফসীরে কুরতুবীর বরাতে তফসীরে মাআরেফুল কোরআনে বলা হয়েছে, আরবের মুশরিকরা অসংখ্য প্রতিমার পূজা করত, তন্মধ্যে তিনটি প্রতিমা ছিল সমধিক প্রসিদ্ধ। আরবের বড় বড় গোত্র এগুলোর এবাদতে আত্মনিয়োগ করেছিল। এসব প্রতিমার অবস্থান স্থলে মুশরিকরা বড় বড় জাঁকজমক পূর্ণ গৃহ নির্মাণ করে রেখেছিল। এসব গৃহকে কাবার অনুরূপ মর্যাদা দান করা হত। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (স.)এসব গৃহ ভূমিস্মাৎ করেদেন।
সীরাত লেখকদের মতে, মানাত-উযযা ধ্বংস করার জন্য হুজুর (স.) কয়েকজনকে প্রেরণ করেন। হুজুর (স.)এর আহ্বানকারী সমগ্র মক্কায় ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামতে বিশ্বাস করে, সে নিজের গৃহসমূহে কোনো মূর্তি রাখতে পারবে না। নাখলা নামক স্থানে আরবের নামিদামি বিখ্যাত মূর্তি উযযার প্রতিমা ঘর ছিল। যখন রমজানের পাঁচদিন বাকি ছিল তখন তিনি হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) কে তিরিশজন আরোহী সমেত সেখানে প্রেরণ করেন। তিনি তা ধ্বংস করে প্রত্যাবর্তন করলে হুজুর (স.) জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা সেখানে কিছু দেখছ কি? খালেদ (রা.) বললেন, না। হুজুর (স.) বললেন, তবে তো তা ধ্বংস হয়নি। যাও তা আবার ধ্বংস করে এসো। হজরত খালেদ (রা.) ক্ষোভে রাগে তার তরবারি হাতে নিয়ে আবার যান। তখন দেখতে পান এক কৃষ্ণবর্ণের উলঙ্গ বিক্ষিপ্ত কেশধারী এক নারী বের হয়ে এসেছে এবং পূজাঘরের সেবক চিৎকার করছে। হজরত খালেদ সেই নারীকে হত্যা করেন। অতঃপর হুজুর (স.)কে জানান, তিনি বললেন, হ্যাঁ, এটি উযযা ছিল এবং তারপর তোমাদের দেশে এর পূজা হবে না। এ উযযা কোরেশ এবং সকল বনি কেনানার সর্বাধিক বড় মূর্তি ছিল এবং বনি শায়বান ছিল তার প্রধান সেবক।
মানাত ছিল আওস, খাজরাজ এবং গাসসান প্রভৃতি গোত্রের প্রসিদ্ধ মূর্তি। তার মূর্তিঘর ছিল কাদীদ নামক স্থানে। সেখানে হুজুর (স.) সা’দ ইবনে জায়েদ আশহালীকে প্রেরণ করেন এবং তার সঙ্গে গমন করেন ত্রিশজন আরোহী। সেখানকার সেবক জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কি চাও? তাঁরা বললেন, আমরা মানাত ধ্বংস করতে এসেছি। সে বলল, তোমরা এবং মানাত জানে। সা’দ তা ধ্বংস করার জন্য যখন অগ্রসর হন, তখন বিক্ষিপ্ত কেশধারী এক নারী বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বের হয়। সেবক বলল, মানাত? এরা তোর নাফরমান বান্দা। সা’দ (রা.) অগ্রসর হয়ে সেই নারীকে হত্যা করেন। অতঃপর তার মূর্তি ঘর ধ্বংস করেন এবং গুদাম ঘর ভেঙ্গে দেন, কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। কোরআনে বর্ণিত তিনটি মূর্তির এ করুণ পরিণতি পূজারীদের আশা ভঙ্গ করে।
হোজাইল গোত্রের বিখ্যাত মূর্তিটির নাম ছিল সোয়া। তা ধ্বংস করার জন্য হুজুর (স.) আমর ইবনে আছ (রা.)কে প্রেরণ করেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছান, তখন তার সেবক বলল, কি উদ্দেশ্যে এসেছ? তিনি বললেন, আমাদের রাসূলুল্লাহ (স.) প্রেরণ করেছেন এটি ধ্বংস করতে। সেবক বলল, এ কাজ তোমরা করতে পারবে না। তিনি বললেন, কেন? সে বলল তা এই মূর্তিই প্রতিহত করবে, তিনি বললেন, তুমি কি এখনো বাতিলের ওপর রয়েছো, পরিতাপের বিষয়। সে কি কিছু দেখতে শুনতে পায়? অতঃপর তিনি তার নিকটবর্তী হন এবং ধ্বংস করে দেন।
এভাবে খানাই-কাবার পর উহার আশে পাশের এলাকাগুলো ২৫ রমজানের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রতিমামুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০ রমজান মক্কা বিজিত হওয়ার পর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় এ মহাবিজয় সুচিত হয়।
‘সোয়া’ মূর্তির কথা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। হোজাইল গোত্রের এ মূর্তি ইয়াম্বু এর আশে পাশে রাহাত নামক স্থানে ছিল। এটি একখানা পাথর। বনু লিহিয়ান ছিল এর মোতাওয়াল্লী বা দেখভালকারী। সূরা নূহ এ- আরো কয়েকটি মূর্তির নামের সাথে সোয়া-এর নামও উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ মোশরেক কাফেরদের উক্তি উদ্ধৃতি করে বলেন, ‘তারা বলেছে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করোনো ওয়াদ, সোয়া, ইয়াগু, ইয়াউক ও নসরকে।’ (আয়াত: ২৩) আয়াতে উল্লেখিত পাঁচটি প্রতিমা সম্পর্কে তফসীরবিদগণ বলেন, এই পাঁচজন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাআলার নেক ও সৎপরায়ন বান্দা ছিলেন। তাদের সময়কাল ছিল হযরত আদম (আ.) ও নূহ (আ.) এর আমলের মাঝামাঝি। তাদের নেক-ভক্ত ও অনুসারী ছিল। তাদের ওফাতের পর ভক্তরা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলার এবাদত ও বিধিবিধানের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখে। কিছুদিন পর শয়তান তাদের এই বলে প্রতারিত করে, তোমরা যেসব মহাপুরুষদের পদাঙ্ক  অনুসরণ করে উপাসনা কর, যদি তাদের মূর্তি তৈরি করে সামনে রেখে লও, তবে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। তারা শয়তানের ধোকা বোঝতে না পেরে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করে উপাসনালয়ে স্থাপন করলো এবং তাদের স্মৃতি জাগরিত এবাদতে বিশেষ পুলক অনুভব করতে লাগলো। এমতাবস্থায় তাদের সবাই একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেল এবং সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজন্ম তাদের স্থলাভিষিক্ত হল। এবার শয়তান এসে তাদের বোঝাল, তোমাদের পূর্বপুরুষদের খোদা ও উপাস্য মূর্তিই ছিল। তারা এইমূর্তিগুলোরই উপাসনা করত। এখান থেকে প্রতিমা পূজার সূচনা হয়ে যায়। উপরোক্ত পাঁচটি মূর্তির মাহাত্ম্য তাদের অন্তরে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত ছিল বিধায় পারস্পারিক চুক্তিতে তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (মাআরেফ)
আমরা ‘হোবলের’ কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য নিম্নরূপ :
সীরাত লেখকদের বর্ণনা অনুযায়ী কাবার ছাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘হোবল’ ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিমা, কোরেশরা যুদ্ধসমূহে তার জয়ধ্বনি করতো। তারা একে খোদা-ই আজম বা মহান খোদা বলে বিশ্বাস করতো। মানুষ আকৃতির এবং ইয়াকুত পাথর নির্মিত এ প্রতিমা সর্বপ্রথম কাবায় এনে স্থাপন করেছিল মোয়ারের গোত্র ও আদনানের প্রপৌত্র খোজায়মা ইবনে মোদারিকা। হোবলের সামনে সাতটি তীর থাকতো, সেগুলোতে লেখা থাকতো ‘লা’ (না) এবং ‘নাআম’ (হ্যাঁ)। আরবরা যখন কোনো কিছু করতে চাইতো তখন ঐসব তীরে লটারি নিক্ষেপ করতো। হ্যাঁ, অথবা না যা কিছু আসতো, সেই অনুযায়ী কাজ করতো। ওহুদ যুদ্ধে আবু সুফিয়ান উলু হোবল বলে জয় ধ্বনি করেছিলেন। এই উলু হোবল হতে হিন্দুদের উলু ধ্বনির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) মক্কা বিজয়ের দিন কাবায় প্রবেশ করে হোবল প্রতিমা ধ্বংস করেন।
উল্লেখ্য, আরবে মূর্তি পূজার প্রবর্তক ছিল আমর ইবনে লুহাই। তার প্রকৃত নাম রাবীয়া ইবনে হারেছা। সে আরবের প্রসিদ্ধ খোজাআ গোত্রের লোক ছিল। আমরের পূর্বে জুরহুম গোত্র ছিল কাবার মোতাওয়াল্লী। আমর লড়াই করে জুরহুমকে মক্কা হতে বিতাড়িত করে দেয় এবং নিজেই হেরমের মোতাওয়াল্লী হয়ে বসে। সে একবার সিরিয়ায় কোনো এক শহরে গমন করে এবং সেখানে লোকদের মূর্তি পূজা করতে দেখে এবং জিজ্ঞাসা করে, কেন ওদের পূজা করে? তারা বলে, এগুলো অভাব দূরকারী, যুদ্ধবিগ্রহে বিজয় দানকারী এবং খরা-দুর্ভিক্ষে পানি বর্ষণকারী। আমর তাদের কাছ থেকে কয়েকটি মূর্তি নিয়ে আসে এবং কাবার আশেপাশে স্থাপন করে। কাবা যেহেতু আরবের কেন্দ্র ছিল, তাই সকল গোত্রে মূর্তি পূজার প্রচলন হয়ে যায়। আর সেখান থেকে নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
আরব হতে মূর্তি পূজা ছড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, আরব গোত্রগুলো, যারা সমগ্র দিক হতে হজ্বের উদ্দেশ্যে এসে প্রত্যাবর্তন করতো, তারা হেরমের পাথরগুলো উঠিয়ে নিয়ে যেতো এবং সেগুলো কাবার প্রতিমা সমূহের আকৃতিতে নির্মাণ করতো এবং পূজা করতো।
(সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন