ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ফাহমিদা হোসেন : গত বছরের জুলাই মাসের ১ তারিখের ঘটনা। কাজের শেষে গাড়িতে উঠবো, এমন সময় দেখি এলাকার একটা দোকানে ফোর্থ অফ জুলাই, অর্থাৎ ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে-র জন্য অনেক জিনিস সাপ্লাই এসেছে। ক্রেট ভর্তি জিনিসপত্র বেইসমেন্টের গুদাম ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য এক অভিনব পন্থা ব্যবহৃত হচ্ছে দেখে আমি থামলাম। তাদের পরিচিতি গোপন রাখার জন্য উপরের এবং নীচের ঘরের কারো চেহারা ভিডিও বা ছবিতে ধারণ করবো না, এই শর্তে সেই দুই ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে আমি কিছু ছবি তুললাম এবং সাথে ছোট্ট একটা ভিডিও করে ফেললাম। সেই ভিডিও আপলোড করে এই লেখার কমেন্ট সেকশনে অ্যাড করে দিলাম।
খুব আহামরি কিছু না হলেও বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ না! একটা ঢালু তলের মধ্যে কয়েকটা সারিতে অনেকগুলা ছোট ধাতব চাকা লাগানো আছে। অতএব, উপর থেকে এক ক্রেট করে পানির বোতল ছেড়ে দিলে খুব দ্রæত সেটা দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রতি ক্রেটের পিছনে বড়জোর ১০ সেকেন্ড সময় ব্যয় হওয়ায় ঐ ২ ব্যক্তি মিলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ৫০ ক্রেট পানি নামিয়ে ফেললো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রতি ক্রেটে ৫০০ মি.লি.-র ২৪টা করে বোতল থাকে। সুতরাং ১টা ক্রেটের ওজন কিন্তু নিতান্ত কম না! আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার মনে হলেও আমার কাছে এর তাৎপর্য অনেকখানি। আনুমানিক ২০০২ সালে ২/৩ বছরের জন্য আমার নিজেরও একটা গ্রোসারি স্টোর ছিলো। সেখানে আমি নিজেও এইরকম পানি এবং পানীয়ের আনলোডিং-এর কাজ করেছি। প্রচÐ খাটনির কাজ! এই বুদ্ধিটা তখন জানা থাকলে অতটা কষ্ট হতো না। ফুলটাইম কাজ এবং সংসার সামাল দিয়ে আবার এতো পরিশ্রম করে পড়তা পড়েনি বলে শেষমেশ সেই দোকানের স্বত্ব বিক্রি করে দিই। হ্যাঁ, জীবনে আমার এইরকম বহু উদ্ভট অভিজ্ঞতা আছে।
যাই হোক, পদার্থবিজ্ঞানের মূল সূত্র কাজে লাগিয়ে দৈনন্দিন কাজের সুরাহা করা পশ্চিমা দেশে কোন ব্যাপার না। আমার উপস্থাপিত উদাহরণের খুব সাদামাটা রকমের ব্যাখ্যা দিলে হবে এমন জিনিসের ভর [ওজন] এবং নির্দিষ্ট ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে স্থাপিত ঢালু সমতলের সাথে চাকাগুলার রোটেশন্যাল ফোর্সের মাধ্যমে ভেলোসিটি/মোমেন্টাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে যেন মুহূর্তের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, শুধুমাত্র আমাদের দেশেই পুঁথিগত বিদ্যা আর বাস্তবসম্মত বুদ্ধির মধ্যে যোগসূত্রতা স্থাপন করা শিখানো হয় না বলেই আমরা জানি না কীভাবে একটা বিরাট সমস্যার সহজ সমাধান বের করতে হবে। একই কারণে ২ আর ২ মিলে যে ৪ হবে, সেই উপলব্ধিটুকুও আমাদের মধ্যে কাজ করে না। তাই কখনওবা নিজের অজান্তেই অনেক উন্নতমানের প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ফেলি, কিন্তু সেই প্রয়োগের পিছনে আসল যুক্তি কি সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার মত ক্ষমতা রাখি না।
আজকে আমার মূল বক্তব্যে উপনীত হওয়ার আগে ছোট্ট অথচ খুবই সাধারণ কৌতুকের কথা দিয়ে শুরু করছি। দন্তচিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রায়ই দু’টা কৌতুক ব্যবহৃত হয়; যার প্রথমটা হলো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে একজন দন্তচিকিৎসকের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করা হাস্যকর ব্যাপার। এই কথার সাথে আমি নিজে কিছুটা হলেও একমত। এর কারণ হলো যে, অধিকাংশ দন্তচিকিৎসকের পেশার যে প্রয়োজনীয়তা, তার মধ্যে দৈনন্দিনভাবে স্টেথোস্কোপের ব্যবহার অনেক কম। সেই কারণেই স্টেথোস্কোপ আর দন্তচিকিৎসককে একসাথে দেখলে হাসির উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবে হাস্যরসের আসল কারণ সেটা হলে কথা ছিলো না। সবার ধারণা যে আমরা মনে হয় স্টেথোস্কোপ কাকে বলে তা-ই জানি না। কিন্তু কথাটা কি আসলেই সত্যি? জনসাধারণের ধারণা যে, দন্তচিকিৎসকরা জীবনেও স্টেথোস্কোপ হাতে লাগিয়ে দেখে না। সুতরাং, তারা মেডিক্যাল চিকিৎসক সাজার বৃথা চেষ্টায় টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে খড়কুটোর মত স্টেথোস্কোপ আঁকড়ে ধরে। ভ্রান্তি সেখানেই! আমাদেরকেও কিন্তু অ্যানাটমি, এম্ব্রায়োলজি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলজি, মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি বিষয়ে মেডিক্যালের মতই আদ্যোপান্ত পড়াশুনা করে ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। মেডিসিন আর সার্জারির রোটেশনের সময় আমাদেরও ‘স্টেথোস্কোপ সহকারে’ একই রোগীর পাল্স দেখে পরীক্ষা পাস করা লাগে। মজার ব্যাপার হলো, এই কথাটা কিন্তু চিকিৎসকরাও জানেন। কিন্তু কৌতুক করার সুযোগ পেলে কি আর ছাড়তে ইচ্ছা করে? আর সত্য কথা সহজেই প্রকাশ বা স্বীকার করে ফেললে তো পেশাগতভাবে তাদের সেই সামাজিক উচ্চমর্যাদা থাকবে না! তবে আমি অস্বীকার করবো না যে, পেশার প্রয়োগের প্রাধান্যের উপর ভিত্তি করে কিছু বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে পড়ানো হয় বা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যেমন গাইনোকলজি! কিন্তু আসলেই কি আমরা কম পড়াশুনা করি? সেই আলাপে আসছি পরে।
অধিকাংশ দন্তচিকিৎসকের বি.ডি.এস. ডিগ্রি অর্জনের পর পেশার যে প্রয়োজনীয়তা, তার মধ্যে কোন ফিলিং করার আগে বা দাঁত তোলার আগে বøাড প্রেসার চেক করা ছাড়া স্টেথোস্কোপের ব্যবহার নগণ্য। সেটা কিন্তু এম.বি.বি.এস. ডিগ্রি অর্জনের পর একজন মেডিক্যাল চিকিৎসকেরও কর্মজীবনের দায়িত্বের উপর নির্ভর করে। এই ব্যাপারে আমার ২টা তুচ্ছ প্রশ্ন থাকবে:
১. একজন রেডিওলজিস্ট এক্স-রে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কীভাবে স্টেথোস্কোপ ইস্তেমাল করেন সেটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলবেন?
২. একজন প্যাথলজিস্ট বা হিস্টোপ্যাথলজিস্ট অথবা মাইক্রোবায়োলজিস্টও কবে স্টেথোস্কোপ দিয়ে বায়োপ্সি করেছেন বা ¯øাইড পরীক্ষা করেছেন, সেই ব্যাখ্যা কি দয়া করে আমাকে দিবেন?
জানি, এর কোন সদুত্তর কোন চিকিৎসক দিতে পারবেন না। এর কারণ হলো যে চিকিৎসক হয়েও উল্লিখিত সেই পেশাজীবীরা স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করেন না। বাস্তবে এম.বি.বি.এস. ডিগ্রি অর্জনের পর তারাও স্টেথোস্কোপ সিকায় তুলে রাখেন। আসলে সবকিছুই নির্ভর করে ডিগ্রি অর্জনের পর সেটার নিয়মিত প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে অথবা দৈনন্দিন কাজে কোন যন্ত্রপাতি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, তার উপর। পড়াশুনার চর্চা না থাকলে সাফল্যের সাথে পাস করলেও পরে অনেককিছুই মনে থাকার কথা না। বলা বাহুল্য, সেই দোষে কিন্তু আমি নিজেও দোষী। বাংলাদেশ থেকে দন্তচিকিৎসাশাস্ত্রে পাস করার ২৩ বছর পরেও আমি এখনও পড়াশুনার চর্চা বজায় রেখেছি। আমার পেশায় দেশে এবং বিদেশে ২টা ডিগ্রি নেওয়ার পরে আমি চাকরি করেও অন্যান্য বিষয়ে পড়াশুনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা সম্পূর্ণভাবে আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিলো। সাধারণত কাজের পর বিকালে গিয়ে আমি ক্লাস করি। বিজনেস, ল’, এডুকেশন ছাড়াও বায়োএথিক্স এবং পাবলিক হেলথের জগতে আমার পদচারণা। কারণ আমি পড়াশুনাকে শুধুমাত্র জীবিকার মাধ্যম মনে করি না। আমার জন্য এটা সম্পূর্ণভাবে জ্ঞানার্জনের স্পৃহার সাথে সম্পৃক্ত।
তবে একজন মানুষের পক্ষে জ্ঞানাহরণ করা সহজ; কিন্তু জ্ঞান ধারণ করে রাখারও তো একটা সীমা আছে! নিয়মিত চর্চার অভাবে আমি এখন অনেক সাধারণ বিষয়ও ঠিকমত মনে করতে পারি না। খুব সহজ তথ্যের ব্যাপারেও ভুল করি। স্বাভাবিকভাবেই নিজের পেশাতেও যা নিয়মিতভাবে কাজে লাগে না, সেটা আর ঝালাই করা হয় না। তাই বলে চাইলেই যে আবার অবসরে পড়ে নেওয়া যাবে না, সেটাও ঠিক না। কিন্তু আমার মত ফাঁকিবাজের আর তা’ করা হয় কই? তবে সেই ব্যর্থতার দায়ভার একান্তই আমার। এর সাথে আমার পেশার মানের কোন সম্পর্ক নাই। এই কথা অনস্বীকার্য যে পেশাদারী ডিগ্রি অর্জনের পর চর্চার অভাবে অনেক তথ্য স্মৃতির অতল গহŸরে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ মৌলিক জ্ঞান নিয়মিতভাবে ঝালাই করা ব্যতীত দন্তচিকিৎসকদের পক্ষেও পেশায় নিয়োজিত থাকা অসম্ভব। উল্লেখ্য যে, চর্চার অভাবে স্মৃতিভ্রষ্টতার শিকার হওয়া কিন্তু মেডিক্যাল চিকিৎসকদের বেলাতেও প্রযোজ্য। সবই হলো অনুশীলনের ব্যাপার!
দন্তচিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে কৌতুকের কথায় ফিরে যাই। দ্বিতীয় কৌতুক হলো, এক ‘দাঁত’ পড়তে আর কত সময় লাগে? আগেই বলেছি, যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বেশির ভাগ বিষয় আমাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যেহেতু আমাদের জ্ঞানের প্রয়োগ শুধুমাত্র ‘ডেন্ট্যাল’ রিলেটেড, সেইজন্য বুঝার এই ভুল হতেই পারে। সেই কারণেই এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা অসমাপ্ত। শুধু দাঁত না; ‘হেড এন্ড নেক’ অর্থাৎ মাথা থেকে শুরু করে পুরা ঘাড় পর্যন্ত সবধরনের রোগের চিকিৎসায় আমরা নিয়োজিত। আর কোনদিন কি মস্তকবিহীন কোন জীবন্ত মানুষ দেখেছেন? শরীরের প্রধান অংশই তো সেটা! দেহের যে কোন রোগবালাই তো আর শুধুমাত্র দৈহিক সীমারেখা বজায় রেখে অগ্রসর হয় না! দেহের বাকী অংশের যে কোন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে সেখানে। আবার হেড এন্ড নেক-এর যে কোন রোগবালাইও বাকী দেহে ছড়িয়ে পড়ে অথবা সার্বিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে অনায়াসে। সাধারণ জনগণ যখন শুধুমাত্র হাড্ডি, চর্ম বা অন্য যে কোন অঙ্গের স্পেশ্যালিস্টের কাছে চিকিৎসার জন্য যান, তখন তো তাদের মনে একবারও প্রশ্ন আসে না, যে সেটা তো পুরা দেহ না! তাহলে শুধুমাত্র দন্তচিকিৎসকের ব্যাপারেই এই হেলাফেলা কেন?
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।