Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীনতা ও পলাশি ট্রাজেডি

| প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মাহমুদ ইউসুফ : ১৩৩৮ সাল থেকে ১৫৩৮ পর্যন্ত দুশ বছর বাঙলার পরিপূর্ণ স্বাধীনতাকাল। বাঙলার ১০ হাজার বছরের র্কীতিকালের এই দুশ বছর এক গৌরবময় অধ্যায়ের ইতিহাস। এ সময়ে বাঙলার সুলতানরা নিজেদের যোগ্যতা, শক্তি ও ঐশ^র্যের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের অন্যতম হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় এবং রাজার নানা কর্তব্য পালনেও অপরিসীম দক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছেন। তার ফলে বাঙলার জনসাধারণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। এই আযাদ সুলতানি আমলের জন্ম দেন সুলতান ফখর উদ্দিন মুবারক শাহ। তিনি ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখল করে সোনারগাঁওকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। এর পূর্ণতা দেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ১৩৫২ সালে তিনি সাতগাঁও, লাখনৌতি ও সোনাগাঁও ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলেন একীভূত বাঙলা সালতানাত। এর ফলে তিনি হলেন সমগ্র বাংলাদেশেরই শাহ বা শাহ-ই-বাঙলা। বাংলার বাইরে তিনি দুর্গম নেপাল ও উড়িষ্যা বা জাজনগরেও সফল অভিযান চালান। এছাড়া ত্রিহুত, শাহ চম্পারন, গোরক্ষপুর, কাশিও তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই স্বাধীনতা অক্ষুণœ থাকে ১৫৩৮ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে বৃহৎ বাঙলা শাসন করেন ২২ জন ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁদের প্রজ্ঞা, সাহস, রণদক্ষতা ও কলা কৌশলে বাঙলা হয়ে ওঠে সুপারপাওয়ার। শুধু ধন-ধান্যে নয়, শৌর্য-বীর্যেও বাঙালিরা হয়ে ওঠে দুনিয়াসেরা।
১৫৩৮ সালে পাঠান বীর শের খানের হাতে স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন শাহমুদ শাহ পরাজিত হন। তবে সুলতানি আমলের অবসান হলেও আযাদি অক্ষুণœ থাকে। পাঠান বীররা স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আফগান-পাঠান আমল চলে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত। আফগান শাসনের শেষ চরিত্র দাউদ খান কররানি মসনদে বসেন ১৫৭২ সালে। তাঁর চার বছরের শাসনকাল বাঙলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ট্রাজিককাল। বিয়োগান্তক কাহিনি, বেদনাদায়ক ইতিহাস।
১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ উড়িষ্যার তুকারায়ের যুদ্ধ ও মুগলমারির যুদ্ধ নামে খ্যাত। জায়গা দুটি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর জেলার দুটি গ্রাম। দুটি গ্রামের ব্যবধান আট মাইল। এই আট মাইল বিস্তৃত স্থানেই সংঘটিত হয় এই যুদ্ধ। বাঙলার ইতিহাসে এই যুদ্ধ তাৎপর্যপূর্ণ এজন্য যে, এ যুদ্ধেই আফগানরা দেশের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে এবং বাঙলায় আফগান শাসন; একই সাথে বাঙলার স্বাধীনতার অবসান ঘটে। আর ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই সংঘটিত হয় রাজমহলের যুদ্ধ। এ সমরে মুঘল সেনাপতি ছিলেন খানই জাহান হোসেন কুলি বেগ। আর আফগানদের নেতৃত্বে ছিলেন দাউদ খান কররানি। এ লড়াইয়ে বিজয়ী হয় মুঘল বাহিনী। পালাতে গিয়ে দাউদ খান কররানির ঘোড়ার পা কাদায় আটকে যায়। বন্দি হন দাউদ খান কররানি। মুঘল আমিরদের দাবি অনুসারে হত্যা করা হয় দাউদ খান কররানিকে এবং তাঁর ছিন্ন মুÐ আকবরের নিকট প্রেরিত হয়। একই সঙ্গে লুপ্ত হয় বাঙলার স্বাধীন সালতানাত। তদানীন্তন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মহানগর সোনারগাঁও তলিয়ে যায় অন্ধকারে। বাঙলা বরণ করে ভারতের অধীনতা। দিল্লির বেদীমূলের আশ্রয়ে যায় বাঙলা। বাঙালিদের কপালে জুটে পরাধীনতার তিলক। সোনার বাংলা হয় লুটপাট ক্ষেত্র। দিল্লির চাটার দলেরা এদেশের সহায় সম্পদ খুবড়ে খেতে থাকে। বাঙলার সম্পদ লুট হয়ে দিল্লি সমৃদ্ধ হতে থাকে।
রাজমহলের যুদ্ধে জয়ের পর দিল্লির নবাব বা প্রতিনিধিরা বাঙলা শাসন করে ১৮১ বছর। এই পৌনে দুশ বছরে দিল্লি সরকারের ছত্রছায়ায় বাঙলায় বর্ণহিন্দুদের উত্থান ঘটে। জমিদার, রাজা, মহারাজা, সেনাপতি, ব্যাংকার, মুৎসুদ্দি, মহাজনপদগুলো ক্রমে ক্রমে হিন্দুদের দখলে চলে যায়। তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলী খান। বর্ণহিন্দুরা সম্মিলিত ষড়যন্ত্র করে বাঙলায় মুসলিম নবাবদের উৎখাতের জন্য। তারা লর্ড ক্লাইভের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে হাত মিলায়। বাঙলা থেকে মুসলমান উৎখাতের জন্য ২৩ জুন ১৭৫৭ পলাশিতে ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান-হিন্দু। অসম যুদ্ধ নাটকে নবাব সিরাজদৌলার পরাজয় ঘটে। শ্রী বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘ধর্মতত্ত¡’-এ বলেন, ‘মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল। হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ইংরেজকে ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু সিপাহী ইংরেজের হইয়া লড়িয়া হিন্দু রাজ্য জয় করিয়া ইংরেজকে দিল। কেননা, হিন্দুর ইংরেজের উপর ভিন্ন জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই। আজিও ইংরেজের অধীন ভারতবর্ষ অত্যন্ত প্রভুভক্ত। ইংরেজ ইহার কারণ না বুঝিয়া মনে করে, হিন্দু দুর্বল বলিয়া কৃত্রিম প্রভুভক্ত।’ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: প্রবন্ধসমগ্র, পৃ ১৯৩)
পলাশি ট্রাজেডির সমাপনান্তে শুরু হয় দিল্লির বদলে খ্রিস্টানদের কোম্পানির শাসন। মুসলিমদের সম্পদ দখলে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় কোম্পানি ও নেটিভ সম্প্রদায়। লর্ড ক্লাইভ গংদের চক্রান্তে হিন্দুসমাজ ফুলে ফেঁপে বেড়ে ওঠে। আর মুসলিমরা নি:শ^, কপর্দকশূণ্য হয়ে পড়ে। শোষিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত হয়েও মুসলমানরা আযাদি সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ভারতীয় ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তজা বলেন, ‘নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে (বৃটিশ বিরোধী আযাদির জিহাদে) মুসলমানদের বিদ্রোহ দমনে ৫ লক্ষ বিপ্লবীর ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বৃটিশ বুদ্ধিজীবীরা এটাকে বেমালুম হজম না করে কিঞ্চিৎ স্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছেন। তাই ফিল্ড মার্শাল লর্ড রবার্ট তার Forty One Years in India পুস্তকে কিঞ্চিৎ স্বীকার করে লিখেছেন, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে মাত্র ২৭ হাজার মুসলমানের শুধু ফাঁসি দেয়া হয়েছে।’ (গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন, পৃ ৪৭)
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন