Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজানের ফজিলত

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


আল্লামা মুজাহিদুদ্দীন চৌধুরী দুবাগী : ইসলামের ভিত্তিমূলসমূহের মধ্যে রোজা অন্যতম। ইসলামের প্রথম যুগ হতে এযুগ পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমানই রোজা ফরজ বলে বিশ্বাস করে এবং তা পালন করে আসছেন। এটি কোরান, হাদিহ ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত। তাছাড়া দুনিয়ার মধ্যে মানবকুল বহু সম্প্রদায় ও বহু ধর্মে বিভক্ত, কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বী দৃষ্ট হয় না যাদের ভিতর কোন না কোন উপবাসব্রত বা রোজার ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আবহমানকাল হতেই মুনি-ঋষিগণকে উপবাস করতে এবং সুফী সাধকদিগকে রোজা রাখতে দেখা যায়। অতএব প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ব মানব সমাজে রোজার ছওয়াব এবং উপকারিতা সর্বজনসম্মত।
রাসুল (স.) এরশাদ করেছেন, আমার উম্মত যদি রোজার মর্ম জানতে পারত তা হলে সারা বৎসর রমজান হওয়ার জন্য দোয়া করত।  
হাদিস শরীফে এসেছে, কিয়ামতের দিন লোক যখন হিসাব-নিকাশের কঠোরতায় আবদ্ধ থাকবে, তখন রোজাদারের জন্য আরশের ছায়ায় দস্তারখান বিছান হবে। তখন তারা আনন্দের সঙ্গে পানাহার করতে থাকবে। তখন রোজা ভঙ্গকারীরা আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলবে একি ব্যাপার? তারা সানন্দে পানাহার করছে, আর আমরা এখনও হিসাবের দায়ে আবদ্ধ আছি। উত্তরে বলা হবে, দুনিয়াতে তোমরা আনন্দের সঙ্গে পানাহার করেছিলে তখন তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোজা রেখে ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করেছিল। কাজেই আজ প্রত্যেকের কর্মফল ভোগ করছে।
রোজা সম্বন্ধে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ফরমায়েছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, প্রত্যেক নেক কার্যের ছওয়াব আমি দশ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত প্রদান করে থাকি। কিন্তু বান্দার রোজা কেবল আমারই উদ্দেশ্যে রাখে বলে তার প্রতিদান আমি স্বয়ং দেব। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আমার নিকট মৃগণাভীর সুগন্ধ অপেক্ষা অধিক প্রিয়। রাসুল (স.) ফরমায়েছেন, রোজাদারের নিদ্রা এবাদততুল্য আর শ্বাসপ্রশ্বাস তসবিহ পাঠ সদৃশ্য এবং প্রর্থনা নির্ঘাত কবুলযোগ্য।
রোজার ভিতর আল্লাহতায়ালা কত রকম শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উপকার রেখেছেন, সে সমস্ত বিষয় আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের বহির্ভূত। কিন্তু যতটুকু আমরা বুঝি তাও কম উপকারী নয়।
রোজার আধ্যাত্মিক উপকারিতা : (১) রোজা দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধিত হয় এবং আধ্যাত্মিক জ্যোতি বাড়ে এই জন্যই দেখা যায়, হযরত আদম (আলাইহিচ্ছালাম) হতে হযরত মোহাম্মদ (স.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর মযহাবে রোজা রাখার ধর্মীয় নিয়ম ছিল। নবীগণ ফরজ রোজা ব্যতীত নফল রোজা বেশিভাবে রাখতেন। নবীগণের নফল রোজা রাখার নিয়ম তাঁদের স্বীয় প্রকৃতি ও অবস্থানুসারে বিভিন্নরূপ ছিল। হযরত নূহ (আ.) ১২ মাস রোজা রাখতেন। হযরত দাউদ (আ.) একদিন অন্তর অন্তর রোজা রাখতেন।
আমাদের হুজুর (স.) সেরূপভাবে কোন নিয়ম করেননি। বরং মাসে মাসে বেশিভাবে নফল রোজা রাখার অভ্যাস ছিল। কখনও কখনও তিনি ক্রমাগত কয়দিন রোজা রাখতেন এবং রোজার জন্য বছরের কতগুলো উত্তম দিন নির্ধরিত করেন। এতদ্ব্যতীত অনিদৃষ্টভাবে যে যে সময় উচিত মনে করতেন রোজা রাখতেন। প্রত্যেক চাদেঁর নির্দিষ্ট নফল রোজা ও নির্দিষ্ট পর্বের নফল রোজাসমূহ ব্যতীত অন্য সময় হুজুর (স.) এর উম্মত শরীর ও মনের অবস্থা ভেদে সময় সময় রোজা রাখতে পারে।
(২) মানব প্রকৃতির ভিতর যে পাশবিক অংশ কামরিপুর প্রভাব রয়েছে তার লালসা বৃদ্ধি পেলে পাপশক্তি বেড়ে মানবচরিত্রকে ধ্বংস করে। রোজার দ্বারা তা দমে যায়। হযরত (স.) ফরমায়েছেন, আর্থিক অভাব বশতঃ যারা বিবাহ করতে অক্ষম তারা বেশিভাবে রোজা রাখবে। রোজা কামভাবকে দমন করে।
(৩) রোজার দ্বারা উপবাসের কষ্ট অনুভূত হয়। এই অনুভূতির ফলে উপবাসী, ‘দারিদ্র’ পীড়িত দুঃখীগণের প্রতি সহানুভূতি জন্মে। জনগণের প্রতি সহানভূতিশীল হওয়া মানবের একটি মহাগুণ। এই গুণদ্বারা মানবাত্মার উন্নতি সাধিত হয়।
রোজার শারীরিক উপকারিতা : রোজা দ্বারা স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় পরিপাক ক্রিয়ার অবসর ঘটেও ভুক্তদ্রব্য সহজেই জীর্ণ হয়। আহারকে নিয়ন্ত্রিত করলে ইন্দ্রীয়গুলির উদ্দাম হতে রক্ষা পাওয়া যায়, এবং চিত্তের নম্রতা ও একাগ্রতা বর্ধিত হয়। এই মর্মে হুজুরে পাক (স.) ফরমায়েছেন, ‘রোজা রাখো স্বাস্থ্যবান হবে।’ ঐ রোজা ব্যর্থ যাতে ইন্দ্রীয়গুলি বশিকৃত না হয়। সারারাত্রি আহার করে সারা দিবস উপবাস থাকলে রোজার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। শরীর রক্ষার জন্য যতটুকু আহারের আবশ্যক ততটুকু মাত্র আহার করলে ইন্দ্রীয়গুলি বশীভূত হয়। অধিকাংশ দুষ্ক্রিয়া চক্ষু দ্বারা সাধিত হয়। তৎপর জিহবা, হস্ত ও পদ। বাহ্যেন্দ্রিয় ব্যতীত অন্তরিন্দ্রিয়ের দুষ্ক্রিয়া আরও গুরুতর, যেমন অভিমান, হিংসা, দ্বেষ, কুৎসা ইত্যাদি
কেবল উদরকে উপবাস না দিয়ে চক্ষু, জিহবা, হস্ত ও পদকেও উপোস দেওয়া রোজার উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন ‘লোভকে দমন করাইতো রোজার উদ্দেশ্য।’
রোজার প্রকৃত মর্ম হল: মানুষ নিজেকে ফেরেশতার ন্যায় প্রস্তুত করবে অর্থাৎ ফেরেশতাগণ যেমন কাম ও লোভ হতে মুক্ত, মানুষও তেমনি রোজা দ্বারা নিজেকে কাম এবং লোভ হতে মুক্ত ও পবিত্র করবে। লোভ চতুস্পদ জন্তুর উপর পরাক্রমশালী। লোভ পশুকে যে দিকে চালিত করে, তারা সেদিকেই চলে। এই জন্য পশু জাতি ফেরেশতা স্তর হতে বহু দূরে। মানুষের মধ্যেও যারা লোভের বশীভূত তারা পশুর ন্যায়। কেবল লোভ দমনের ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ ফেরেশতাদের নিকটবর্তী। ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী। অতএব, ফেরেশতার গুণে গুণবান মানুষও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপযুক্ত।
যুক্তি: (ক) রোজা দ্বারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়, আর যাকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করা হয়েছে তার নির্দেশ পালন করা যুক্তিযুক্ত।
(খ) রোজা দ্বারা সংযম শিক্ষা করা হয় আর সংযম হলো একটি বাঞ্চনীয় ও প্রশংসনীয় বিষয়।
(গ) আল্লাহতা’আলা যে মানুষকে পানাহার করবার ও যৌন ক্ষুধা মিটাবার সামগ্রী দান করেছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য তার নির্দেশে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা থেকে বিরত থাকাও যুক্তিসঙ্গত কথা।
রোজা কি মানব শরীরের কোন ক্ষতি করে? ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ডা. গোলাম মোায়াজ্জাম সাহেব কর্তৃক মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা চালানো হয়। তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোজার দ্বারা মানব শরীরের কোনোই ক্ষতি হয় না; কেবল ওজন সামান্য কমে, তাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়, বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এইরূপ রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা বহু দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। তৎকর্তৃক ১৯৬০ সালের গবেষণায় এও প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করে থাকে যে, রোজা দ্বারা পেটের শূল বেদনা বৃদ্ধি পায়, তাদের এই ধরনের ধারণা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারণ, উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই তা বাড়ে এই অতি সত্য কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূল বেদনার রোগীকে রোজা রাখিতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোজাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, যে যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি তাদের তা কমেগেছে। এই গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয় যে যারা মনে করেন যে রোজা দ্বারা রক্তের পটাসিয়াম কমে যায় এবং তাতে শরীরের ক্ষতি সাধিত হয় তাদের এই ধারণাও অমূলক। কারণ পটাসিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথম দেখা দিয়ে থাকে হৃৎপিন্ডের উপর অথচ ১১ জন রোজাদারের হৃৎপিন্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে রোজার পূর্বে ও রোজা রাখার ২৫ দিন পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, রোজা দ্বারা তাদের হৃৎপিন্ডের ক্রিয়ার কোনই ব্যতিক্রম ঘটেনি।
সুতরাং বুঝা গেল যে, রোজা দ্বারা রক্তের যে পটাসিয়াম কমে তা অতি সামান্য এবং স্বাভাবিক সীমা রেখার মধ্যে। তবে রোজার দ্বারা যে কোনো মানুষ কিছুটা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায় তা সামান্য রক্ত-শর্করা কমার দরুণই, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ক্ষতিকর নয়। সামান্য সময় ক্ষুধা পেলেও এইরূপ হয়ে থাকে। (চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগের দান সংখ্যা আজাদ ২৮ ফেব্রুয়ারি ’৬০ইং)।
এক কথায় রোজা মানব দেহের কোনরূপ ক্ষতি সাধন করে না, বরং তার নানাবিধ উপকারই করে থাকে। ডা. সোলেমান তার গার্হস্থ্য স্বাস্থ্যবিধিতে মানব দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মাঝে-মধ্যে ডকে নিয়া চুল্লি হতে ছাই ও আঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমনটা আবশ্যক উপবাস দ্বারা মাঝে-মধ্যে ‘পাকস্থলী’ হতে অজীর্ণ খাদ্যটি নিষ্কাশিত করাও তেমনটা দরকার।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন