Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাসিক মদীনা ও এক অনন্য মাওলানা

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আহমদ বদরুদ্দীন খান : মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। যার আজন্ম লালিত স্বপ্নের স্বার্থক বাস্তবায়ন ছিল মাসিক মদীনা। আর শৈশব থেকে এ স্বপ্ন তাঁকে দেখিয়েছিলেন পূণ্যবতী মা রাবেয়া খাতুন। ঐ সময়ের মুসলিম বাংলার মুখপত্র মাসিক ‘নেয়ামত’ পত্রিকা হাতে নিয়ে বহু কাংখিত আদরের ধন শিশু মুহিউদ্দীনকে গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে ম্নেহময়ী মা রাবেয়া খাতুন বলতেন, বাপজান! আমি চাই তুমি বড় হয়ে এমন একটি পত্রিকা সম্পাদনা করবে। আর তা দেখে রত্মগর্ভা মা হিসেবে গর্বে আমি মাতৃত্বের পরম সুখে অবগাহন করব। স্নেহময়ী মায়ের আকাংখা পূরণে নিবেদিতপ্রাণ শিশু মুহিউদ্দীন সেই লালিত স্বপ্ন বুকে নিয়ে কৈশোর, যৌবন অতিবাহিত করে কর্ম-জীবনের শুরুতেই শত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা সাহসের সাথে মোকাবেলা করে স্নেহময়ী জননীর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার চেষ্টা করেন। অতপর কঠোর পরিশ্রম ও ঐকান্তিক ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠা করেন মাসিক মদীনা। এরপর সময়ের ধারাবাহিকতায় সে স্বপ্নকে তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ, আন্তরিকতা ও মেধা দিয়ে এমন উচ্চতায় নিয়ে যান যে, তা পরিণত হয় বাংলা ভাষা-ভাষী অগণিত মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দনে। পাক মদীনার রূহানী প্রভাব স্পর্শ করে লক্ষ-লক্ষ হৃদয়। এরপর আর তাঁকে থেমে থাকতে হয়নি। পাক মদীনার আলোয় আলোকিত এবং উজ্জীবিত হয়ে অবিরাম সাধনার এই পথচলা আজ অর্ধ শতাব্দী অতিক্রম করেছে। আর মাসিক মদীনার কান্ডারী হিসেবে তিনি দিনে দিনে পরিণত হয়েছেন এ অঞ্চলের বাংলা ভাষা-ভাষী পঁচিশ কোটি মুসলমানের দ্বীনি রাহ্বারে।
মাসিক মদীনাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ও প্রেরণার উৎস। তিনি সুদীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর মাসিক মদীনার সম্পাদকীয় কলামে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর সমস্যা-সম্ভাবনা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে চিত্তাকর্ষক ও বোধগম্য পন্থায় মাত্র দুই পৃষ্ঠায় প্রতি মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করে তাদের চিন্তা-চেতনা ও পথ নির্দেশনার খোরাক যোগাতেন। যে সম্পাদকীয় জাতির বিবেকের আওয়াজ ও চেতনার বাতিঘর হিসেবে সর্বমহলে বিবেচিত এবং সমাদৃত হয়ে উঠে। এক সময় মুসলিম জাতিসত্ত¡ার আশা-আকাংখা ও স্বকীয় প্রতীকে পরিণত হয় মাসিক মদীনার সম্পাদকীয় কলাম। সেই সাথে সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তাঁর সময়োপযোগী ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পরিণত হয়ে উঠেন জাতির বিবেক হিসেবে। জাতির সেই মহান কান্ডারী, মুসলিম উম্মাহর সেই দরদী অভিভাবক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.) আজ আর আমাদের মাঝে নেই! গত ২৫ জুন ২০১৬ মোতাবেক ১৯ রমযান ইফতারের আগ মুহুর্তে সন্ধ্যা ৬ : ১০ মিনিটে পরিবার-পরিজন, হিতাকাংখী ও সমগ্র উম্মাহ্কে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহান রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মহান মাওলা পাকের ইচ্ছার অন্যথা করার সাধ্য কারো নেই। কারণ, তিনিই সকল কিছুর উপর সর্বশক্তিমান। তাঁর ইচ্ছা এবং ফায়সালাই সকল ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। আর আমরাও বিশ্বাস করি যে, ঠিক যে সময়টিতে মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাওয়া মুসলিম উম্মাহর তরে নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটির জন্য কল্যাণকর ছিল মাওলা পাক সে সময়েই তাঁর বান্দাকে ডেকে নিয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা তাঁর ছায়ায় ছিলাম। তাঁর অভিভাবকত্বে সাহসের সাথে সকল প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তারা আজ মুসলিম উম্মাহর এই সংকটময় সময়টিতে অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদের জীবনে যে বিশাল শূন্যতা ও অপূরণীয় ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তা পূরণ করার মত যোগ্য ব্যক্তিত্বের আজ বড়ই অভাব। কেবল মাত্র তাঁর মত আরেকজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মাওলানা মুহিউদ্দীন খানই সে শূন্যতা পূরণ করতে পারেন।
দেশ, জাতি ও উম্মাহর তরে আজীবন নিবেদিত প্রাণ মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, প্রতি মাসে মদীনার সম্পাদকীয় কলামে তাঁর সবটুকু মেধা, দরদ ও অনুভূতি এক করে লিখতেন এবং পাঠক/পাঠিকারাও তাঁর সেই সম্পাদকীয় কলামের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যে নিজেদের ঈমানী চেতনার বিকিরণ এবং রূহানী খোরাক খুঁজে পেতেন। বিগত পঞ্চান্ন বছরে মুসলিম বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সবকটি ইস্যু নিয়েই মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মাসিক মদীনার সম্পাদকীয় কলামে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর চিরাচরিত আবেগ, উৎকণ্ঠা ও দরদ দিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সমস্যা-সংকটে তাঁর শক্তিশালী কলম মুমিনের হৃদয়ে ঈমানী সাহস সঞ্চার করত। সেই ক্ষুরধার লিখনী শক্তির কারিশমায় পাঠক মাত্রই বিস্মিত ও মুগ্ধ হতেন। নতুনভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় উজ্জীবিত হতেন। আজকের বিশ্বে একদিকে যেমন ইসলাম-বিরোধী শয়তানী শক্তির জয়-জয়কার, অন্যদিকে তেমনি মুসলিম উম্মাহর কপট ও মতলববাজ অভিভাবকেরও আধিক্য আমরা লক্ষ করছি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সমস্যা-সংকটে তাঁর মত করে উদ্বিগ্ন হতে জাতীয় পর্যায়ে খুব কম অভিভাবককেই আমরা দেখতে পাই। কারণ, সংকটকালে তাঁকে আমরা কখনো গা-বাঁচানো অভিভাবকসুলভ ভূমিকায় দেখিনি, বরং সর্বদাই তাঁকে আমরা মুসলমানদের প্রকৃত দরদী অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছি। তেমনি সংকটকালে কোন নির্দিষ্ট বলয়ের মাঝেও তিনি নিজেকে কখনো আবদ্ধ করে রাখেননি। বরং উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে তিনি সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সংকট সমাধানে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন।
সময়ের ধারাবাহিকতায় আজ মিডিয়া তথা প্রচার মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কিন্তু আজ থেকে এক/দেড় দশক পূর্বেও আলেম-উলামা তথা ইসলামী চিন্তাবিদ ও নেতৃবৃন্দের জন্য পরিস্থিতি এতটা অনুকূল ছিল না। বিগত সময়ে এ দেশের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কোন ইসলামী দল বা ব্যক্তিত্বের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করাকে রীতিমত ধৃষ্টতাপূর্ণ বিবেচনা করা হত। প্রিন্ট মিডিয়াতেও ইসলামী দল বা ব্যক্তিত্বের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করার কোন সুযোগ ছিল না। সেই ক্রান্তিকালে প্রিন্ট মিডিয়ায় একমাত্র দৈনিক ইনকিলাবই ছিল উলামায়ে কেরাম তথা দ্বীনদার মুসলমানদের একমাত্র মুখপত্র। অথচ আজ প্রতিদিন প্রায় ডজন খানেক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় টকশোগুলোতে অন্যদের পাশাপাশি আলেমদের সরব ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। আর প্রিন্ট মিডিয়াতেও তাঁদের অবস্থান বেশ উল্লেখযোগ্য। এমনকি আজ মাদরাসা পড়–য়া তরুণ আলেমরা শুধু মিডিয়ায় আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণই করছেন না। বরং অনেক ভার্চুয়াল, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন। আর আজকের এ অনুকূল ক্ষেত্র তৈরি করতে যাঁদের সীমাহীন ত্যাগ ও অবদান রয়েছে মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
আজকের দিনে আমাদের আলেম সমাজের মাঝে মাশাআল্লাহ্ এমন সামর্থবানও অনেকেই রয়েছেন যাঁরা চাইলে একটি অত্যাধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মিডিয়া হাউজ রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারেন। কিন্তু বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে মাদরাসা পড়–য়া একজন মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের পক্ষে আজন্ম লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন তথা চার/পাঁচ ফর্মার একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার কাজটি কত কঠিন ও শ্রমসাধ্য ছিল তা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.) তাঁর আত্মকথন ‘জীবনের খেলাঘরে’ নামক গ্রন্থে মিডিয়া-কেন্দ্রিক সেই সময়কার বৈরী সময়ের নিদারুন বাস্তবতাকে নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির আলোকে এভাবে চিত্রায়িত করেছেন :
‘উনিশশো ষাট সনের শেষভাগটা একটা দারুণ সংকট এবং হতাশার মধ্যে পড়ে গেলাম। কোন কাজকর্ম নাই। সকালে বের হই এবং রাত পর্যন্ত ঘুরে ফিরে বাসায় ফিরে আসি। কিন্তু আশার কোন আলো কোথাও দেখি না। ঠিক এই হতাশার মধ্যে লালিত স্বপ্ন একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভুলতে পারি না। এভাবেই ষাট অতিক্রান্ত হয়ে একষট্টি এলো। প্রতিরাতেই বসে কিছুক্ষণ হিসাব কষি। একটা সংখ্যা পত্রিকা প্রকাশ করতে কত খরচ হবে?’ প্রথমে যদি অন্ততঃ এক হাজার কপি ছাপা হয় তবে সেগুলি বিক্রি করে কত আসবে? যদি বিক্রি না হয় তবে প্রতিমাসে কত ঋণ হতে পারে?
‘এসব চিন্তা ভাবনার মধ্যেই একদিন সাহস করে ডিক্লারেশন পাওয়ার জন্য দরখাস্ত দিয়ে বসলাম। নাম আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। মদীনা! মাসিক মদীনা!!
‘সারাদিন ঘুরে ফিরে বাসায় এসে প্রতিদিনই হিসাব করি। পত্রিকা প্রকাশ করার মত কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা? টাকা-পয়সার দিকটা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। আমার তখন এমন কোন পরিচিতিও নাই যে, পত্রিকার নামে কারও নিকট থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে। বন্ধু-বান্ধব দু’একজনের নিকট পরামর্শ করে দেখেছি, তাঁরা শুধু যে নিরুৎসাহিতই করেন তাই নয়, রীতিমত মুখ টিপে হাসেনও। আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন কেউ কেউ। কারণ, পত্রিকা প্রকাশ করে সেটা চালিয়ে যাওয়া তো রীতিমত রাজকীয় ব্যাপার। অনেক টাকা লোকসান দেওয়ার মত ক্ষমতা থাকতে হবে।
(চলবে)



 

Show all comments
  • মুফতি আল আমিন ১৮ জুন, ২০১৭, ৭:২৪ এএম says : 0
    আমার জীবনে লেখালেখির জগতে প্রেরণার উৎস মাসিক মদীনা এবং দৈনিক ইনকিলাব।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন