Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যাকাত ব্যবস্থায় পরিবর্তন দরকার

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : বাংলাদেশে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশনা পালন করা হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় না করার কারণে যে যার ইচ্ছামতো যাকে ইচ্ছা তাকে যাকাত প্রদান করে থাকে। সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। সমাজে অনেক ব্যক্তি এমন আছে যাদের ওপর যাকাত ফরজ অথচ তারা যাকাত প্রদান করে না! সহী বুখারীর এক হাদীসে বলা হয়েছে, যাকাত পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্তে¡ও যে সম্পদের যাকাত দেয়া হয় না সেই সম্পদকে বিষধর সাপে পরিণত করা হবে। তাছাড়া যাকাত না দিয়ে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখলে তার কপাল, পার্শ্ব ও পিঠে আগুনের ছেক দেয়ার কথা আল কুরআনের সূরা তাওবার ৩৫ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘দানকারীর জন্য ফেরেস্তা সম্পদ বৃদ্ধির দু’য়া করে থাকেন’। অপরদিকে সম্পদ কুক্ষিগতকারীর জন্য ফেরেস্তা সম্পদ ধ্বংসের জন্য দু’আ করে করেন। (বুখারী) তাছাড়া ঈমান ও সালাতের পরে যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ হলেও কতিপয় বই-পুস্তকে ‘যাকাত’কে পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করার কারণে সালাত এরপর যাকাত এর গুরুত্ব না দিয়ে অন্য বিষয়গুলোর প্রতি আমরা গুরুত্ব বেশি দেই। সকল নবীর যুগেই যাকাতের বিধান ছিল। যাকাত আদায় করা মুমিনের একটি মৌলিক গুণ। রাসূলুল্লাহ সা. যাকাত আদায়ের জন্য বায়’আত গ্রহণ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় যাকাত উসূল করার করার জন্য লোক নিয়োগ করতেন। তারা নিজ নিজ এলাকায় ধনীদের থেকে যাকাত সংগ্রহ করতেন এবং তা যথারীতি বণ্টন করতেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও যাকাত আদায়ের এ পদ্ধতি কার্যকর ছিল। যাকাত দেয়া কারো প্রতি কোনো ধরনের করুণা নয়, যাকাত খাজনা-ট্যাক্স এর বিকল্প নয় বরং যাকাত ও সাধারণ দান করা একটি বড় ধরনের ইবাদত।
মুসলিম সামাজে যে বা যারা যাকাত প্রদান করে তাদের বৃহৎ একটি শ্রেণি যাকাত প্রদানে ইসলামের রীতিনীতি পরিপূর্ণ অনুসরণ করছে না।  আবার যারা যাকাত দেয় তারা নিজের খেয়াল-খুশি মতো যাকাত দেয়। যেসব সংগঠন বা সংস্থা যাকাত আদায় ও বণ্টন করে তাদের মাঝে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার ফলে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়াতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং-এর বাইরেও বৃহৎ একটি শ্রেণি যাকাতের হকদার রয়েছে যাদের কাছে যাকাতের অর্থ পৌঁছায় না। ব্যক্তিগতভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দান করা হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠি তেমন উপকৃত হতে পারছে না। যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে বিতর্কিত একটি কাজ হলো, যাকাত হিসেবে কাপড় বিতরণ। কাপড়ের দোকানগুলোতে লিখে রাখা হয় ‘এখানে যাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’। দাতার বাড়ির সামনে লেখা হয় ‘এখানে যাকাতের কাপড় বিতরণ করা হয়’। অপরিকল্পিত উপায়ে যাকাত প্রদানে নানা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বিগত দিনে অনেক মানুষের প্রাণ হানি ঘটেছে। এর নিকটবর্তী উদাহরণ হলো ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ শহরের মো. শামীম তালুকদারের নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে ভোর পাচটায় প্রচন্ড হুড়াহুড়ি ও ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ২৭ জন নিহত হয়েছিল। এর আগে ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছিল। তার আগে ২০১২ সালে ‘যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে তিন নারীর মৃত্যু হয়েছিল।’
বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় ধরে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে যাকাত প্রদানের সেলফি তুলে প্রচার করার মধ্য দিয়ে যাকাতদাতার একনিষ্ঠতা অনায়াসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেউ আবার এমন আছে যাকাত দিতে যে পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করে তার চেয়ে যাকাত প্রদানের সংবাদটি প্রকাশ ও প্রচারে বেশি টাকা ব্যয় করে। নিঃসন্দেহে এ কাজগুলো পরিতাজ্য। যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে যাকাত গ্রহণকারীদের প্রয়োজনের দিকটি অধিক বিবেচ্য। অর্থের মাধ্যমে যাকাত প্রদান করা হলে কম-বেশি সবাই উপকৃত হবে। অন্য কোনো দ্রব্যের দ্বারা সম্ভব নয়। কেউ যদি দুনিয়ামুখী উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকাত প্রদান করে তাহলে তা বৈধ হবে না। প্রকাশ্যে যাকাত দিতে গিয়ে অহংকার না আসে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে কোনো সৎকর্মই কাজে আসবে না।  সব কিছুই বরবাদ হয়ে যেতে পারে। তাই সতর্কতার সাথে আমল করা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে যাকাতের কাপড় বলতে কোন কাপড়ের অস্তিত্ব ইসলামে নেই। কাপড় দ্বারা যাকাত আদায় করা গেলেও এর মাধ্যমে সবাই উপকৃত হয় না। কাপড় দিয়ে যাকাত প্রদান করলে বেশি লোককে যাকাত দেয়া যায়। এটা কারো কারো ব্যক্তি চিন্তা হলেও এমন চিন্তা বর্জনীয়। কেননা, ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দানে একদিকে যেমন দাতার মনে শ্রেষ্ঠত্বের ভাব প্রকাশের আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি এতে ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। অপরদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী হীনমন্যতায় ভোগে। যাদের যাকাত পাওয়ার কথা অনেক সময়ই তারা বঞ্চিত হয়।  আবার যাদের যাকাত গ্রহণ করার কথা নয়, তারাও লোভের বশে যাকাত গ্রহণ করে। এভাবে বর্তমানে যাকাতের নামে যে প্রহসন চলছে তাতে যাকাত গ্রহীতার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, অপরদিকে যাকাত দাতা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে।
ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব থাকায় যাকাতের উদ্দেশ্য, যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত, যাকাতের পরিমাণ, যাকাতদাতার দায়িত্ব, যাকাত গ্রহীতার করণীয়, যাকাত বণ্টন ইত্যাদি কার্যত্রম সঠিক উপায়ে পরিচালিত হয় না। যাকাত ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি দূরীকরণে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যথাযথ ব্যবহার করা উচিৎ। ইসলামী স্কলারদের লিখনী ও আলোচনাকে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। রমাদান ছাড়াও বছরব্যাপী যাকাত প্রদানের ব্যবস্থা থাকা দরকার। বছরের অন্য সময়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের বছর পূর্ণ হলে তখন যাকাত দিয়ে দিলে যাকাতের হকদারগণ উপকৃত হতে পারে। এই চিন্তাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।  
নিসাব পরিমাণ সম্পদ কারো মালিকানায় এক বছর পূর্ণ হলে তখনি যাকাত আদায় করতে হয়। তবে রমজানে যাকাত দেয়া ভালো। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থা থাকলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। বিশেষকরে যাকাতের খাতাপত্র লেখার করণিক, যাকাত সংগ্রাহক, যাকাত বণ্টনকারী, যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী, যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী, যাকাতের হিসাব রক্ষক, যাকাদের অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষক, যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়কারী এবং ওজনকারী ইত্যাদি। অথচ আল কুরআনে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসালে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। ’(সূরা হাজ্জ:৪১)।
যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বহুবিধ। বিশেষকরে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, যাকাত গ্রহীতাকে আত্মনির্ভরশীল করে যাকাত দাতার পর্যায়ে উন্নীত করা। সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো বৈষম্য যাতে না থাকে সে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কারো হাতে সম্পদ কুক্ষিগত না হয় সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা। যাকাতের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন। এজন্য কতিপয় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের বর্তমান যাকাত ফান্ড এর কার্যক্রমের আওতায় জেলা পর্যায়ে যাকাত সংগ্রহ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে সেদিকেও খেয়াল রাখা যেতে পারে। যতদিন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম না হয় ততদিন যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংক বা অন্য কোনো অন্যকোন সংস্থার মাধ্যমেও যাকাত উসুল ও বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।    
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন