Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তাওরাত নাজেল হয় ৬ রমজান

| প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


কে এস সিদ্দিকী : নুজুলে কোরআনের মোবারক মাস মাহে রমজান। এ মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য এ মাসে পবিত্র কোরআনসহ প্রসিদ্ধ সকল আসমানী কিতাব নাজেল হয়েছে। একমাত্র কোরআনই সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব যা অবিকৃতি ও কোনো প্রকারের রদবদল হতে এ যাবত রক্ষা পেয়েছে এবং ইনশাল্লাহতা’আলা কেয়ামত পর্যন্ত অবিকল রক্ষা পাবে। কেননা কোরআন বিশ্ব মানবের চিরন্তন পরিপূর্ণ জীবনবিধান হওয়ায় এর সংরক্ষণের দায়িত্ব খোদ আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতি হাতে গ্রহণ করেছেন। কোনো অপশক্তি এর বিন্দু মাত্র ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। ইহুদী-খ্রিস্টান সহ ইসলামদ্রোহীরা বার বার কোরআন বিকৃতির অপচেষ্টা করে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং আজও তাদের কোরআন বিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত থেমে নেই, যা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কোরআন প্রসঙ্গ এলে স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য প্রসিদ্ধ আসমানী গ্রন্থ তাওরাত, যবুর এবং ইঞ্জিল (বাইবেল) এর কথাও এসে যায়। যেহেতু হযরত মূসা (আ.) এর প্রতি তাওরাত নাজেল হয় ৬ রমজানে তাই প্রাসঙ্গিকভাবে তাওরাত নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। এর নুজুলের ঘটনা স্মরণে আমাদের আজকের প্রয়াস।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায় অসংখ্যবার হযরত মূসা (আ.) ও তার প্রতি অবতীর্ণ তাওরাতের উল্লেখ রয়েছে। ইহুদীরা এটি তাদের গ্রন্থ বলে গর্বের সাথে দাবি করে থাকে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃত অবিকৃত আসমানী তাওরাতের অস্তিত্ব কি কোথাও বিদ্যমান আছে? হযরত মূসা (আ.) এর পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইহুদী পন্ডিতরা আসল তাওরাতকে বিকৃত করে যেসব রচনা তাওরাত নামে প্রচার করেছেন বর্তমানে তাদের মধ্যে প্রচলিত সেসব কল্পকাহিনীকে মূসা (আ.) এর প্রতি অবতীর্ণ তাওরাত বলা হচ্ছে।
মোফাসসীরীনে কেরাম এবং ঐতিহাসিকগণ তাওরাত বিকৃত হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন যা সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
হযরত মূসা (আ.) এর ইন্তেকালের পর বনি ইসরাইলের শাসন ক্ষমতা হযরত ইউশা (আ.) এর উপর অর্পিত হয়। তিনি ছিলেন হযরত ইউসূফ (আ.) এর পুত্র আফ্রাহীমের পুত্র নূনের পুত্র। অর্থাৎ- ইউশা ইবনে নূন ইবনে আফ্রাহীম। তার মাতার নাম কুলসুম অথবা মরিয়াম। তিনি হযরত মূসা (আ.) এর বোন ছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে হযরত ইউশা (আ.) ছিলেন হযরত মূসা (আ.) এর ভাগ্নে। মূসা (আ.) এর ওফাতের পর সাত বছর পর্যন্ত তিনি মুসা (আ.) এর নায়েব এবং অছি ছিলেন। এরপর তিনি নবী হন। তখন তার প্রতি নির্দেশ হয় বনি ইসরাইলকে মুক্ত করার। তিনি ক্ষমতা লাভের পর বনি ইসরাইলকে নিয়ে মিসর হতে জর্দান ফিলিস্তিন এবং গৌড়ে চলে আসেন। মূসা (আ.) এর ওফাতের ৩১ বছর পর্যন্ত বনি ইসরাইল মূসা (আ.) এর দ্বীনের ওপর কায়েম ছিল। হযরত ইউশা (আ.) এর ইন্তেকালের পর ফাইখাম আল-আজরী ইবনে হারুন বনি ইসরাইলের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং পঁচিশ বছর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন এবং বনি ইসরাইলকে মোসাভী শরীয়ত পালনে বাধ্য করে রাখেন। তফসীরবিদগণের মতে, তাওরাত ও তাদের কান্ড ছিল, তার ইন্তেকালের পর বনি ইসরাইল মূসা (আ.) এর শরীয়ত হতে ফিরে যায় এবং কুফরের পথে অনুসরণ করে প্রকাশ্যে মূর্তি পূজা আরম্ভ করে।
এর পরেও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় হযরত সুলায়মান (আ.) এর ওফাতের পর ইসরাইল আসবাত বা বংশধরগণের মধ্যে দুটি বংশ বিনিয়ামিন ও বনি ইহুদির সাম্রাজ্য চার বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সময়কালের মধ্যে হযরত সুলায়মান (আ.) এর বংশে উনিশজন বাদশাহ হয়। তাছাড়া একজন নারীও রাজত্ব করেছিল। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন মোমেন ও তাওহীদবাদী এবং অবশিষ্ট সবাই ছিল কট্টর কাফের, মোশরেক ও মূর্তি পূজারী। এ সময় বখতে নসব তাদের প্রতি হামলা চালিয়ে বনি ইসরাইলকে একেবারে খতম করে দেয় এবং বাকিদের গ্রেফতার করে। বায়তুল মোকাদ্দাস (জেরুজালেম) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এহেন পরিস্থিতিতে কে বলতে পারে যে, তাওরাত তার আসল রূপে বিদ্যমান যা কয়েকবার লুট করার প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তাওরাত বায়তুল মোকাদ্দাস ধ্বংস হওয়ার সত্তর বছর কিংবা আরো অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আজরা আল ওয়াররাক আল হারুন তার স্মরণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে লোকদের দ্বারা লিপিবদ্ধ করায়। ইহুদিরাও স্বীকার করে যে, আজরা বায়তুল মোকাদ্দাসে আগমনের এক যুগ পর তাওরাত লিপিবদ্ধ করে। আজরা তাওরাতকে লোকদের কাছে এমন অবস্থায় পেয়েছেন, যাতে অনেক কিছু রদ-বদল হয়ে গিয়েছিল। মোটকথা, তখন থেকে তাওরাতের প্রচার হয় এবং তা নকল করা হয়, এমনকি তার সংস্কার হয়। কিন্তু তা সত্তে¡ও তাতে খারাপও দুর্বলতা থেকে যায় এ কারণে হাত বদল হতে থাকে।
তাওরাত প্রকাশের পরে সত্তরজন শায়খ কর্তৃক যে তরজমা করা হয় তা আজরা আল ওয়াররাক লিখিত তাওরাতের বিপরিত। আল্লামা ইবনে হাজম লিখেছেন যে, ইউশার কিতাবটি একটি নির্মিত ইতিহাস, যা কোনো কোনো পরবর্তী ইহুদী রচনা করেছে এবং ইউশা তা কখনো লেখেননি। এ বক্তব্যের অখন্ডনীয় প্রমাণও রয়েছে। আর তা হচ্ছে, ইউশার কিতাবে আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত সুলায়মান (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাস নির্মাণ করেছেন। একথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক,  কেননা ইউশার কয়েকশ বছর পর সুলায়মানের জন্ম হয়।
বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায় যে, বর্তমানে ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত তাওরাত হযরত ঈসা (আ.) এর চারশ ৫৪ বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে এবং হযরত মুসা (আ.) আর এগারোশ ২৫ বছর পরে রচিত হয়েছে। এরোশনম  (জেরুজালেম) বিদ্যমান কিতাব তাওরাত ও আজরা প্রণীত কিতাব তাওরাত- এর উভয়কে মিলিয়ে সংকলিত।
তাওরাত নামে ইহুদীদের কাছে দ্বীনের নামমাত্র সম্পদ ছিল তাও সম্পূর্ণ বখতে নছবের হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। এরূপ ঘটনা বখতে নছবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পরেও প্রত্যেক যুগে এমন সব অত্যাচারী জালেম বাদশাহর আবির্ভাব হতে থাকে, যারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিল দুনিয়া হতে ইহুদিয়তকে খতম করে দিতে। তাই দেখা যায়, অন্টুনস নামক এক গ্রিক শাসক হুকুম দিয়েছিল যে, তাওরাতের একটি পৃষ্ঠাও যার কাছে পাওয়া যাবে তাকে হত্যা করা হবে। অতঃপর রোমক শাসক হীরা ক্ষমতা লাভ করে এগারো লাখ ইহুদী হত্যা করেন। ফের কায়সার হুডসন এসে পাঁচ লাখ ইহুদীকে হত্যা করেন এবং তাদের প্রত্যেকটি বস্তু নিশ্চি‎হ্ন করে দেন। এমনকি জেরুজালেমকে ধ্বংস করে এর নাম পর্যন্ত বদলে দেন এবং ইলসিয়া নাম করণ করে।
এসব ঘটনার আলোকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বর্তমানে প্রচলিত কিতাব তাওরাত কিছুতেই মূসার তাওরাত নয়, বরং তার কাল্পনিক অনুবাদ। এটি যদি প্রকৃতই মূসার তাওরাত হতো তা হলে উহাতে মূসা (আ.) এর পরবর্তী লোকদের নাম থাকতো এবং মূসা (আ.) এর ওফাত ও কাফন দাফনের উল্লেখ থাকতো, তাছাড়া এ গ্রন্থে এমন এলহামী কিতাবের কিছুতেই হতে পারে না।
ইহুদীদের মনগড়া এ কাল্পনিক তাওরাতে যেসব ভিত্তিহীন কাহিনী সংযোজন করা হয়েছে, পন্ডিত গবেষকগণ যেগুলোর মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ-
আলোচ্য বিকৃত তাওরাতের একস্থানে বলা হয়েছে, হযরত ইয়াকুব ও আল্লাহর মধ্যে কুশতি হয়, আল্লাহ হেরে যান এবং ইয়াকুব জয় লাভ করেন। অনুরূপ ইহুদী তাওরাতে অদ্ভুত কাল্পনিক এবং ভিত্তিহীন নানা বিষয় ও ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে, এগুলো পাঠ করলে যে কেউ আন্দাজ করতে পারে যে, কোনো এলহামী কিতাবে এরূপ কথাবার্তা থাকতে পারে না।
হযরত মূসা (আ.) এর মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিয়েও ইহুদীদের বাড়াবাড়ি, অতিরঞ্জন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, যার বর্ণনার আলাদা স্থান আবশ্যক। তবে তাওরাত সম্পর্কে খোদ ইহুদীদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। প্রথম দিকে ইহুদীদের মধ্যে যে পাঁচটি ফেকার সৃষ্টি হয় সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি আরো খোলাশা হয়ে উঠে। এ পাঁচটি ফেকার নাম-পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো তা ইহুদী মাজহাব তথা ধর্মমত নামে খ্যাত-
 ১।  সামেরিয়া: ওদের ধারণা মাতে কুদস শহর বায়তুল মোকাদ্দাস হতে ১৮ মাইল দূরত্বে এসব লোক বাইরে যাওয়াকে জায়েজ মনে করেন না। তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের হুরমত মর্যাদা স্বীকার করে না এবং তার প্রতি সম্মানও প্রদর্শন করে না। এরা শাম বা সিরিয়ায় বসবাস করে।
শামেরিয়ার অধিবাসীরা হযরত মূসা ও ইউশার পর যত নবীর আগমণ ঘটেছে তাদের কাউকে স্বীকার করে না। যেমন শামাউন, দাউদ, আশায়, ইলিয়াস, আলইয়াসা, আমছ, জরকুক, জাকারিয়া প্রমুখকেক নবী হিসেবে স্বীকার করে না এবং তাদের নবুওয়াত মানে না।
২। ছাদুকিয়া: এরা ছাদুক নামক এক ইহুদী বাদশাহর অনুসারী। ইহুদীদের মধ্যে তারা একমাত্র লোক যারা উজায়ারকে আল্লাহর পুত্র বলে, এরা ইয়েমেনের অধিবাসী।
৩। আনানিয়া: এরা আনান ইহুদী নামক দলের অনুসারী। এরা আহবারের বাণী মানে না, অস্বীকার করে।
৪। রাব্বানিয়া: এরা আহবারের মাজহাবের অনুসারী এবং তাদের বাণী গ্রহণ করে এদের অধিকাংশই ইহুদী।
৫। ইসতোবিয়া: এর ফেরকা আবু ঈসা ইস্পাহানীর নামে গঠিত। এরা হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত মোহাম্মদ (স.) এর সম্পর্কে বলে, আল্লাহ তা’আলা ঈসা (আ.)কে বনি ইসরাইলের প্রতি এবং মোহাম্মদ (স.)কে বনি ইসমাইল ও সকল আরবের প্রতি প্রেরণ করেছেন।
যে সামেরী তাওরাত তাদের কাছে রয়েছে তা অন্যান্য ইহুদীদের নিম্নে বিদ্যমান তাওরাতের সম্পূর্ণ বিপরীত সামেরীদলের দাবি হলো, তাদের কাছে যে তাওরাত আছে তাই আসল, যা মূসা (আ.) এর প্রতি অবতীর্ণ, এছাড়া অন্যান্যদের হাতে যে তাওরাত রয়েছে তা সম্পূর্ণ বিকৃত, পরিবর্তিত। অন্যান্য ফেকার ইহুদীরা বলে থাকে যে, তাওরাতে সামেরিয়াত পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সামেরীদের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার কাহিনী কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। যারা গো বাছুর বানিয়ে গো পূজার প্রচলন করেছিল। সেটি এক স্বতন্ত্র ইতিহাস। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, সামেরী ভারতবর্ষে এসেছিল, বিদ্যমান অচ্ছুত (অসম্পৃশ্য) জাতি তারই বংশ ধর নয় তো?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন