Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাধ বাড়ছে, কমছে মানবতা

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর : এই পৃথিবীতে আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। ছিলাম না, আজ আছি, কাল আবার থাকব না। লক্ষ কোটি বছর ধরে বহমান এই পৃথিবীর এটাই চিরন্তন নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম অতীতেও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। সুতরাং আমরা যারা আজ এই পৃথিবী নামক গ্রহটির বাসিন্দা আমরাও সময়ের পরিক্রমায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চিরতরে চলে যাব। মরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সবকিছুর সাথে একজন মানুষের সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হয়। আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। ধন সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, প্রভাব প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কোনো কিছুই আমাদের সাথে যাবে না। যে অর্থ-সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতার জন্য এত মারামারি এবং হানাহানি, সেই অর্থ সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতা সবই পর হয়ে যায়। আবার এই মৃত্যু কার জীবনে কখন আসবে সেটা কেউ জানে না। কে কত বছর বাঁচবে সেটাও জানার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন যেখানে খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং অনিশ্চয়তায় ভরা, সেখানে আমাদের সবারই উচিত এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সুন্দর, সুখী এবং শান্তিময় করা। আমাদের উচিত ভালোবাসায়, মমতায় এবং ভাতৃত্বের বন্ধনে জীবনকে গড়ে তোলা। তার জন্য আমাদের সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে।
এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব এবং আগমন মানুষের ইচ্ছায় হয়নি। আবার এই পৃথিবীতে মানুষের অবস্থানের সময়টা তার ইচ্ছামত এবং প্রয়োজনমতও হয় না। একইভাবে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী মানুষের মৃত্যুও হয় না। এসবের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নেই। মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা প্রয়োজন তার সবকিছুই এই পৃথিবীতে বিদ্যমান। আবার এর কোনটিই মানুষের নিজের হাতে সৃষ্টি নয়। আজ পর্যন্ত অক্সিজেন, পানি এবং খাবারের অভাবে কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি। এক্ষেত্রে যে সংকট তা মানুষে মানুষে বিভেদে সৃষ্টি। মানুষে মানুষে হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহে আজ প্রতিদিন পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞে ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো মানুষ আত্মহত্যা করছে। এভাবে মানুষের জীবন থেকে শান্তি বিদায় নিচ্ছে, অশান্তির জন্ম হচ্ছে। মানুষের জীবন হচ্ছে বিপর্যস্ত, দুঃখ আর কষ্টে নিমজ্জিত। অথচ আমাদের সুন্দর চিন্তা, কর্ম এবং উদ্যোগ এই পৃথিবীর সকল মানুষের জীবনকে সুন্দর এবং শান্তিময় করতে পারে। সবার জীবনকেই আনন্দময় এবং সুখী করতে পারে। আর এটাই তো মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অথচ মায়া, মমতা এবং ভালোবাসাই এখন মানুষের জীবনে সবচেয়ে কম।
এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনকে সুন্দর এবং সুখীময় করতে হলে আমাদের সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে। জাতি ধর্ম-বর্ণ-গ্রোত্র নির্বিশেষে সবাই চায় মানুষ সত্য কথা বলুক, মিথ্যা বলা পরিহার করুক। কারণ সত্য কথা মানুষের মাঝে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং মিথ্যা কথা অসুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে। অথচ মানুষ এখন হরদম মিথ্যা কথা বলে। তাই সমাজে এত অশান্তি। আমার আপনার মতো প্রতিটি মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক কিছু অধিকার আছে। সেগুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার। সাথে রয়েছে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার। মানুষ মাত্রই ধর্মে বিশ^াসী। ধর্মে বিশ^াস করে না এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। অথচ আজকের পৃথিবীর বহু দেশে বহু সমাজে বহু মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষদেরকে ধর্ম পালনে বাধা দিচ্ছে। ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং বিদ্রোহ। ফলে সমাজ অস্থির হচ্ছে, সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ঠ হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ঠ হচ্ছে। ফলে একটি দেশের মধ্যে বসবাসকারী আন্তঃধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, অশান্তির জন্ম নিচ্ছে। যা ক্রমান্বয়ে বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মানুষের জীবন। সুতরাং আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় বিশ^াসকে সম্মান করি, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অধিকারকে রক্ষা করি।
রাজনৈতিক অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক দেশেই এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগেও দেশে দেশে চলছে রাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে আজ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান নেই বললেই চলে। এসব দেশের মানুষ বরাবরই রাজনৈতিক অধিকার হরণের শিকার। আর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রবক্তা বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ^ এক্ষেত্রে পালন করছে সম্পূর্ণ ডবল স্টার্ন্ডাড নীতি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার কীভাবে কেড়ে নেওয়া হয়, তার নজির আমরা আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন এবং মিশরে দেখলাম। সেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো, তাদেরকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হলো এবং তাদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হলো। কিন্তু বিশ^বিবেক নির্বিকার এবং এসব অন্যায়ের মদদদাতা। আজ দেশে দেশে নির্যাতিত, নিপীড়িত অনেক মানুষ প্রতিশোধের নেশায় সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ মানুষকে যদি তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করা হয়, তাহলে মানুষেরা সবসময় শান্তিতেই থাকত। দেশে দেশে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা কিন্তু চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। মৃত্যু আপনাদেরকে গ্রাস করবেই করবে। ফেরআউন, হালাকু খান আর আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেট এর মতো ক্ষমতাধর শাসকেরা আজ কেউ নেই। সময়ের পরিক্রমায় সবাই হারিয়ে গেছে। তাদের সেই ক্ষমতাও নেই, সাম্রাজ্যও নেই, সম্পদও নেই। আজ তাদের কেউ স্মরনও করে না। সুতরাং শুধু শুধু মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তো কোন লাভ নেই। মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার দিন, তাহলে জনগণের ভালোবাসায় আপনারা হবেন সত্যিকারের নায়ক এবং সম্রাট।
পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতন আজ বিশ^জুড়েই একটি সামাজিক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞানে আমরা যতই অগ্রসর হই না কেন নারী নির্যাতন কিন্তু বাড়ছেই। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশে দেশে, যেখানে নারীরা ভোগ করছে অবাধ স্বাধীনতা, যেখানে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ ছাড়া যৌন সম্পর্ক একটি স্বাভাবিক এবং স্বীকৃত বিষয়, সেখানেও নারীরা আজ ব্যাপকহারে নির্যাতনের শিকার। সেখানেও নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে এবং এসব দেশে নারী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি। এমনকি শিক্ষকের হাতে ছাত্রীরাও আজ নির্যাতিত হচ্ছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে নারী স্বাধীনতার অবাধ উপস্থিতি এবং যৌনতা এত সহজ হওয়া সত্তে¡ও পশ্চিমা বিশে^ নারীরা ধর্ষিত হবে কেন? সুতরাং এত আধুনিকতার প্রয়োজন কী? মনে রাখতে হবে, সংসারেই সুখ। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি মিলে বসবাসেই জীবনের স্বার্থকতা এবং এতেই মানুষের জীবন সুখের এবং শান্তির হয়। ঘর সংসার যদি না থাকে তাহলে এত আধুনিক হয়ে এবং ভালোবাসার গান গেয়ে লাভ কী? মিডিয়া জগতে যারা প্রতিনিতই ভালোবাসার অভিনয় করে আর ভালোবাসার গান গায়, তাদের অনেকের জীবনেই কিন্তু ভালোবাসা নেই, সংসার নেই। সত্য কথা বলতে কি এখনো যারা পারিবারিক মূল্যবোধকে আকড়ে ধরে আছে, তারাই কিন্তু জীবনে সুখী। আর যারা এসব না করে লাগামহীন জীবনকে বেছে নিয়েছে তাদের জীবন থেকে সংসার, সুখ এবং শান্তি সবই হারিয়ে গেছে। সুতরাং লাগামহীন জীবন বাদ দিন, সংযমী হোন এবং পরিমিত জীবন গড়ে তুলুন। দেখবেন নারীরা নির্যাতিত হবে না, কাউকে আত্মহত্যা করতে হবে না এবং সংসারও ভাঙবে না।
মাদকের ভয়াবহতা সমাজকে আজ গ্রাস করেছে। হাত বাড়ালেই এখন মাদক পাওয়া যায়। ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং হিরোইন এর উপস্থিতি সর্বত্র। মাদকের প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত হচ্ছে। অথচ ওরাই তো দেশের ভবিষ্যত, ওরাই তো দেশের কান্ডারী। সুতরাং পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা সন্তানদেরকে নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে নৈতিকতা শিক্ষা দিন। নৈতিক মূল্যবোধে গড়ে তুলুন। তাকে সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা শিক্ষা দিন। দুর্নীতি এবং মাদকমুক্ত জীবন গড়ার জন্য উপদেশ দিন। দেখবেন আপনার সন্তান সময়ের পরিক্রমায় একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং সে আপনার সম্মান বৃদ্ধি করবে। সে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আলোকিত করবে। তখন সন্তানের কর্মে আপনি ও হবেন গৌরবান্বিত। আর যদি নৈতিকতা শিক্ষা না দেন, তাহলে আপনার সন্তান হবে মাদকসেবক, সন্ত্রাসী, চাদাঁবাজ এবং দুর্নীতিবাজ। আর এটা কখনো পিতামাতার কাম্য নয়। দুর্ভাগ্য আজ ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হচ্ছে, সন্তানের হাতে পিতামাতা খুন হচ্ছে। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পথেই চলতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসা বাণিজ্য করুন। মানুষকে সঠিক মূল্যে পণ্য দিন। কেমিক্যাল এবং ভেজাল মুক্ত পণ্য বিক্রি করুন। ওজনে কম দিবেন না, অত্যাধিক মুনাফা করবেন না। সততা এবং নৈতিকতার সাথে ব্যবসা করুন। এতে আপনার সুনাম বাড়বে, কাস্টমার বাড়বে। সময়ের সাথে সাথে আপনার ব্যবসার পরিধিও বাড়বে, আপনার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বাড়বে। অন্যায় পথে তাড়াতাড়ি ধনী হবার চেষ্টা করবেন না। কারণ সেই উন্নয়ন টেকসই হয় না। শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে বলব, আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রতি সুবিচার করুন। তাদের সমস্যার কথা ভাবুন এবং তা দূর করার জন্য কাজ করুন। তাহলে তারা আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য মনে প্রাণে কাজ করবে। তখন আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হবেই। একই সাথে রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বলছি, অনুগ্রহ করে জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। জনগণকে ভালোবাসুন, জনগণের সেবা করুন এবং জনগণকে তার ন্যায্য অধিকার দিন। মনে রাখবেন, আপনারা হলেন জনগণের সেবক এবং শাসক, কিন্তু শোষক নন। জনগণকে ভালোবাসলে জনগণও আপনাদেরকে ভালোবাসবে। আর এটাই সত্যিকারের পাওয়া। তখনই আপনি হবেন স্মরণীয় এবং বরণীয়। তা নাহলে দু’দিন পরে আপনার অবস্থান হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে, যা কারো কাম্য নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন