ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী
কাজী নজরুল ইসলাম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন বলে তার কবিতায় ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল স্বাভাবিক প্রকাশ। কাজী নজরুল ইসলাম ভারতবষের্র মুক্তির আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন এবং আবেগকে স্পর্শ করেছেন তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় দিয়ে, সেই অভিজ্ঞতার রূপান্তর ঘটিয়েছেন শব্দসমবায়ে। ক্রোধে-ঘৃণা-প্রতিশোধস্পৃহা, ভালোবাসা-¯েœহমমতা এবং মুক্তির আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন বিদ্রোহী কবিতায়। কবিতার রচনাকাল সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথায় জানান্তবিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাত্রিতে। তার মতে, নজরুল বিদ্রোহী রচনা করেন ১৯২১ সালে কলকাতার ৩/৪ সি তালতলালেন বাড়িতে। মুজাফফর আহমদ আরও তথ্য যোগ করেন, প্রথমে বিদ্রোহী কবিতাটি পেন্সিলে লেখা হয়েছিল। কবিতাটি রচনার পর মুজাফফর আহমদকে নজরুল প্রথম শুনিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কবিতাটি সম্পর্কে কোনো অনুভূতি প্রকাশ না করায় মনঃক্ষুণœ হয়েছিলেন বলেও মুজাফফর আহমদ উল্লেখ করেছেন। এদিকে সুশীল কুমার সেনগুপ্ত জানিয়েছেন অন্য তথ্য, বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের শরৎ কালে। মাস-তারিখ-যা-ই হোক সময় ওই ১৯২১ সালেই, এ বিষয়ে ভিন্ন মত নেই।
১৯২১ সালের দিকে প্রথম বিশ্বযোদ্ধত্তর বিশ্বের অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী অবক্ষয়, নৈরাজ্য, ব্যক্তির একাকিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা নজরুলকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে। আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে তখন সামষ্টিকের পরিবর্তে ব্যক্তিক পর্যায়ে আত্মউন্মোচনের প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। ঠিক ওই সময়েই নজরুল প্রতিভার প্রকাশ। সময়ও তার জন্য প্রস্তুত ছিল। ফলে নজরুল মিটিয়েছেন সে সময়ের সবচেয়ে কঠিন দাবি।
আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস, বিবর্তনের ইতিহাস। এ বিবর্তন ঘটে প্রধানত আঙ্গিকে। আঙ্গিকে পরিবর্তন ঘটে মূলত ছন্দ-উপমা-চিত্রকল্পের অভিনবত্বে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্ষরবৃত্তকে পয়ারের চাল দিয়ে কবিতাকে করে তুলেছিলেন গীতিধর্মী। মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তেও কোমল ও গীতল শব্দ প্রয়োগ করে কবিতাকেই প্রায়-গান করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রস্বভাবের বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন স্বাদ মেজাজ এ কবির কবিতায়। অবশ্যই এই স্বাতন্ত্র কাজী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক দ্রোহ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। নজরুলের বজ্রনিনাদপূর্ণ উচ্চারণ রবীন্দ্রস্বভাবের কোমল কণ্ঠের বিপরীতে উজ্জ্বল করে তোলে। নজরুল একদিকে যুগমানস বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে যুগের দাবিও মিটিয়েছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযোদ্ধত্তর বাঙালির নিজস্ব স্বভাব ও স্বাধীকারের প্রশ্নে আত্ম-উদ্বোধন ঘটালেন বিদ্রোহী কবিতায়। তার কবিতায় বিশেষ সময়ের বিভীষিকা মূর্ত হয়ে উঠলো। এই লক্ষ্যে নজরুল শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগে হয়ে উঠলেন নির্বিচারী এবং চেতনায় বিক্ষিপ্ত। বিদ্রোহীর শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন নজরুল ইসলাম একই সঙ্গে বিক্ষিপ্ত চেতনার অধিকারী। তিনি বাংলা কবিতাকে তার শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপাভিব্যক্ত থেকে মুক্ত করে একটি উদ্দামতার মধ্যে হিল্লোলিত করলেন।
রবীন্দ্রস্বভাবের বিপরীত একটি নতুন কবি-স্বভাব আমরা নজরুল ইসলামের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। বিদ্রোহী কবিতাটির বাচন-ভঙ্গী পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, শব্দ নির্বাচনে কবির কোনো জাত-বিচার ছিল না। ভেদিয়া ছেদিয়া ভীম ভাসমান মাইন ঠমকি হরদম ভরপুর মদ তুড়ি দিয়া এই সমস্ত শব্দ এবং বাক্যাংশ নির্বিবাদে ব্যবহৃত হয়েছে তা নয় বিশেষ কোনো তাৎপর্যও এই পদগুলোতে নেই, কিন্তু দীর্ঘ কবিতার প্রবল ধ্বনিপ্রবাহে স্বার্থকতা। আবু হেনা মোস্তফা কামাল নজরুল-কাব্যে শব্দ ব্যবহারে যে বৈচিত্র্য তার বিশ্লেষণে আমাদের সমকালীন পÐিত সমাজে দুটি বিশেষ প্রবণতার দ্বারা প্রায়শ উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকেন। ১.ধর্মীয় ২. নন্দনতাত্তি¡ক।
এই দৃষ্টিকোণের দূরত্ব এত বেশি যে তাদের সমন্বয়ে কোনো অখÐ শিল্পদৃষ্টির উদ্বোধন প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। একথা সত্য যে নজরুল তার কাব্যে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতটা নন্দনতাত্তি¡ক ছিলেন তারও বেশি ছিলেন ধর্মচেতনাসঞ্জাত শব্দ ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী। এক্ষেত্রে তার কাছে শিল্পমূল্যের চেয়ে আবেগের সারল্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নজরুল নিজেই বলেছিলেন, আমি হিন্দু-মুসলমানদের পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিয়েছি। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যতই তার ধর্মীয় চেতনাসঞ্জাত শব্দ সমবায় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাঁড় করান প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। তেমনি একজন ছিলেন মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদ। ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মুসলেম ভারতে বিদ্রোহী কবিতাই কাজির কারামত হাজির হয়েছিল। তার পর ধূমকেতু প্রত্যেক সংখ্যায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে গরল উদগীরণ করিতেছে। এ উদ্দাম যুবক যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানী মাদ্দার ইহার মস্তিস্ক পরিপূর্ণ। নরাধম হিন্দু ধর্মের মানে জানে কি? এই রূপ ধর্মদ্রোহী কবিকে বিশ্বাসী মুসলমান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না।’ নজরুলের ধর্মীয়বোধ সম্পর্কে মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদ সংশয়ী হলেও তার বিদ্রোহী কবিতায় ভাব-ভাষা এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে তার আস্থা ছিল পরিপূর্ণ। ক্ষোভও ছিল ধর্মীয় কুপমন্ডকতায় নজরুলের আঘাতে। অন্যদিকে হিন্দু লেখকসমাজও বিদ্রোহীর আরবী, ফার্সি শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের সমন্বয় সাধনকে সহজভাবে নেননি। ফলে বিদ্রোহী কবিতাটি যে জাতির আত্ম-মুক্তির মন্ত্র হিসাবে উচ্চারিত সে কবিতাটিই ওই জাতির কয়েকজন ধর্মান্ধের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠে।
এ কবিতার ভাব-ভাষা ও শব্দব্যবহার নিয়ে কবিতাটি প্রকাশের পর থেকে অনেক আলোচকই নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে আলোচ্য বিষয় হলো কবিতাটির সা¤প্রতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং এর শিল্পমান।
কবিতাটির শুরু
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত
শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি
বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান
জ্বলে রাজ-রাগটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর
আমি চির-উন্নত শির!
চরম অবিন্যস্ততার মধ্যে সৃষ্টিকর্ম সাধিত হয় বিদ্রোহীর শুরুর স্তবক তার-ই সাক্ষ্যবহ। এবং ধীরে ধীরে মানবজীবনে নানা অব্যবস্থিতি ও অস্থিরতা এবং কারণের প্রতি কবির সংক্ষুব্ধ মনোভাব ফুটে ওঠে। এরই মধ্যে মানবজীবনের প্রেম ভালোবাসা, ঘৃণা, আশা-নিরাশা এবং চিত্তের চাঞ্চল্য প্রকাশিত। অর্থনৈতিকভাবে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তার পেছনে কবি, কেবল মানুষকেই দায়ী করেন না সঙ্গে প্রকৃতির প্রতিও তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ফলে নিজেকে ‘চিরদুর্দ্দম’ ‘দুবির্নীত’ ‘এলোকেশে ঝড়’ এর মতো নানা অভিধায় অভিষিক্ত করে বিধাতার প্রতিও ক্রোধ প্রকাশ করেন। এক সময় মনে হয়, অনেক দীর্ঘ মন্ত্রোচ্চারণ শেষে কবি কণ্ঠে নেমে আসে শান্তির আমেজ। কবি উচ্চারণ করেন,
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়নের
ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে
ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
শেষ উচ্চারণেও কবি নিজেকে অন্য সবার চেয়ে উচ্চাসনের সত্তা বলে ঘোষণা করেন। পুরো কবিতাটি অসম পঙক্তির মাত্রাবৃত্তের যে তান কবিতার ভেতর ভেতর সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে এ কবিতায় তা নেই। বিপরীতে আছে ভাষার প্রবাহমানতা এবং বক্তব্যের প্রয়োজনে ভরাট উচ্চারণ ভঙ্গি। এর ভারকেন্দ্রে রয়েছে একজন সাধারণ আমির বিশেষ আমিতে উত্তরণচেষ্টা। সে চেষ্টায় নজরুল সফল। আবু হেনা মোস্তফা কামাল কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন বিদ্রোহীর প্রতি বাংলা কাব্য-পাঠকের দৃষ্টি আরেকবার আকর্ষণ করা যেতে পারে। স্মরণীয় এই কবিতাটির জন্যেই নজরুল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ীভাবে বিদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হয়ে গেছেন। প্রশ্ন হলো, এই কবিতায় উল্লিখিত বিদ্রোহী কি কবি নিজে? উল্লেখ্য যে বিদ্রোহীর প্রথম স্তবকে চারবার এবং পরবর্তী তিন স্তবকে একবার করে একটি সম্বোধন বাক্য বল ঘুরে ঘুরে এসেছে। এ কবিতার শব্দ নির্বাচন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে নির্বিচারী ছিলেন এবং এর কারণগুলো যৌক্তিক ও স্পষ্ট। এ কবিতাটি বাঙালির আত্ম-জাগরণের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির বাঙালির আবেগের জায়গায় তীব্র আঘাত দেয়। এভাবে একটি জাতির বিশুদ্ধ আবেগকে আত্মীকরণ করে কবিতাটি হয়ে ওঠে জাতির আত্ম-জাগরণের মন্ত্র।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।