Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বারডেম : সমস্যা ও কতিপয় বিবেচনা

| প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ : বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এক কালের সরকারী নির্ভরতা ছেড়ে এখন ব্যাপকভাবে বেসরকারী পর্যায়ে বিকাশ লাভ করছে। এতে রোগীরা কতটা লাভবান হচ্ছেন বা সুফল লাভের মাত্রা কোন পর্যায়ে কতটা তা বলা সম্ভব নয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা যত বেশী চিকিৎসা সেবা সে তুলনায় অপ্রতুল। ফলে চিকিৎসা না পাওয়া ও চিকিৎসা লাভেচ্ছু রোগীর সংখ্যা অগণন। দেশের স¦াধীনতা লাভের পর থেকে স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি যে হয়নি তা নয়, কিন্তু ক্রমাগত হারে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সে সামান্য উন্নতি সুফল বয়ে আনতে পারছে না। তাই, দেশে মোটামুটি রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আস্থা সংকট অব্যাহত থাকায় রোগীদের বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছেই।
দেশে বেসরকারী চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগগ্রতি সংঘটিত হয়েছে।  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুসংখ্যক হাসপাতাল। যেমন স্কয়ার , ল্যাবএইড, অ্যাপোলো, ইউনাইটেড ইত্যাদি। সেগুলোতে  বিেেদশী চিকিৎসক যেমন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও হাজির থাকেন।  এ সব হাসপাতালে চিকিৎসার  মান ভালো, কিন্তু ব্যয় এত বেশী যে নি¤œবিত্তদের পক্ষে সেগুলোতে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে তারা কেউই আস্থা অর্জনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।  যে কারণে দেশের মহামান্য প্রেসিডেন্টকেও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সিঙ্গাপুর ও চোখের রোগের সমস্যায় যুক্তরাজ্য পর্যন্ত দৌড়াতে হয় যা কিনা এ ডিজিটাল বিশে^ চিকিৎসাক্ষেত্রে দেশের সুনামের সাথে সঙ্গতিশীল নয়।  
দেশের বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে বারডেম (বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিক ডিজঅর্ডার গবেষণা ও পুনর্বাসন সংস্থা) হাসপাতাল অন্যতম।  সাধারণ কথায় নীরব ঘাতক রোগ ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য মানব দরদী চিকিৎসক  ডা. মোহাম্মদ ইবরাহিম  ১৯৮০ সালে শাহবাগে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে  ১৯৮৯ সালে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের সহযোগিতায়  বারডেম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত বারডেম ডায়াবেটিস রোগীদের যে চিকিৎসা সুবিধা দিয়ে আসছে তার কোনো তুলনা হয় না। দেশের ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বাংলাদেশে এটিই একমাত্র নির্ভরতার স্থল। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি একাধিক স্থানে চিকিৎসা সুবিধা সমú্রসারিত করেছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা আজো নিতান্তই অপ্রতুল।
বারডেমে প্রতিদিন কী পরিমাণ রোগীর আগমন ঘটে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। শুধু ডায়াবেটিস সংক্রান্ত সমস্যাই তাদের এখানে আগমনের কারণ। কিন্তু যে কথা না বললেই নয় তা হচ্ছে বারডেম এখন আর গরীব ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার অভয়াশ্রম নয়। একজন সাংবাদিক বন্ধু জানালেন, ডা. ইব্রাহিম মূলত গরীব ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতাল চালু করেন। তখন গরীব ডায়াবেটিস রোগীরা স্বল্পমূল্যে এখানে চিকিৎসা সেবা পেত। তিনি সে ব্যবস্থাই করেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সব কিছু পাল্টে দেয়।  এখানে এখন টাকা ছাড়া কোনো চিকিৎসা হয় না। বারডেমে জটিল রোগীদের চিকিৎসা নিতে হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার ব্যয় বিপুল।  দৈনিক কেবিন ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা এবং ওয়ার্ডে দৈনিক সিট ভাড়া  ১৫০০ টাকা।  এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা ও ওষুধ পাতির খরচ তো আছেই। যারা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তাদের পক্ষে দৈনিক এ পরিমাণ  টাকা ব্যয় করা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু নি¤œ আয়ের লোকদের কথা একবার ভাবুন তো! তারা কী করবেন? বাস্তবে তাদের ডায়াবেটিস ও এতদসংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা যে কারণে দেশে ডায়াবেটিক রোগীদের মৃত্যু হার দ্রæত বাড়ছে।  
ডায়াবেটিস রোগসহ আরো কিছু জটিলতার কারণে  নিরুপায় হয়ে ১১ মে আমি বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হই। দু’টি অপশন ছিলঃ হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকায় কেবিন নয় ১৫শ’ টাকায় ওয়ার্ড।  শেষ পর্যন্ত কেবিনেই থাকার সিদ্ধান্ত হয়।  দুপুর ১টায় অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে কেবিন বুকিং দেয়া হল। সে কেবিন পাওয়া গেল বিকেল সাড়ে ৫টায়। কেন এ বিলম্ব, তা জানার ব্যবস্থা নেই। যাহোক, ২৫ মে পর্যন্ত আমার অবস্থানকালীন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায়  সামান্য কিছু ত্রæটি চোখে পড়েছে।  তা নিয়ে কোনো ডাক্তারের সাথে কথা বলিনি। সে সুযোগ নেই। তাছাড়া আমি কে যে তারা সে কথার জবাব দেবেন?  এ ক’দিনে আমাকে যে সব প্রফেসর দেখেছেন তাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগের কিছু নেই। কিন্তু ভারতের চেন্নাইয়ের মিওট হাসপাতাল আর কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার যে সামান্য অভিজ্ঞতা আমার আছে তাতে মনে হয়েছে বারডেমের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা রোগীদের আরো খানিকটা করে সময় দেয়ার কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারেন। ২. আমার মনে হয়েছে যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও তার সহযোগী ডিউটি ডাক্তারের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে আরো আলোচনা করা উচিত। তাতে রোগীরা আরো উপকৃত হবেন।  ৩. বারডেম ব্যয়বহুল চিকিৎসাকেন্দ্র। কিন্তু কোনো রোগীকে আগে থেকে নোটিশ  না দিয়ে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে  দশ মিনিটের মধ্যে ৩০-৩৫ হাজার টাকা জমা দিতে বলার ঘটনাগুলো পরিহার যোগ্য। এটা সময় বিশেষে ভীষণ লজ্জাকর। কারণ তার হাতে ঐ মুহূর্তে ঐ পরিমাণ অর্থ নাও থাকতে পারে।  এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত।  ৪. বারডেমে চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মেশিন (ইআর সিপি)। ২১ মে এ মেশিনে আমার অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। আমি ১০ টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মেশিন নষ্ট হয়ে যায়।  জানা যায়, বুধবার ছাড়া অপারেশন হবে না। এ অপারেশনের ফি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।  মেশিন নষ্ট হওয়ায় আমাকে ৩ দিন বারডেমে  অতিরিক্ত অবস্থান করতে হয়। এ সময়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩ হাজার টাকা প্লাস ওষুধ ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে  অতিরিক্ত ১৫-১৬ হাজার টাকা গুণতে হয়েছে। বারডেমের মত হাসপাতালে মেশিন নষ্ট হলে তার বিকল্প ব্যবস্থা নেই।   এ রকম ঘটনায় মানবিক কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা বারডেম কর্তৃপক্ষ করতে পারেন।  ৫. আমার কাছে এবং আরো বহু মানুষের কাছে যা ভীষণ দুর্ভোগজনক মনে হয়েছে তা হচ্ছে বারডেমের লিফট সংকট। বারডেমে সম্ভবত ৫-৬টি লিফট চলমান। এর মধ্যে একটি ডাক্তার ও স্টাফদের জন্য। অন্য লিফটগুলোর কোনো কোনোটি  কখনো অচল হয়ে থাকে। বাকি চালু লিফটগুলো দিয়ে রোগী ও স্বজনদের ভিড় সামাল দেয়া সত্যিই অসম্ভব। আমার সাথে দেখা করতে আসা কেউ কেউ লিফটের জন্য ২০ মিনিট থেকে আধা ঘন্টা সময় অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।  এতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বারডেম কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তাদের করণীয় কিছু থাকলে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারেন। ৬. বারডেমে প্রতিদিন বহু রোগী আসেন, ভর্তি হন, চলে যান। রোগীদের বিভিন্ন সমস্যা ও তাদের অভিযোগের বিষয়টি মাথায় রেখে বারডেম কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠার একটি পন্থা বের করতে পারে।  
বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীদের ভরসার বড় কেন্দ্র বারডেম। দেশের দরিদ্র ও স্বল্পবিত্ত শ্রেণির অসংখ্য মানুষ এখন ডায়াবেটিসের মত ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত। এ শ্রেণির মানুষ যত না রোগ মুক্ত হয় তার চেয়ে অনেক বেশী সংখ্যায় মারা যায়।  ডায়াবেটিসের চিকিৎসাকে তাদের জন্য সহজলভ্য ও স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ করা উচিত।  সবার পক্ষে জমি-জমা, মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে বারডেমে অবস্থান করে বিরাট ব্যয় সামাল দিয়ে এ চিকিৎসা চালানো সম্ভব নয়।  সবার এ সব নেইও। কিন্তু দরিদ্র ও অসহায়দেরও তো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে কেবিন ভাড়া হ্রাস, ওয়ার্ড সিট ভাড়া বর্তমানের এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারটি  সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার। বারডেম কর্তৃপক্ষ, স¦াস্থ্য মন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার জনগণের স্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখলে দেশের অসংখ্য নিরুপায় মানুষের বড় উপকার হবে। বারডেম জনমানুষের আরো আস্থাভাজন ও ভরসার কেন্দ্র হবে।
লেখক : সাংবাদিক,  কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন