ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মাহমুদ ইউসুফ : জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার নারী ও শিশু দালালের হাতে পড়ে পাচার হচ্ছে। এদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার এবং মেয়েশিশু প্রায় ১০ হাজার। ভারতের সমাজকল্যাণ বোর্ডের সূত্র মতে, ভারতে মোট ৫ লাখ বিদেশি পতিতা রয়েছে, যার অধিকাংশই বাংলাদেশি। দিল্লি ও কলকাতায় এদের সংখ্যা অনেক বেশি। এছাড়াও বাহরাইন, সৌদি আরব, লেবানন, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখের বেশি নারী শিশু পাচার হয়েছে ভারতে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন এনজিওর দাবি, পাচারের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। এর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে থাকে। ইউনিসেফ ও সার্কের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ হতে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার নারী-শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত এদেশ থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ নারী ও শিশু পাচার হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব জুড়েই রয়েছে পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা গরিব ঘরের ছেলে, মেয়ে ও নারীদের পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করে। বিভিন্ন কারণে শিশুদের পাচার করা হয়। যেমন- পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত, পর্নোগ্রাফি সিনেমায় ব্যবহার, মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা, শরীরের রক্ত বিক্রি করা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ব্যবসা, মাথার খুলি, কঙ্কাল রপ্তানি করা, চৌকস শিশুদের মগজ ধোলাই করে অস্ত্র ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন দেশে অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রেরণ। বাংলাদেশ থেকে যত শিশু পাচার হয় তার অধিকাংশই প্রবেশ করে ভারতে। বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশ থেকেও ভারত শিশু পাচার করে। এমনকি ইউরোপ থেকে পাচারকৃত শিশুদেরও উদ্ধার করা হয় হিন্দুস্তান থেকে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) থেকে মানব পাচার নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে শিশু পাচার বেশি হচ্ছে। গোটা বিশ্বে যত মানব পাচারের ঘটনা ঘটে, তার ৭০ শতাংশের শিকার নারী ও শিশু। আবার প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটি শিশুই কন্যা।
দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে পণ্য সামগ্রী পাচারের পাশাপাশি নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। এসব অঞ্চলের ১১টি রুট পাচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল একটি অত্যন্ত সহজ ও সুপরিচিত রুট। এখান থেকে বাস ও ট্রেনের যোগাযোগ খুব ভালো হওয়ায় পাচারকারীরা খুব সহজেই কলকাতা পৌঁছে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও শহরটি বেনাপোল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে গোটা বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা নারী ও শিশুদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। বৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই হোক আর অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমেই হোক পাচারের উদ্দেশ্যে বড় ধরনের কোনো কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য তাদেরকে বনগাঁওয়ে নিয়ে আসা হয়। বেনাপোল ছাড়া যশোর থেকে পাচারকারীরা সাধারণত ভোমরা, কলারোয়া, দর্শনা, জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। ভারতীয় পাচারকারী, হস্তান্তরিত নারী ও শিশুকে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ের পতিতালয়ে বিক্রি করে। নারী ও শিশু বিক্রয়ের জন্য কলকাতা নিরাপদ স্থান হিসেবে পরিচিত। আর মুম্বাই নগরীকে পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যশোরের অধিকাংশ ট্রানজিট পয়েন্টের সাথে ভারতের বিশেষ করে চব্বিশপরগনার পয়েন্টগুলোর সূ² যোগাযোগ রয়েছে।
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রণীত হয় এবং ২০০৩-এ এই আইনের কিছুটা সংশোধনী দেয়া হয়। এই আইনে পাচারকে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় এবং পাচারকার্যে নিয়োজিতদের শাস্তির বিধান রাখা হয়। এই আইনের ধারা ৬-এ বলা হয়েছে, ১. যদি কোন ব্যক্তি কোনো বেআইনি বা নীতিবহির্ভূত উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে বিদেশ হইতে আনয়ন করেন বা বিদেশ প্রেরণ বা পাচার করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা উক্তরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে নিজ দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন। ২. যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, শিশু বা মাতৃসদন, নার্সিং হোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবকের হেফাজত হতে চুরি করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। বলা বাহুল্য, আইন থাকা সত্তে¡ও প্রতিনিয়ত পাচারের ঘটনা ঘটছে।
শিশু পাচার রোধে প্রয়োজন সুশাসন, ইনসাফপূর্ণ সমাজ কায়েম, আদালতে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, বিজিবির সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উৎকোচ বাণিজ্য বন্ধ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দালালদের চিহ্নিতকরণ ও যথাযথ শাস্তিদান, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, জনসচেতনতা, সর্বোপরি মানুষকে কুরআনিক তথা অহির শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মহানবি (স.) ও খুলাফায়ে রাশেদিনের আদর্শ বাস্তবায়ন। এছাড়া শিশু পাচার বন্ধ করা অসম্ভব।
লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।