Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

স্বপ্ন দেখাচ্ছে চীনের সিল্ক রোড

| প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : বাণিজ্যের প্রাচীন পথ সিল্ক রোডকে ফিরিয়ে আনতে চীন সরকার যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি দেশে দেশে স্বপ্নের বীজ বুনছে। স¤প্রতি এ সংক্রান্ত এক শীর্ষ সম্মলনে অংশ নিয়ে রাশিয়া, ব্রিটেন, তুরস্ক আর পাকিস্তানের মতো দেশগুলো চীনের এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই উদ্যোগে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও।
উদ্যোগটির অংশ হিসাবে চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর (সিপিইসি) নামে যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে, বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের ভূমি ছূঁয়ে যাওয়ায় এর বিরোধিতা করছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ভারত। বেলুচিস্তানসহ পাকিস্তানের ভেতরে কোন মহল থেকে এর বিরোধিতা এসেছে। তবে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি এটা নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী হয়ে উঠছেন। পাকিস্তানে সিল্করোড নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় যে সমস্যা হচ্ছে, সেটা আরও অনেক অঞ্চলেই হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
২০১৩ সালে চীন এই উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামার পর এশিয়ার প্রভাবশালী শিল্পোন্নত দেশ জাপানকেও সক্রিয় হতে দেখা গেছে। ২০১৫ সালে দেশটি এশিয়াজুড়ে অবকাঠামো খাতে ১১০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্প নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত কোনো একক অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে জার্মানির অর্থনীতি মন্ত্রী ব্রিগিটে সিপ্রিস বেশ কিছু পূর্ব শর্ত দিয়েছেন। তিনি স্বচ্ছতা, টেন্ডারে সততা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক মান রক্ষার অঙ্গীকার চেয়েছেন।
জার্মানির অর্থনীতিমন্ত্রী এমন উদ্যোগ নিয়ে এমন সব শর্ত দিয়েছেন যে, উদ্যোগ সম্পর্কে সাধারণ তথ্য জানাও বেশ কষ্টকর। অন্যদিকে এই প্রকল্পকে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখতে চীন আহŸান জানালেও এটা নিয়ে সন্দেহ সংশয় রয়েছে দেশটির আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব প্রতিদ্ব›দ্বী দেশের মধ্যেই।
চীনের ‘নতুন সিল্ক রোড’ -ধারণা ও বাস্তবতা
প্রাচীন সিল্ক রোড ফিরিয়ে আনতে চীনের প্রেসিডেন্টের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা দেখাতে এই সপ্তাহেই দেশটি একটি শীর্ষ সম্মেলন করে। এখানে ব্রিটেন রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্কের মতো দেশ চীনের এই স্বপ্নের প্রতি সমর্থন জানান। এ শীর্ষ সম্মেলনে চীন বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ১২৪ বিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেন। চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও প্রায় ৯০০টি প্রকল্পে ৮৯০ বিলিয়ন ডলারের জোগান দেবে বলে বলা হয়। এ টাকায় দেশটি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকাজুড়ে রেলপথ, নৌপথ ও সড়কপথ করতে চাইছে। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘নতুন সিল্ক রোড’ হিসাবে পরিচিত ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড (ওবিওআর)’ নামের এই উদ্যোগ শুরু করেন।
প্রাচীন সিল্করোড ধরে তিন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে সড়কপথ, রেলপথ, সমুদ্রবন্দর, পাইপলাইনের মতো অবকাঠামো তৈরি করে যোগাযোগের নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় দেশটি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে অন্যদেশগুলোর বাণিজ্য বেড়ে যাবে। শীর্ষ সম্মেলনের আগেই দেশটি জানিয়েছিল, এরই মধ্যে ৬৫টি দেশ এই উদ্যোগে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারপরও প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাবে এর অগ্রগতি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু এখনো বলা যাচ্ছে না।
যা জানা গেছে
এ উদ্যোগের অংশ হিসাবে যেসব প্রকল্প করা হচ্ছে, তা থেকেই পুরো উদ্যোগ সম্পর্কে কিছু কিছু জানা যাচ্ছে। চীনের নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই উদ্যোগকে নীতি-নির্ধারণী জায়গায় রাখা আছে, যার জন্য বিপুল অর্থের জোগান দেয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগে এরই মধ্যে চীনের সরকারি তহবিল থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের জোগান দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে চীনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করা এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও (এআইআইবি) এখানে অর্থ জোগানের অন্যতম উৎস।
ফ্রান্সভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আইএফআরআই-র চীন বিষয়ক বিশ্লেষক অ্যালিস একম্যান বলেন, উদ্যোগটি খুবই ‘ফ্লেক্সিবল›। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রয়োজন ও ইচ্ছার ভিত্তিতে প্রকল্পে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়। নতুন করেও যে কেউ এতে অংশ নিতে পারবেন।
যোগাযোগে চীনের দূরদর্শিতা
এ উদ্যোগে একটি সার্বজনীন যোগাযোগ কৌশল নিয়েছে চীন। এটা এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, যা থেকে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ উপকৃত হতে পারে। এটাকে ভূ-কৌশলগত পরিকল্পনা হিসাবে না দেখে কেবল অর্থনৈতিক প্রকল্প হিসাবে দেখার আহŸান জানিয়েছে চীন।
আধুনিক সিল্করোড, প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা
জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র তীব্রভাবে চীনের এই উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে। বৃহৎ শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কেবল এই দু’টি দেশই এআইআইবি-তে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জাপান ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিক শত্রুতা রয়েছে। পূর্ব চীন সাগরে সীমানা নিয়েও বিরোধও রয়েছে।
চীনের দ্রæত বিকাশমান অর্থনীতির কারণে টোকিও বেশ উদ্বেগে আছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলন অংশগ্রহণ প্রশ্নাতীতই ছিল। তিনি বরং কূটনীতির অন্য অংশে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে জাপান এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অবকাঠামো প্রকল্পে ১১০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। চীনের এই উদ্যোগ কীভাবে আঞ্চলিক দ্ব›েদ্ব প্রভাব বিস্তার করবে তা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পের অংশ হিসাবে চীন ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। তা দিয়ে দেশটিতে রাস্তা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং গেভাডার শহরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করা হবে। এ উদ্যোগ পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›দ্বী ভারতের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত সিপিইসি প্রকল্পের আংশিক বিরোধিতা করছে, কারণ, এই করিডোর বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের উপর দিয়ে গেছে। ওবিওআর শীর্ষ সম্মলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ অংশ নিয়েছেন। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অংশ নেননি। এই উদ্যোগেও ভারতের অংশগ্রহণ এখন অনিশ্চিত।
মধ্য এশিয়া ও রাশিয়া
এই উদ্যোগের কেন্দ্রে রয়েছে মধ্য এশিয়া। বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকায় এই এলাকা নিয়ে চীনেরও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের সবক’টি দেশ সমানতালে চীনের ঋণ ও বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে আসছে। এ উন্নয়ন কাজে অঞ্চলজুড়ে প্রভাব কমার আশঙ্কায় কিছুটা উদ্বেগে রয়েছে রাশিয়া। এ কারণে রাশিয়াও ইউরেশিয়ান ইকোনোমিক ইউনিয়ন নামে একটি নিজস্ব উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক সামর্থের কারণেই মস্কো কার্যকরভাবে বেইজিংয়ের সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারছে না। তবে ইউক্রেন-দ্ব›দ্ব, পরবর্তী পশ্চিমাদের আরোপ করা অবরোধ, ভূ-রাজনৈতিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থে দেশটি ক্রমে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। শীর্ষ সম্মেলনে পুটিন অংশগ্রহণ করছেন। এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। রাশিয়া চায় চীন থেকে ওই রেলপথ যেন তাদের ভূমির উপর দিয়ে যায়।
লক্ষ্য ইউরোপ
ইউরোপের এশিয়ার সাথে যোগাযোগ বিস্তৃত করার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। এটা ইউরোপীয় অর্থনীতিকে উপকৃত করবে। বিশেষ করে, জার্মানির মতো রপ্তানিমুখী অর্থনীতিকে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ওবিওআরকে ইউরোপীয় উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে ‘ইইউ-চায়না কানেক্টিভিটি প্ল্যাটফর্ম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চীনের এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে গ্রিসের পিরাওয়ি বন্দরের মতো ইউরোপে যে বিনিয়োগ এসেছে, সেটা এ পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিকভাবে হয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে সকল ইইউ সদস্যকে একটি অভিন্ন অবস্থান নিতে আহŸান জানানো হয়, যাতে চীন ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ কৌশলে অসুবিধায় ফেলতে না পারে। সূত্র : ডয়েচে ভেলে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ