ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : মানুষ দিনে দিনে হিংস্র হয়ে উঠছে। মানবিকতা, মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি, এমনকি বিবেচনাবোধও হারিয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। কোথাও যেন এতটুকু স্বস্তির জায়গা নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে শান্তির নিঃশ্বাস নেয়া যায়। সবর্ত্র বিরাজ করছে হাহাকার আর মজলুম মানুষের আর্তনাদ। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন ভুলন্ঠিত হয় তখন বিপর্যস্ত হয় ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ। দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। তারপরেও মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। গৃহকর্মীর মৌলিক অধিকার শূন্যের কোঠায়। কান পাতলেই গৃহকর্মীর নির্যাতনের আর্তচিৎকার শোনা যায়। গৃহকাজে সহযোগী হিসেবে আমরা গরিব ঘরের শিশু, কিশোর ও নারীদের নিয়োগ দেই। কিন্তু এই গৃহকর্মীদের দুঃখ-কষ্টের কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। দু’মুঠো ভাত আর একটু শান্তির আশায় তারা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি পরিবারের চার দেয়ালের ফ্রেমের মধ্যে বন্দী থাকে। বন্দী জীবন কখনও সুখের হয় না এটা কম বেশি সবাই জানি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসই তাদেরকে বন্দী জীবনের ফ্রেমে আটকে দেয়। গৃহকর্মীর উপরে নির্যাতনের স্টিম রোলার প্রয়োগ করা হলেও অনেক সময় তা অজনাই থেকে যায়। এই দেশে গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন নয়। কি গ্রাম কি শহর সবর্ত্র তাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিভীষিকা সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলালেই দেখা যায়। আমাদের দেশে গৃহকর্মী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন যারা গৃহকর্মীকে মানুষই মনে করেন না। অনেক পরিবারের গৃহকর্মীদের চেহারাই বলে দেয় এরা কাজের মানুষ।
পৃথিবীতে কেউ গৃহকর্মী হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে না। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের আশায় অন্যের বাসায় কাজ করতে গিয়ে তাদের নাম হয় গৃহকর্মী। ইসলাম গৃহকর্মীদের যে অধিকার দিয়েছে তা যদি রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে ১০ বছরের জাহানারা খাতুন চুমকির জীবন এভাবে বিপন্ন হতো না। রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে চুমকিকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। আমরা হয়তো বীথির কথা ভুলে গেছি। নির্যাতিত শিশু বীথিকে সাতক্ষীরার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল ইসলামের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সমাজের অনেক ঘটনাই তো আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। এই অপসংস্কৃতি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা বীথি কিংবা চুমকিদের মতো হাজারো গৃহকর্মীর জীবন আগুনের ছ্যাকায় ঝলসে যাবে। মা-বাবাহীন একটি শিশুকে কেউ যে এভাবে নির্যাতন করতে পারে, তা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। একজন প্রকৌশলী কিংবা জাতীয় ক্রিকেট দলের পেসার তো আর সাধারণ কোনো মানুষ নন। তাদের বাসায় যখন শিশু গৃহকর্মী নির্যাতিত হওয়ার সংবাদ মুদ্রিত হয় তখন সত্যিই মনে দাগ কাটে। গৃহকর্মীর ওপর হরহামেশাই চলছে নির্যাতন। শিশু গৃহকর্মী থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও রেহাই পাচ্ছে না। মালিক আর গৃহকর্মীর সম্পর্ক যেখানে মধুর হওয়ার কথা, সেখানে মালিক আর গৃহকমীর সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু আর চাকরের মতো। নিজ সন্তানের হাজারো অপরাধকে যেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্যই করা হয় না, সেখানে পান থেকে চুন খসলেই গৃহকর্মীর ওপর নেমে আসে নিষ্ঠুরতার বিভীষিকা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ভাষ্যমতে, গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে ৩৭ জন গৃহকর্মী। আর গত পাঁচ বছরে মারা গেছে ১৮২ জন। দেশে বিভিন্ন বয়সী গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরদের প্রায় ৮০ শতাংশই শিশু। গত এক বছরে ৬০টি গৃহকর্মীর নির্যাতনের ঘটনায় ৪৭ জন আক্রান্তের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে ২৩টি ঘটনায় আক্রান্তের বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। গত এক বছরে ২৬ জন গৃহকর্মী গৃহকর্মে নিয়োজিত অবস্থায় মারা গেছে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪২ জন। এ ছাড়া ১৫ জন গৃহকর্মী এই সময়ে আত্মহত্যা করেছে। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের পরিসংখ্যানে গৃহশ্রমিক দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের চিত্রে এমনটাই দেখা গেছে। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ প্রণয়নের পরও তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কাজ করতে গিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের ভাগ্যে সুবিচার জোটেনি। কিন্তু এখন এসব নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৃশংসতা। এমনকি মারতে মারতে মেরে ফেলার ঘটনা এখন প্রায়ই উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
শিশু গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা গেলে গৃহকর্তা বা গৃহকত্রীদের নির্যাতনের হাত থেকে গৃহকর্মীদের জীবন কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এ মহৎ উদ্যোগটি গ্রহণ করে শিশু গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। তবে এটাও ঠিক মানুষের মধ্যে যদি ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি জাগ্রত না করানো যায় তাহলে গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র-সমাজ এ বিষয়টি উপলব্ধি করে গৃহকর্মীর ওপর নৃশংসতা বন্ধে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।