ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোহাম্মদ আবু তাহের : যে কোন রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্মগত অধিকার হলো সুবিচার প্রাপ্তি। ন্যায়বিচার স্বাধীনতা ও আইনের চোখে সমতা সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি। যদি কোন অসহায় ব্যক্তি অস্বচ্ছলতার জন্য তার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে ন্যায়বিচারের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যকে সফল করার লক্ষ্যে অস্বচ্ছল ও অসহায় ব্যক্তিদের আদালতের মাধ্যমে তাদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা রাষ্ট্রকর্তৃক আইনগত সহায়তা প্রদানের যে পদক্ষেপ নেয়া হয় তাকেই আইনগত সহায়তা বা লিগ্যাল এইড বলা হয়।
অর্থাৎ আইনগত সহায়তা বলতে বুঝায় দ্ররিদ্র বিচার প্রার্থীকে আদালতের আভ্যন্তরীন এবং বাহ্যিক উভয়দিকে আর্থিক সহযোগিতা করা। আধুনিক বিচার ব্যবস্থায় আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাওয়া অত্যন্ত ব্যয় বহুল। সুবিধা বঞ্চিত মানুষের আদালতের খরচ বহন করা অত্যন্ত দূরূহ ব্যাপার। দরিদ্র মানুষের কাছে ন্যায় বিচার দুরূহ বিষয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজ প্রতিষ্ঠা, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা হয়েছে আইনের চোখে সবাই সমান এবং বৈষম্যহীনভাবে আইনের সুরক্ষা পাবার অধিকারী। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদ ৩১ এ আইনের আশ্রয় লাভের এবং ৩৫ অনুচ্ছেদে বিচার লাভের অধিকার এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে এবং অনেক মানুষ নিরক্ষর। নিরক্ষর ও সুবিধা বঞ্চিত হত দরিদ্র মানুষ আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে আদালতে যাওয়া অনেক কঠিন। কারণ আদালতে যেতে হলে অর্থের প্রয়োজন। অ্যাডভোকেট নিয়োগ, কোর্ট ফি প্রদান সবকিছুতেই অর্থের প্রয়োজন। একজন অতি দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে অর্থ যোগার করে বিচার লাভের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। এজন্য দরিদ্র মানুষের বিচার পাওয়ার জন্য দেশে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন রয়েছে। এ আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ আইন সম্পর্কে অনেক মানুষের কোন ধারনা নাই।
আইনের শাসনের প্রধানত তিনটি উপাদান রয়েছে- ১) যথার্থ আইনি প্রক্রিয়া ২) আইনের যথাযথ প্রয়োগ ৩) আইনের আশ্রয় লাভের ও ন্যায় বিচার পাওয়ার সুযোগ (একসেস টু জাস্টিস)। কিন্তু আমাদের দেশের দরিদ্র ও অসহায় মানুষ সচেতনতার অভাবে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরামর্শ, উপদেশ ও মামলা পূর্ববর্তী আলোচনা আইনগত সহায়তার অন্তর্ভূক্ত। আইনগত সহায়তা প্রদান সমাজ সেবা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। দরিদ্র মানুষ যখন জেল হাজতে বা পুলিশের হেফাজতে থাকে তখন আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারায় অনেক সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আইন বঞ্চিত ব্যক্তির জন্য তখন সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সমান সুরক্ষা এবং আইনকে সমান ব্যবহারের সুবিধা শুধু কাগজেই থেকে যায়। দেশের অনেক গরীব মানুষ জানেই না যে, গরীব হলে তার মামলা সংশ্লিষ্ট খরচ সরকার বহন করবে। ফলে তারা এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেজন্য এ সেবাটি সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রচার প্রচারনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
দেশের মানুষকে তথ্য সমৃদ্ধ করতে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও প্রণীত হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের মূল চেতনাই হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। দেশের দরিদ্র মানুষ যদি আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সম্পর্কে না জানেন তাহলে এ আইনের সুফল থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। এজন্য প্রয়োজন এ আইন সম্পর্কে দরিদ্র মানুষকে সচেতন করা।
দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সম্পর্কে জনগণের সচেতনতার জন্য নিম্নে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো।
আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে নিয়মিত ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা।
তথ্য অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান চিত্র পরিদর্শক দলের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে চলচ্ছিত্র আকারে এ আইনের অস্তিত্ব ও প্রয়োগ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা।
বিভিন্ন এনজিও যারা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত তাদের মাধ্যমে গরীব মানুষদের এ আইন সম্পর্কে সচেতন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যেমন ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের এ আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে তা তৃণমূল পর্যায়ে অবহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
আইনজীবীদের সঙ্গে অসহায় দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের সাক্ষাৎ ঘটলে তখন যাতে ঐ বিচার প্রার্থীগণ আইনের সুফল পেতে পারেন এ ব্যাপারে আইনজীবীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্য বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
এ আইনটি একটি যুগান্তকারী আইন। যারা গরীব হওয়ার কারণে বিচার বঞ্চিত তাদের বিচার পাওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার সেটি দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণীত এ আইনটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশে প্রচুর মানুষ রয়েছে যারা সহায় সম্বলহীন। প্রকৃত সত্য এই যে, মামলা মোকদ্দমার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের বেশীর ভাগই অশিক্ষিত ও সহায় সম্বলহীন এবং যারা মামলায় টাকা খরচ করতে পারে না। তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ারও কোন উপায় থাকে না। অনেকে আদালতের দ্বারস্থ হলেও অভাব অনটনের কারণে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন না। এমতাবস্থায় দরিদ্র মানুষের আইনগত অধিকার ভোগ করতে সরকার কর্তৃক আইনগত সাহায্য প্রদানে এগিয়ে আসার বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস ঘোষণা ও উদযাপন :-
দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণকে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করার পক্ষে সরকার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ কার্যকরের তারিখ ২৮ এপ্রিলকে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস ঘোষণা করেছে। যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাদেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে এ দিবসটি উদযাপিত হয়। যার ফলে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়। জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য এটিও একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হয়।
আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন :-
সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ এর সংশোধনী আনা হয়েছে। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) আইন ২০১১ পাসের মাধ্যমে জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এ আইন কার্যকর ও প্রয়োগ করতে সংশোধনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় বলে মনে করি।
আইনগত সহায়তার বিষয়টি এখন শুধু গরীব মানুষের আইনি সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং আধুনিক বিশ্বে এ বিষয়টি একটি পৃথক ধারণার জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে এটি শুধু মামলাকারী অসহায় গরীব ব্যক্তিকে সাহায্য করাকেই বুঝায় না, বরং আর্থিকভাবে সচ্ছল নয় এমন মানুষের সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের দেশের প্রকৃত চিত্র হচ্ছে আইনকানুন ও কোর্ট-কাচারি মানেই প্রচুর টাকার ব্যাপার। টাকা না থাকলে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া যায় না। মুহুরী ও দালালদের দৌরাত্ব্যকে মোকাবেলা করে মামলা পরিচালনা করা একজন গরীব মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। তাই অনেক সময় এসব মানুষ আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে এখনো বিপুল সংখ্যক নারী পুরুষ রয়েছেন যারা সামান্য টাকার জন্য তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। কোনো কল্যাণমূলক ও স্বাধীন রাষ্ট্রে তা কাম্য হতে পারে না। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এসব বিচারপ্রার্থী মানুষের আইনি সহায়তা প্রদানের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য না জানার কারণে অনেক বিচারপ্রার্থী লিগ্যাল এইডের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। এ সমস্ত মানুষকে জানাতে হলে ব্যাপকভাবে প্রচারনা চালাতে হবে। বিচারপ্রার্থী দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে মাননীয় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে সরকার এর লিগ্যাল এইড কমিটি রয়েছে। বিভিন্ন জেলায় বরাদ্দকৃত লিগ্যাল এইডের টাকা দরিদ্র বিচারপ্রার্থী মানুষের জন্য খরচ করতে হয়নি যা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। কোনো কোনো জেলায় বরাদ্দের বেশীরভাগ পড়ে থাকে সরকারের কোষাগারে। এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণ ও মক্কেলদের সচেতন করতে বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারেন।
রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনি সহায়তা যত জোরদার হবে, অসচ্ছল ও সহায় সম্বলহীন মানুষের আইনি প্রতিকারের পথ তত প্রশস্ত হবে।
আইনগত সহায়তা কার্যক্রম রাষ্ট্রের কোন দান বা করুনা নয়। এটি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং জনগণের অধিকার। আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের যথাযথ প্রয়োগ মামলাজট কমাতেও সহায়তা করতে পারে।
লেখক, ব্যাংকার ও কলামিস্ট, এবং সভাপতি, ব্যাংক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।