Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মান্ধাতা আমলের নির্দেশিকায় সিগারেটের মান নির্ধারণ

| প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


কমিটির সভাপতি সিগারেট কোম্পানির প্রতিনিধি
আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক   -সৈয়দ মাহবুবুল আলম
দীর্ঘদিনেও কোনো অভিযোগ আসেনি  -পরিচালক বিএসটিআই
হাসান সোহেল : প্রায় দুই যুগ পূর্বের বিনির্দেশিকায়ই চলছে সিগারেটের মান নির্ধারণ। ১৯৯৫ সালে তৈরির পর আর কোনো পরিবর্তনই হয়নি এই বিনির্দেশিকায়। অথচ বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৫ প্রণয়ন করেছে। বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তি (এফসিটিসি) স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ বাংলাদেশ। এফসিটিসি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহকে এর নির্দেশনা অনুসারে তামাক কোম্পানি ও তাদের সাথে সম্পৃক্তদের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩-এ উল্লেখ রয়েছে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও নৈতিকতার সাথে জড়িত। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময় পর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সিগারেট বিনির্দেশিকা পরিবর্তন করা হয়নি। এমনকি এই বিনির্দেশিকায় তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদেরকে সভাপতি ও সদস্য করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক। এদিকে বর্তমানে সিগারেটের মান কোন প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ হবে তার কোনো সঠিক মাপকাঠি বা নির্দেশনা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরণের কার্যক্রম পরস্পরবিরোধী। একইভাবে সিগারেট, বিড়ি ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও মেয়াদকাল উল্লেখ নেই। কোম্পানি যেভাবে চাইছে সেভাবেই সবকিছু ঘটছে।  তাদের মতে, ১৯৯৫ সালে গঠিত মান বিনির্দেশিকা কমিটি এখনো বহাল থাকতে পারে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলকে নিয়ে মান বিনির্দেশিকা গঠন করার কথা বলেন তারা। একই সঙ্গে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের উৎপাদন ও মেয়াদকাল থাকলেও সিগারেটের নেই। যা ভোক্তাদের সাথে একধরনের প্রত্যারণা। ভোক্তারাও জানছেন না তামাক ও তামাকজাত পণ্যের মধ্যে কি আছে। মোড়কজাত বিধিমালা সম্পর্কে বিএসটিআই’র ৫-এর ধারায় বলা হয়েছে- মোড়কজাত পণ্যে বাধ্যতামূলক উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দিতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এ বলা হয়েছে- পণ্য মোড়কজাত হলে উৎপাদন ও মেয়াদ থাকবে। বর্তমানে এই দু’টি আইনই লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিষয়ে ধূর্ত তামাক কোম্পানির প্রভাব বিস্তারের উদাহরণ তুলে ধরে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন দি ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ ও বিএসটিআই’র আইন অনুযায়ী যে কোনো দ্রব্যের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ প্রদান করা বাধ্যতামূলক। সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ প্রদান না করায় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার অধিদফতরে অভিযোগ করা হয় প্রায় দু’বছর আগে, যার এখনো চ‚ড়ান্ত সমাপ্তি হয়নি। এখনও তামাকের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেয়া হচ্ছে না। এতে শুধু দু’টি আইন লঙ্ঘিতই হচ্ছে না, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক। সূত্র মতে, এফসিটিসি সার্টিফাই হওয়ার আগেই এই বিনির্দেশিকা তৈরি করা হয়। এরপর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হয়েছে এবং বাংলাদেশ এফসিটিসি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক‚টকৌশলে বিনির্দেশিকায় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সিগারেট বিনির্দেশিকা থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপও নেয়নি বিএসটিআই, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল ও বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন। তবে গত ৫ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা)  সৈয়দ সাইফুল ইসলাম বিএসটিআই মহাপরিচালককে সিগারেট বিনির্দেশিকা হালনাগাদ করার জন্য একটি চিঠি দিয়েছে। এরপর প্রায় ৩ মাস অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বিএসটিআই।  
সূত্র মতে, তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসার প্রসারের জন্য নানাভাবে নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করছে, কোম্পানিগুলোর এ প্রভাব প্রতিহত করতে সরকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসি ৫ দশমিক ৩ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দেশে মোট মৃত্যুর ১৪ দশমিক ৬ শতাংশের জন্যই দায়ী ধূমপান ও তামাক সেবন। তাই তামাক কোম্পানিকে সহযোগিতা বা তামাক কোম্পানির কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কিংবা তামাক কোম্পানির প্রতারণা প্রতিরোধে নিস্ক্রিয় থাকা প্রকারান্তরে মৃত্যুকেই উৎসাহিত করার শামিল।      
বাংলাদেশ মান সিগারেটের বিনির্দেশিকায় টোব্যাকো অ্যান্ড টোব্যাকো প্রডাক্টস শাখা কমিটি, এএফডিসি-২১-এ দেখা যায়,  সভাপতি হিসেবে রয়েছেন আলফা টোব্যাকো ম্যানু. কো. লি. ঢাকা-এর আনোয়ার ইউসুফ, সদস্য হিসেবে রয়েছেন- বিসিএআইআর, ঢাকা-এর ড. এম কবির উল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ড. শরাফর হোসেন খান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আবদুল করিম, বাংলাদেশ টোব্যাকো কোং লি.-এর মো. শাহজাহান, শামসুল আলম মিয়া, আরফা টোব্যাকো ম্যানু. কো. লি.-এর আবাদুল ইসলাম, আকিজ গ্রæপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের মো. মিজানুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ফয়জুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক (কৃষি ও খাদ্য) শওকত আহমদ, পরিচালক (কৃষি ও খাদ্য) মো. আখতারুজ্জামান, ঊর্ধ্বতন পরীক্ষক (কৃষি ও খাদ্য) মো. মফিদুল ইসলাম এবং ঊর্ধ্বতন পরীক্ষক (কৃষি ও খাদ্য)  মো. হাবিবুর রহমান।  
এদিকে এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ সম্পর্কে অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তারা জানেনই না। আইনের শুরুতে তামাক দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও অহরহই এ নির্দেশনা অমান্য করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ অনুযায়ী, তামাকের ব্যবহার কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শুধু সহযোগিতাই নয়; প্রকাশ্যে তামাক কোম্পানির মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া সরকার কখনোই তামাক কোম্পানির সাথে বসবেনা। শুধু নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে যে সভা হবে তা উন্মুক্ত হতে হবে এবং জনসাধারণকে জানাতে হবে।
আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩-এ উল্লেখ আছে, তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাষ্ট্রসমূহ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তামাক কোম্পানির বাণিজ্যিক এবং অন্য কোনো কায়েমী স্বার্থ থেকে এই নীতিমালা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া নৈতিক অধিকারবলে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখতে ও সুরক্ষা প্রদান করতে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। যা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন।  
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি প্রফেসর ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী বলেন, ক্যান্সারের প্রধান কারণ তামাক, তাই যারা তামাক সেবন করছে তারা কি সেবন করছেন, এতে কি কি দ্রব্য সামগ্রী আছে। একই সঙ্গে মেয়াদ ও উৎপাদন তারিখ না থাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ দ্রব্য সামগ্রী খাচ্ছে কিনা ভোক্তারা জানতে পারছে না। তিনি তামাক কোম্পানির প্রভাব থেকে মুক্ত করে এফসিটিসি ও আইন অনুযায়ী সঠিক সিগারেট মান বিনির্দেশিকা প্রনয়নের তাগিদ দেন। ডা. বাকী বলেন, ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সার হয়। বর্তমান সময় অনুযায়ী ক্যান্সার চিকিৎসা দিতে গেলে ১৬০টি ক্যান্সার হাসপাতাল দরকার। এত অর্থ যোগান দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ক্যান্সার যেন না হয়, সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হতে হবে।
দীর্ঘদিনেও সিগারেটের মান বিনির্দেশিকা হালনাগাদ না হওয়া প্রসঙ্গে বিএসটিআই’র মান উইংয়ের পরিচালক এ এন এম আসাদুজ্জামান বলেন, স্টেকহোল্ডারদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন বা পরিবর্তন হয়। দীর্ঘদিনেও এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ বা আবেদন আসেনি। বাপার আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আবেদন এখনো পাইনি। তবে যদি আসে মান প্রণয়ন টেকনিক্যাল কমিটিতে পাঠানো হবে। তারা সুপারিশ করে ডিভিশনাল কাউন্সিলে পাঠাবে। যা পরবর্তীতে সংশোধন আকারে তৈরি হবে।      
উল্লেখ্য, এফটিসি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে ধূমপান এবং তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ আইন) সংশোধন। একই সঙ্গে ২০১৫ সালে সংশ্লিষ্ট বিধি পাস করা হয়। এছাড়া এফসিটিসি’র শর্ত অনুযায়ী সিগারেটের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন উন্নত বিশ্বেও অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের সিগারেটের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী অর্থাৎ মানুষের ক্যান্সারের ছবি, হৃদরোগের ছবি, ব্রেন স্ট্রোকের ছবি এমনকি ধূমপানের কারণে মৃত শিশুর ছবিও সন্নিবেশিত হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ