Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অরক্ষিত মেধাস্বত্ব

| প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : প্রতিটি মানুষের তার সৃষ্টিকর্মের ওপর অধিকার সবচেয়ে বেশি। মানুষ নিজ থেকে মৌলিক কিছু সৃষ্টি করলে মেধাস্বত্ব আইন তাকে সেই সৃষ্টির মালিকানা বা স্বত্ব দেয়। মেধাকে ঘিরে স্বত্ব ও মালিকানার দাবি ও বিতর্কটি আজ বিশ্বে খুবই জোরালো। কারণ এর সঙ্গে কর্পোরেট বাণিজ্যের পণ্য-বাহাদুরি জড়িত রয়েছে। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, মুক্ত বাজার, কি মুক্তবাণিজ্য ও কর্পোরেট বিশ্বায়নের দুনিয়ায় মানুষের সম্পদ, সম্ভাবনা, জ্ঞান, মেধা সবই একতরফা দখল, নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানাধীন করার চেষ্টা করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সোজা কথায় বলা যায়, গবেষণা ও উন্নয়নের নামে প্রচলিত আইনি বৈধতা নিয়েই মিলিয়ন, বিলয়নীরা মেধাবীদের মেধা ও বুদ্ধিজাত সম্পদ, আবিষ্কার, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও পেটেন্টের একতরফা ছিনতাই, ডাকাতি ও পুঁজি করছে। আজ চিন্তার স্বাধীনতা, কি জ্ঞানপ্রবাহের অসীম বিস্তারের দর্শনকে ধাক্কা মেরে- মেধা, সৃজনশীলতা ও প্রাণসত্তার জটিল সম্পর্ককে বাজারি দরদামের ভেতর আটকে ফেলেছে কর্পোরেট বাণিজ্য।
মেধাস্বত্ব বলতে বুঝায়, মানুষের জ্ঞান বা বুদ্ধি থেকে সৃষ্ট যা। সাহিত্য এবং শৈল্পিক বিষয়গুলো ছাড়াও এর আওতাভুক্ত রয়েছে, কম্পিউটার সফটওয়্যার, বিজ্ঞাপন, মানচিত্র, প্রযুক্তিগত অঙ্কন, বই, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, উদ্ভাবন, আবিষ্কার, নকশা, পরিকল্পনা, ট্রেডমার্ক, সংগীত, সিনেমা, পরিসেবা চিহ্ন ইত্যাদি। একজনের নাটক, গান, চলচ্চিত্র, বই, অনুমোদন ছাড়াই নকল করা ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, রেডিওতে প্রচার করাসহ বিভিন্নভাবে পাইরেসির পরিধি অনেক বিস্তৃত। এর সাথে মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘনও দেশ-বিদেশে মহামারী আকার ধারণের সাথে মেধাসম্পদ চুরি বা মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের স্বর্গরাজ্য বললেও ভুল বলা হবে না।
মেধাস্বত্ব অবশ্যই একটি ব্র্যান্ড, একটি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার, একটি নকশা বা পরিকল্পনা বা এ রকমের অন্য যে কোনো সৃজনশীলতা যার দাবীদার, এর ফলাফলের মালিক হয়ে যায় এবং কেনাবেচাও করতে পারে। আমাদের দেশে আশানুরূপ মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ নেই। মেধাস্বত্ব অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন অনেক সৃজনশীল নির্মাতা। এ কারণে সংক্ষুব্ধের যেমন অভাব নেই, অভাব নেই তেমনি অভিযুক্তের। মেধাস্বত্ব কী এ সম্পর্কে সিংহভাগ মানুষের ধারণা না থাকার কারণে এই আইন প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছে। সৃজনশীলতা সব মানুষের মাঝেই আছে। যারা সৃজনশীলতাকে ভালো কাজে ব্যবহার করে, তারাই এগিয়ে যাবে। উদ্ভাবকদের কপিরাইট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে তরুণদের উদ্যোগী হতে হবে। কপিরাইট ও মেধাস্বত্বের সঙ্গে তরুণেরা সরাসরি জড়িত বলে এটা সংরক্ষণেও তাদের ভ‚মিকা রাখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এই তরুণরাই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মেধাস্বত্ব অধিকারের লঙ্ঘন করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে। এ ধরনের কাজগুলোর উদ্ভাবক ও ব্যবহাকারীদের অধিকাংশই তরুণ, তরুণরাই নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজ রক্ষা করতে পারে এবং অন্যের কাজের প্রতি সম্মান দেখাতে পারে।
বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে যুক্ত সবশ্রেণির শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, প্রডিউচার, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, আর্টিস্টদের কাছে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বিদেশি বা দেশি পণ্যের প্যাটেন্ট, ডিজাইন বা ট্রেডমার্ক চুরি করে নকল পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাবলয় নেই বলেই মেধাবী আবিষ্কারক, সৃষ্টিশীল ও নব উদ্ভাবকরা বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তবে এভাবে চললে অনেক মেধাবী যেমন মেধার মূল্য না পেয়ে মেধার চর্চা বন্ধ করে দেবে, তেমনি সঠিক মেধার অভাবে ভোক্তারাও নকল পণ্যের ধোঁকায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সুযোগে লুটেপুটে খাবে নানা কিসিমের অসাধু বাণিজ্যিক মুনাফাখোররা। উল্লেখ্য, মার্কিন জিডিপির শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ আসে কেবল মেধাসম্পদ থেকে। আমরা কোনো শতাংশই যোগ করতে পারি না।
মেধাস্বত্ব আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে সাধারণ জনগণ উচ্চমূল্যে কেনা নকল পণ্য ব্যবহার থেকে বেঁচে থাকবে। এজন্যই মেধাস্বত্ব আইন সম্পর্কে জ্ঞান, ধারণা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি, যাতে ভোক্তা, কোম্পানি উভয়ই সঠিক পণ্য এবং সঠিক মূল্যায়ন পেতে পারে। উদ্ভাবক ও পরিকল্পনাকারীর মেধাস্বত্ব কৌশলকে এগিয়ে নেয়ার সঙ্গে মেধাস্বত্বের ব্যাপারে সমাজের সচেতনতা অব্যাহতভাবে প্রচার হলে প্যাটেন্ট স্বত্ব আবেদনকারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।
দেশে সর্বপ্রথম বাংলা সফটওয়্যার হিসেবে বিজয় কিবোর্ডের নকশা কপিরাইট করে আনন্দ কম্পিউটার। ২০০৪ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণকে প্যাটেন্ট করে তারা। ‘বিজয়’ নামটিকে পণ্যের ট্রেডমার্ক হিসেবে আনন্দ কম্পিউটার সংরক্ষণ করে। এর স্বত্বাধিকারী মোস্তফা জব্বারের বুদ্ধিজাত সম্পদ হিসেবে একে গণ্য করা হয়। বিজয় কিবোর্ড লে-আউট ও ম্যাকের সফটওয়্যারের আবিষ্কারক মোস্তাফা জব্বার তার কাজ নকলের অভিযোগ করে অভ্র সফটওয়্যারের প্রস্তুতকারক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। এছাড়াও ২০১০-এ মেধাস্বত্ব ও কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে দেশ টিভিকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। নোটিশে হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই ও বড় চাচাসহ তার কালজয়ী কিছু চরিত্র নিয়ে নির্মিত ‘এই সময়ে সেই সব মানুষেরা’ শীর্ষক ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে লেখকের সৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞা ও মানহানির অভিযোগ আনা হয়। ওই সময় হূমায়ুন আহমেদ বলেন, ‘এই নাটকের মধ্য দিয়ে আমার মানহানি করা হয়েছে। আমার অনুমতি ব্যতিরেকেই আমার সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে’। এর বাইরেও মেধাস্বত্ব আইন লঙ্ঘনের আলোচিত ঘটনা হলো, ‘মেলাই যাইরে’ খ্যাত শিল্পী মাকসুদ একটি মোবাইল কম্পানির বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিলেন।
বুদ্ধিজাত সম্পদ ও স্বত্ব ঘিরে বাংলাদেশে যেসব আইন রয়েছে তা হলো, ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯, দ্য প্যাটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট ২০০৩ (১৯১১ সালের আইন), কপিরাইট আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০০৫) ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। কপিরাইট অফিসটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য সবই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবে বাজারে এতো পাইরেসিসহ নকল ও ভেজাল পণ্যের সয়লাব দেখে বলতে হয়, প্রতি বছর ২৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব দিবস উদযাপনের পর তারাও বছরজুড়ে সুখনিদ্রায় সময় কাটায়! মেধাসম্পদের নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা, আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়া পীড়াদায়ক। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় বেকায়দায় পড়ছেন সৃষ্টিশীল মানুষেরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে, ডিজিটাল দুনিয়াতে মেধাসম্পদ সুরক্ষা করতে না পারলে টিকে থাকা যাবে না।
মেধাসম্পদ বা সৃজনশীলতার মর্যাদা দেয়ার সাথে সৃজনশীল কাজকে সুরক্ষা প্রদান ও সৃজনশীল কাজ সৃষ্টিতেও যথাযোগ্য ও প্রাপ্য প্রণোদনা দিতে হবে। এর সাথে প্রতিটি বিষয়ে মেধাস্বত্ব কার্যকর ও কপিরাইট ঠিক রাখার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিল্প বা বাণিজ্য বিষয়ক মেধাসম্পদের সুরক্ষা ছাড়া আমরা যে ডিজিটাল যুগে টিকতে পারব না সেটিও আমাদের বুঝতে হবে। সময়ের সাথে সাথে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে সর্বাগ্রে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন