ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
জিয়া হাবীব আহ্সান : আলেকজান্দ্রিয়া শহরের সাথে যেমনি জড়িয়ে আছে বহু নবী-রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহ ভীরু লোকদের নাম, তেমনি জড়িয়ে আছে ইতিহাসের বিখ্যাত-কুখ্যাত বহু বীর ও শাসকের নাম। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার-দি গ্রেট, রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার, রানী ক্লিওপেট্রা, মার্ক এন্টনিও, অক্টোভিয়ান সিজার (অগাস্টাস সিজার), হাইপেশিয়া, সেইন্টপল, সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টসহ অনেকের নাম এ খ্যাতিম্যান শহরের সাথে জড়িয়ে আছে। প্রাচীন দুনিয়ার অন্যতম সপ্ত আশ্চার্যের বাতিঘর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘দ্যা ব্যাটেল অফ আলামীন’সহ অনেক স্মারকের সাক্ষী এই শহর। ১৯ শতক থেকে এই শহর পরিণত হয়েছে মিসরের নৌ বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা এই শহরটি পানির ওপর ভাসমান। এই শহরে ট্রাম চলাচলেরও ব্যবস্থা রয়েছে। রাজধানীর সাথে দুটি প্রধান সড়ক পথ ছাড়াও এখানে বিমানবন্দর এবং আলেকজান্দ্রিয়া-কায়রো নৌপথে জাহাজ চলাচলও রয়েছে। এ শহরে মুসলমানদের ১৮১৯টি মসজিদ ও খ্রিস্টানদের ৩৫টি চার্চ রয়েছে। লোকসংখ্যার ৯০% মিসরী সুন্নি মুসলমান, বাকি ৯% ব্যাষ্টিক ও ১% অন্যান্য খ্রিস্টান। মিসরে তিনটি স্বীকৃত ধর্ম রয়েছে, সেগুলো হলো ইসলাম, খ্রিস্টান এবং ইহুদী। অল্প কিছু বাহাই থাকলেও তাদের স্বীকৃতি নেই। একদিকে সমুদ্র অপর দিকে শহর, সমুদ্রের তীর ঘেঁষে রাস্তা আর রাস্তার পাশে সুরম্য অট্টালিকা, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, আবাসিক ভবন ও নানা বিপণি কেন্দ্র। মিসরের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ এখানে অবকাশ যাপনের জন্য বাড়ি করেছেন। গ্রীষ্মকালে এখানে পর্যটকদের ভিড় হয়। ভূমধ্যসাগর তীরে অবস্থিত শহরটি চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাজানো গুছানো ছবির মতো। দেখতে অনেকটা ইউরোপ আমেরিকার শহরের মতো। রংবেরংয়ের ফুলের বাগানে সুসজ্জিত করা হয়েছে শহরটিকে।
আমরা নিকটেই একটি সুন্দর মসজিদে অজু করে জুমার নামাজ আদায় করলাম। তখনও ঠান্ডা বাতাস আর শীতের প্রকোপ থাকলেও আনন্দ উচ্ছ¡াসে তা আমাদের কাবু করতে পারেনি। মসজিদে বিভিন্ন মাযহাবের বা ইমামের অনুসারীদের নামাজরত দেখলাম। অনেকে মাযহাব মানে বিভক্তি মনে করলেও প্রকৃত পক্ষে প্রত্যেক মাযহাবের ইমাম ও অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। মিসরে অধিকাংশ মানুষ ইমাম শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী তবে অন্যান্য মাযহাবও রয়েছে। এটা বুঝতে পারলাম দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে। আমাদের গাইড সী ফুড খাওয়ার জন্য নামাজ শেষে নিয়ে গেলেন একটি রেস্টুরেন্টে। প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে দোতলায় গিয়ে বসলাম। রেস্টুরেন্টটির নাম সাবরিন (ঝঅইজওঘ)। খাবারের অপেক্ষায় আছি, কিছুক্ষণ পর বিভিন্ন ধরনের সালাত, সস ও রুটি দেয়া হলো। অনেকেই বিরক্ত হচ্ছিলেন ভাত না দেখে। একটু পরেই গরম গরম মাছ ভাত ও ভুট্টার রুটি, সালাদ ইত্যাদি নিয়ে আসা হলো। প্লেটে ঝিনুক-শামুক দেখেই আঁতকে উঠলাম। বুঝলাম তারা শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শাফেয়ী মাযহাবের মুসলমানরা শামুক-ঝিনুক খায় শুনেছি, আর আমরা হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা এসব খেতে অভ্যস্ত নই। আমাদের উপমহাদেশে ও বিশ্বে হানাফী মাযহাবের অনুসারী বেশি। ইমামে আযম হযরত আবু হানিফা (রাঃ) তাবেয়ী ছিলেন। তিনি বহু সাহাব (রাঃ) কে দেখেছেন, আর ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) (৭৬৭-৮২০ খ্রি.) ইসলামের অপর মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালিকের শিষ্য ছিলেন। কায়রো শহরের উপকণ্ঠে তার সুদৃশ্য মাজার রয়েছে। তিনি কবিও ছিলেন। ছন্দের জাদুকর বাঙ্গালী কবি সতেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইসলামী কবিতা’ বইতে এ মুসলিম মনীষী সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য আছে। ইসলামের ইমামগণ আজীবন কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সাথে জ্ঞান সাধনা করে শরীয়তের আইন ও ফিকাহ শাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেন। এই ক্ষেত্র তাদের অবদান অনস্বীকার্য। তারা কোরান-সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী ছিলেন। তাদের যে কোন একজনকে অনুসরণ করলেই হয়। খাবারের প্লেটে ঝিনুক-শামুক দেখে বুঝলাম তারা এসব খায়, যাতে আমরা অভ্যস্ত নই। শাফেয়ী মাযহাবের অনেক গল্প আমার মরহুম আব্বাজানের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তাই দ্রæত খাবার প্লেট থেকে ঝিনুকগুলো সরিয়ে ফেললাম। গরম গরম মাছ ফ্রাই দেয়া হলো। পুরো মাছ মাঝখানে ফেড়ে অর্ধেক প্রদত্ত রুটি দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তের জন্য খাওয়া শুরু করলাম। তেলে ভাজা মাছটি উল্টাতেই দেখি পিঠের আইশ পরিষ্কার করা হয়নি। আমার খাবার প্রচন্ড আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেল। আর সী ফুড খাওয়া হলো না। জুস ও ডেজার্ট খেয়ে বের হয়ে গেলাম। আমাদের সতীর্থদের কয়েকজন ক্ষেপে গেলেন। আমি তাদের সান্ত¡না দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, বিদেশ সফরে এগুলো হচ্ছে ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা যা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। শ্রদ্ধাভাজন সফর সঙ্গী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সাবেক পরিচালক মুহাম্মদ রহুল আমিন খান ও তার স্ত্রী মিসেস খান (হাটহাজারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা) আমার সাথে একমত পোষণ করলেন। আমরা স্থানীয় মাসজিদুল আবুল আব্বাস, সুফী সাধক শায়ের বুশায়ারী মসজিদসহ বেশ কটি মাজার ও মসজিদ জেয়ারত করলাম। আহলে বাইয়াতের ১১ জনের কবর/মাজার দেখলাম। কবি বুশাইরির মাজারে সমবেত কণ্ঠে স্বরচিত কসিদা পাঠের আসর দেখলাম। স্থানীয় ঐতিহ্যময়ী মসজিদগুলোর নাম হচ্ছে শোরবাগী মসজিদ (স্থাপিত ১৭৫৭ খ্রি.), তারবানা মসজিদ (১৬৮৪ খ্রি.), মসজিদে দানিয়েল, বুশাইরী মসজিদ, মসজিদুল আবুল আব্বাস ইত্যাদি। এছাড়া অশ্বারোহী ইব্রাহিম পাশার মূর্তিটিও আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিল।
সময়ের অভাবে মিউজিয়াম দেখা হলো না। গাড়িতে উঠে সমুদ্র তীরের স্বাস্থ্যকর স্থান বাদশা ফারুকের প্রাসাদ ‘মুনতাজা’ ও বিশ্বের প্রাচীনতম বৃহৎ লাইব্রেরি দেখতে বাসে উঠে রওনা হলাম। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে এগুচ্ছিলাম আর প্রচন্ড টেউগুলোর তীরে এসে আছড়ে পড়ার দৃশ্য দেখছিলাম আর মনে মনে কৃতজ্ঞচিত্তে স্রস্টার নাম স্মরণ করছিলাম যিনি এ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রাচীনতম লাইব্রেরির পাশে এসে বাস থামলো। আলেকজান্দ্রিয়া ইউনিভার্সিটির কমার্স ফ্যাকাল্টির উল্টো দিকে বিশ্ববিখ্যাত এই লাইব্রেরিটি অবস্থিত। এটির নির্মাণশৈলী বা কাঠামো এক কথায় অপূর্ব। বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এটিকে অনেক আধুনিক ও সাজানো গুছানো দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। এই ভবনের ছাদ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গোটা লাইব্রেরি সূর্যের আলোয় আলকিত থাকে। বই-পত্রে যে ছত্রাক জমে গ্রন্থসমূহ ধ্বংস করে দেয়, তা থেকে রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা। কারণ সূর্যের আলো বই-পত্রের জমে থাকা ছত্রাক ধ্বংস করে দেয়। এই লাইব্রেরিটি আধুনিকীকরণে ব্যয় হয়েছে ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রাচীনকালে এখানে ৫ লক্ষাধিক বই ছিল। বর্তমানে বইয়ের সংখ্যাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি হিসেবে এখানে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের ৮০ লাখ বই। তিনটি মিউজিয়াম, একটি কনফারেন্স হল, প্রায় ৫ হাজার কম্পিউটার সমৃদ্ধ গবেষণাগার। ছাত্রছাত্রীদের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার সম্পূর্ণ ফ্রি। এই শহর এক সময় প্রাচীন বিশ্বের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল। ঐদিন পাঠাগার বন্ধ থাকায় সিকিউরিটির সাথে মোলাকাত খোশগল্প আর বাইরে ফটোসেশান করেই গাড়িতে উঠে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্য বাদশাহ ফারুকের রাজ প্রাসাদ এবং অবকাশ যাপন পার্ক। সমুদ্র সৈকত দেখতে দেখতে প্রাসাদের সামনে এসে বাস থামলো। সমুদ্রের বাতাস যেন সব উড়িয়ে নিতে চায়। মিসরের প্রতাপশালী বাদশা ফারুক নেই। কিন্তু তার বিলাসী মনের স্মৃতি এখনও জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে দন্ডায়মান। গাইড বললেন, প্রাসাদ বা প্যালেসটির নাম ‘মুনতাজা’। ৩৫০ কক্ষবিশিষ্ট বিশাল প্রাসাদ যে কারো দৃষ্টি কেড়ে নেবে।
সময় কম, আমাদের কায়রো ফিরতে হবে। পরদিন সপ্ত আশ্চর্যের পিরামিড, বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানবী (সা.)-এর নাতি ইমাম হাসানের কন্যার মাজার মসজিদ, আমর ইবনে আস মসজিদ, মোহাম্মদ আলী মসজিদসহ বিভিন্ন মার্কেট পরিদর্শনের কর্মসূচি রয়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর রওনা দিলাম। পথিমধ্যে একটি স্টেশনে হালকা নাস্তা পানি, চা, কফি ও এশার নামাজ শেষে বাসে উঠে রাতে রাজধানী কায়রোর উপকণ্ঠে আমাদের হোটেলে ফিরে আসলাম। রাতের বুফে ডিনারের আয়োজনকে সফল করে নিজ নিজ কক্ষে ঘুমিয়ে পড়লাম।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।