ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এবি সিদ্দিক : গত ১৮ এপ্রিল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পরিবহন মালিকরা কোনও সামান্য লোক নয়, তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর। ‘পরিবহন মালিকদের ডাকলেও আসেন না।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যে ফলাফল পাওয়া গেল পরের দিন পরিবহন মালিকদের সাথে বিআরটিএর বৈঠকে। পরিবহন মালিকদের কাছে নতি স্বীকার করে চলমান সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিত করা হলো। পরিবহন মালিক আর শ্রমিকরা যে ক্ষমতাধর তাতো আমরা বরাবরই দেখতে পাচ্ছি। কিছু দিন আগে গোটা দেশে ৩৩ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ রেখে দেশের মানুষকে তারা দেখিয়ে দিয়েছে কত ক্ষমতা ধর। তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? এমন প্রশ্ন জনমনে আসাটাই স্বাভাবিক। পরিবহন মালিকরা নিজেদের মত করে ভাড়া আদায় করে, শ্রমিকরা (চালকরা) ১০/২০ জন হত্যা করলেও তাদের বিচার করা বা গ্রেফতার করা যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থাও নেয়া যাবে না, আবার তাদের ক্ষেত্রে নামমাত্র শাস্তির বিধার রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়। এটা কেমন দেশের আমরা বাস করছি? সরকার রাজধানীতে যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে (প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৭০ পয়সা) তা মানা হচ্ছে না। বাসে পা রাখলেই ৫ টাকা আর সিটিং সার্ভিসে পা রাখলেই ২০ টাকা। কিছুদিন আগে সরকার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা হয়ে গেল। পরিবহন মালিকরা কত টাকা কামাই করছেন। বিআরটিএর তথ্যে বর্তমানে দেশে বাসের সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি/২০১৭) সংখ্যা ৪০ হাজার ৬১৬টি, মিনিবাসের সংখ্যা ২৭ হাজার ৪৫৭টি, ট্রাকের সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৩২৩টি। আর সব ধরনের মোটরযানের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৬টি। এখানে উল্লেখ্য, ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোটরযানের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। মালিকরা যাত্রীদের পকেট কেটে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছেন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, প্রতিদিন নাকি পরিবহন খাতে ৬ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। যাক সে কথা। আমি যা বলতে চাইছি মালিক-শ্রমিকদের ক্ষমতার কথা। মাননীয় মন্ত্রী যখন অসহায়ত্বের কথা বলেন তখন আমরা বা সাধারণ মানুষ আর কোথায় যাবে, কার কাছে নালিশ করবে, কোথায় পাবে ন্যায়বিচার? সরকার যদি কোন সংগঠনের কাছে নতি স্বীকার করে তা হলে কি আর করার আছে। কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কখনও কোন দেশের সরকার নতি স্বীকার করতে পারে না। এটা সরকারের চরম ব্যর্থতা। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠে যে, সরকার বড় না ঐ সব সংগঠন বড়। আরো প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সরকারের দুর্বলতাটা কোথায়? কেন কোন সংগঠনের অবৈধ কার্যকলাপের কাছে সরকার নতি স্বীকার করবে? একটা দেশের কোটি কোটি মানুষের উপর কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন নিপীড়ন চালবে আর সরকার অসহায়ত্বের কথা বলবে, এটা কেমন দেশ? এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সম্ভবত ১৯৯৬ সালের ঘটনা। শ্রীলংকার বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীরা কয়েক দফা দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। যেদিন তারা তাদের কর্মসূচির ঘোষণা করে, সেদিন রাতেই প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা ঘোষণা করেন যে, যদি পরদিন (কর্মসূচির দিন) সকাল ৮টা মধ্যে কর্মস্থলে যোগদান না করে তবে পুলিশ ঘর থেকে ধরে এনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। পরদিন ৮ টার আগেই কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে গিয়ে কাজে যোগ দেয়। অবশ্য তাদের যৌক্তিক দাবিও মেনে নেয়া হয়। সরকার জনগণের আর জনগণের স্বার্থ রক্ষাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব। আর সেই সরকার যদি হয় গণতান্ত্রিক। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার জনগণের কথা চিন্তা করবে, কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নয়। আর যদি সরকার অগণতান্ত্রিক হয় তা হলে ভিন্ন কথা। গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বা নিশ্চিত করা, সুশাসন কায়েম করা, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা। কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কাছে নতি স্বীকার করা সরকারের কাজ নয়। এই পরিবহন খাতে নৈরাজ্য চলছে তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মালিক-শ্রমিকরা কি দেশের আইনের ঊর্ধ্বে? বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনার দিক দিয়েও বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার শীর্ষে। সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপে বলা হয়েছে যে, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ৬৪ জন। অর্থাৎ বছরে ২৩ হাজারের বেশি লোক মারা যাচ্ছেন আহতের সংখ্যা কত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রায় ১৯ লাখ। প্রায় সাড়ে ২৯ লাখ মোটরযান আর ১৯ লাখ ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো নয় কি? হাইকোর্ট ১৯ লাখ ‘ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স’ জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলেন, সেই সাথে যেসব চালক এসব ভুয়া লাইসেন্স ধারণ ও ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া সারাদেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলাচলের সুযোগ না থাকার পরও যেসব বাহন ‘মোটরযান’ হিসেবে চলছে, সেগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। ভুয়া ড্রাইভিং মানেই মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়া। যারা এই কাজটি করছেন, অর্থাৎ ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছেন তারা কি মানুষ নন? আসলে বাংলাদেশে পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা বিশে^ নজিরবিহীন। এভাবে যদি চলতে থাকে আর সরকার যদি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তা হলে ভবিষতে অবস্থাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে?
লেখক: সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।