Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডিএমসিএইচ দক্ষিণ এশিয়ার মোস্ট প্রেস্টিজিয়াস হাসপাতাল : প্রফেসর আবিদ রিজভী

করাচিতে ইদি’র ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স আর এসআইইউটি’র ফ্রি চিকিৎসা

| প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আহমদ আতিক, পাকিস্তান থেকে ফিরে : করাচির রাস্তায় পথ চলতে যে কারোই চোখে পড়বে চিপা অথবা ইদি ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বুলেন্সের। আর ফ্রি চিকিৎসা পেতে হলে যেতে হবে করাচির সিন্ধ ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টেশনে (এসআইইউটি)। এই এসআইইউটির নেটওয়ার্কে করাচিতে রয়েছে আরো বেশকিছু হাসপাতাল। করাচির বাইরেও রয়েছে তাদের সেবা। আর এর সবগুলোই চলে মানুষের দেয়া জাকাত এবং ডোনেশনের টাকায়। বন্দরনগরী করাচি জুড়েই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য হাসপাতাল। সাধারণ ও মধ্যবিত্তের যেমন তেমনি রয়েছে উচ্চবিত্তের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালও। তবে করাচির চিকিৎসকদের মতে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা মানের হাসপাতাল।
করাচির জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের বহনকারী বাস এগিয়ে চলছে শহরের সাদ্দার এলাকার হোটেলপানে। করাচিতে পথ চলতে প্রথমেই হঠাৎ যে কারো মনে হতে পারে, এ হয়তো ঢাকারই কোনো সড়ক। কিন্তু না, মানুষের পোশাক এবং উর্দুতে সাইনবোর্ড দেখার পরই ধারণা পাল্টে যাবে। ফ্লাইওভারের পিলারে রয়েছে বর্ণিল চিত্র, রাস্তায় চলছে ঢাকার মতোই খোড়াখুড়ি। তবে পরিবেশের রুক্ষতা এবং ধুলোবালির উপস্থিতিতেও চিন্তার গতি পাল্টে যাবে। ঢাকার মতো রিকশা না থাকলেও এখানকার প্রধান বাহন হলো স্থানীয়ভাবে তৈরি ৬০-১০০ সিসির মোটরসাইকেল। কিছু দূর পেরুতেই চোখে পড়ল রাস্তার পাশে দাঁড় করানো অ্যাম্বুলেন্স। এর গায়ে বড় করে লেখা রয়েছে চিপা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। অল্প দূরত্বেই এমন আরো অনেক অ্যাম্বুলেন্স ঠাঁই দাঁড়িয়ে। আরো কিছু দূর এগোনোর পর দেখা গেল ইদি ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বুলেন্সের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাকিস্তান পিআইডির প্রটোকল অফিসার হাসান আব্বাস এবং তারেক জানালেন, এসব অ্যাম্বুলেন্সের সবই ফ্রি সার্ভিস দেয়। পুরো করাচির রাজপথ এবং অলি-গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে চিপা এবং ইদির হাজারো অ্যাম্বুলেন্স। কোনো পথচারী দুর্ঘটনায় কবলিত হলে কিংবা কেউ অসুস্থতা বোধ করলে হাসপাতালে পৌঁছে দেয় চিপা এবং ইদির অ্যাম্বুলেন্স এবং অবশ্যই ফ্রি। ইদি ফাউন্ডেশনের রয়েছে নিজস্ব হাসপাতালও। ইদি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রহমান ইদি পাকিস্তানিদের কাছে প্রবাদপুরুষ।
পুরো করাচি জুড়ে ঢাকার মতোই চলছে খোড়াখুড়ি। হাসান আব্বাস জানালেন, ৬৫ বছর পর করাচির স্যুয়ারেজ লাইন, ভ‚গর্ভস্ত পানির লাইনসহ বিভিন্ন সংস্থার সংযোগ লাইন ও সড়কের সংস্কার ও পুননির্মাণ চলছে। আর এ কারণে করাচি জুড়েই ধূলার স্তর। রোদের খরতাপ থেকে বাঁচার জন্য মোটরসাইকেলগুলোতে বিশেষ ধরনের কোট পড়ানো হয়।
করাচিতে পৌঁছানোর পরদিন সকালেই ঢাকার সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হলো করাচির আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাসপাতাল সিন্ধ ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টেশনে (এসআইইউটি)। এখানে প্রবেশ করেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। হাসপাতালের ভেতরে খুবই পরিপাটি। নেই কোনো দুর্গন্ধ। রোগীর আত্মীয়দের ভিড় জমাতে দেখা মেলে না। নার্সরাই যথেষ্ট। সবচেয়ে মজার বিষয় হলোÑ নার্স-চিকিৎসক এবং অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য একসাথেই একমানের খাবার রান্না করা হয়। যার যার বেতন অনুযায়ী তা থেকে বিল কেটে রাখা হয়। সবাই একসাথেই খাবার গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে আলাপের শুরুতেই হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান প্রফেসর আবিদ রিজভী বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হলো দক্ষিণ এশিয়ার মোস্ট প্রেস্টিজিয়াস হাসপাতাল। এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। তারা বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বমানের ভালো চিকিৎসক তৈরি করে। পাকিস্তানজুড়েও তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
তিনি জানান, রোগীর ভিড় সামাল দেয়ার জন্য তারা একটি পদ্ধতি তৈরি করেছে। তাছাড়া এখানে একজন রোগীকে ঘুরতে হয় না। করাচিজুড়ে রয়েছে কিছু স্যাটেলাইট সেন্টার। করাচি থেকে পাঁচ শত কিলোমিটার দূরে সাক্কার এলাকায় রয়েছে আরেকটি হাসপাতাল। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য রয়েছে নিজস্ব নার্সিং স্কুল। ২১টি বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি রয়েছে অত্যাধুনিক বেশ কিছু ল্যাবরেটরির সমন্বয়ে তারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সেবা দিয়ে থাকেন।
হাসপাতালে প্রবেশের পর এর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি প্রফেসর ড. মির্জা নাকী জাফর জানান, বাংলাদেশের বারডেমের মতো করেই আজ থেকে ৪৩ বছর আগে এ হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয় করাচি সিভিল হাসপাতালের আট শয্যার বার্ন ইউনিট দিয়ে। প্রফেসর আবিদ রিজভী এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৯১ সালে এটি একটি ইনস্টিটিউটে রূপ লাভ করে। মূলত কিডনির পাথর অপারেশনের জন্য এ হাসপাতালের যাত্রা শুরু হলেও এখন এখানে সব বয়সী নারী-পুরুষের কিডনি ও লিভার সংক্রান্ত ক্যান্সার চিকিৎসা এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। শহর এবং গ্রামীণ জনপদের রোগীদের জন্য এ হাসপাতাল যেন ত্রাতার ভ‚মিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জানান, বছরে তাদের এ হাসপাতাল থেকে ১০ লক্ষাধিক রোগীর ফ্রি চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। মির্জা নাকী জাফর এসময় দুই বছর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষা কর্মসূচি বিনিময়ের আওতায় শিক্ষা গ্রহণের কথা স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, মানুয়ের কাছ থেকে চিকিৎসকরা নিজেদের আলাদা করে ফেলেন। আর তাই জনগণ তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত চিকিৎসা পায় না। আমরা মানুষকে এখন চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতার উপর জোর দিয়েছি। তিনি জানান, একসময় অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসক তাদের হাসপাতালে এক্সচেঞ্জ প্রোগামের আওতায় যেতেন।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে মানুষ কেন ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতের চিকিৎসকরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল। যা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান অনুসরণ করতে পারে।
সাংবাদিকদের হাসপাতালটির বিভিন্ন ইউনিট ঘুরিয়ে দেখান ড. এস এ আনোয়ার নাকভী। তিনি জানান, সরকার এখন এ হাসপাতালের সাথে যুক্ত হয়েছে। তারা এর খরচের ৫০ ভাগ এখন দিয়ে থাকে। বাকিটা সাধারণ মানুষ বিভিন্ন দান এবং জাকাতের খাত থেকে আসে। এখানকার ডায়ালাইসিস, ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার সবই ফ্রি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কিডনির পাথরের রোগী কম থাকলেও অফ্রিকা থেকে শুরু করে ভারতের প্রায় অধিকাংশ এলাকাতেই গরম তাপমাত্রা. ডিহাইড্রেশন এবং পরিবেশের কারণে কিডনি রোগী বেশি। হাসপাতালটিতে প্রতি বছর পাঁচ হাজারের বেশি কিডনি ট্রন্সপ্লান্টেশন হয়। এর মধ্যে লিভিং ডোনার প্রায় পাঁচ শতের মতো। সফলতার হার খুবই ভালো। মাত্র ২০ জন জটিলতায় পড়ে পুন চিকিৎসা নিতে আসে। তাছাড়া এ হাসপাতালে অংকোলজি, গ্যাস্ট্রো এন্ট্রালজি, ইউরোলজি, ক্যান্সার এবং শিশুদের কার্ডিয়াক বিভাগ রয়েছে। এ হাসপাতাল দুই শতাধিক আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ক্রয় করে। বিশ্বের নানা প্রান্তের হাসপাতালের সাথে রয়েছে অনলাইন লিঙ্ক। প্রফেসরদের লেকচারগুলো সংরক্ষিত থাকে। এখানে স্টেমসেল রিসার্চ সেন্টার এবং মলিকুলার মেডিসিন রিসার্চের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় সাত শতাধিক কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয়। এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস সেন্টার। সরকারি চ্যানেলে এলে বিদেশি রোগীরও চিকিৎসা দেয়া হয়। রয়েছে হাইটেক ল্যাবরেটরি। সব রিপোর্ট অনলাইনে রাখা হয়। রক্তদান কেন্দ্রে মানুষ প্রতিদিন স্বেচ্ছায় রক্ত দান করে যায়। তিনি বলেন, এডাল্ট টু চিলড্রেন ট্রান্সপ্লান্ট ভেরি সাক্সেস।
তিনি বলেন, আমাদের সরকারগুলো গরিব। কিন্তু ধনীরা যদি ডোনেশন দেয়, তাহলে গরিবের চিকিৎসাটা সহজ হয়। ৫০ ভাগ মানুষই আয়ের অর্ধেক খরচ করে চিকিৎসার জন্য। পরের বেলা খাবার না থাকলে তারা চিকিৎসা করবে কি করে। কমিউিনিটি ও সরকার সমন্বয়ে
সবশেষে তিনি জানান, ঢাকার সাথে রয়েছে তার শৈশবের স্মৃতি। মদন মহোন বসাক লেনে তার জন্ম এবং সিলভারডেল প্রিপারেটরি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন।
এসআইইউটির বাইরেও করাচিতে রয়েছে বহু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়াম রোডে রয়েছে বেসরকারি আগা খান ইউনিভার্সিটি এবং লিয়াকত ন্যাশনাল হসপিটাল অ্যান্ড মেডিক্যাল কলেজ। এগুলোকে পাকিস্তানের ফাইভ স্টার হসপিটাল বলা চলে। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়তন ও কলেবরও চোখে পড়ার মতো। কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হাসপাতাল এবং ক্যাম্পাস খুবই দৃষ্টিনন্দন। পাকিস্তানের ধনীক শ্রেণির লোকেরাই মূলত এখানকার চিকিৎসাসেবার মূল গ্রহীতা। তবে করাচির বাইরেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা খুবই কম খরচেই মিলে। পাঞ্জাবের সরকারি হাসপাতালে মাত্র এক রুপিতে মিলে চিকিৎসাসেবা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ