ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
হোসেন মাহমুদ : ঢাকায় এবং দেশের কোনো কোনো স্থানে পুরনো জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে স্মার্টকার্ড দেয়া হয়েছে। স্মার্টকার্ড দেয়ার প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, স্মার্টকার্ড দিয়ে ২২ ধরনের সেবা মিলবে। এ সেবাগুলো হলঃ ১. আয়করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার পেতে। ২. শেয়ার আবেদন ও বিও হিসাব খোলার জন্য। ৩. ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি ও নবায়নের জন্য। ৪. পাসপোর্টের আবেদন ও নবায়নের জন্য। ৫. যানবাহনের রেজিস্ট্রেশনের জন্য। ৬. ট্রেড লাইসেন্সের জন্য। ৭. চাকরির আবেদনের জন্য। ৮. বীমা ও স্কিমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। ৯. বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে। ১০. স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে। ১১. ব্যাংকের হিসাব খুলতে। ১২. ব্যাংক ঋণ গ্রহণ বা পরিশোধের ক্ষেত্রে। ১৩. নির্বাচনের ভোটার শনাক্ত করতে। ১৪. সরকারি ভাতা উত্তোলনের ক্ষেত্রে। ১৫. সরকারি ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে। ১৬. বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে। ১৭. টেলিফোন-মোবাইলের সংযোগের ক্ষেত্রে। ১৮. ই-টিকেটিংয়ের জন্য। ১৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে। ২০. আসামী ও অপরাধী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে। ২১. আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং ২২. সিকিওরড ওয়েবে লগ-ইন করার জন্য।
যারা স্মার্টকার্ড পেয়েছেন তারা অনেকেই লক্ষ্য করেছেন যে মেয়েদের স্মার্টকার্ডে পিতা ও মাতার নাম রয়েছে, স্বামীর নাম নেই। অবিবাহিতা মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিকই আছে। কিন্তু বিবাহিতাদের ক্ষেত্রে এ নিয়ে যে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে তা বোধ হয় গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা হয়নি। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে সমস্যার নানা দিক তুলে ধরেছেন। ধরা যাক, চাকরিজীবী স্বামী অফিসে-ব্যাংকে স্ত্রীকে নমিনি করেছেন। হঠাৎ যদি তিনি মারা যান তাহলে অফিসে প্রাপ্য আদায়ে, পেনশন প্রাপ্তি ও ব্যাংকে স্বামীর রাখা অর্থের ক্ষেত্রে নমিনি প্রমাণ করতে স্ত্রীর স্মার্টকার্ড কোনো কাজে আসবে না। কারণ সেখানে স্ত্রীর মা ও বাবার নাম আছে, স্বামীর নাম নেই। অতএব মৃত ব্যক্তি যে তার স্বামী, স্মার্টকার্ডে তা প্রমাণিত হচ্ছে না। আবার ধরা যাক সম্পত্তির ক্ষেত্রে। স্বামী মারা গেছেন। স্ত্রী তার কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়েছেন। স্ত্রী ঐ সম্পত্তি দাবি করতে বা প্রয়োজনে বিক্রি করার ক্ষেত্রে স্মার্টকার্ডের সাহায্য পাচ্ছেন না। কারণ ঐ একই। ধরা যাক, স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। স্ত্রী লাশটা দাবি করতে পারবেন কি? স্মার্টকার্ডে স্বামীর নাম নেই। তিনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে অমুক তার স্বামী? সেক্ষেত্রে কাবিননামা একটা ভরসা হতে পারে। কিন্তু সবার কাছে কাবিননামা নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, তাহলে কি আগামীতে স্বামীর পরিচয় লাগবে না আমাদের মহিলাদের? দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার স্বামী বা কোনো মহিলা কোনো ব্যক্তির স্ত্রী তা স্মার্টকার্ড দিয়ে প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্টকার্ড অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো মহিলার স্বামী থাকছে না বা স্বামী আছে কি নেই তা জানা যাচ্ছে না। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াচ্ছে?
এদিকে এ বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সদ্য পিআরএলে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে সব তথ্যই রক্ষিত আছে। সেখান থেকে প্রয়োজনে সব তথ্যই দেয়া যাবে। আর যেহেতু মেয়েদের স্বামী পরিবর্তিত হতে পারে তাই মেয়েদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে স্বামীর নাম রাখা হয়নি। তার এ কথা সত্য হলে তা একাধারে এ জাতি ও দেশের নারী সমাজের জন্যই চরম অপমানজনক বলে গণ্য হতে পারে। বিষয়টি কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, এ দেশের জনসমাজে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাহ সম্পর্ক মোটেই সম্মানজনক ও সুন্দর কোনো বিষয় নয়! দুই, মনে হচ্ছে যে, আমাদের দেশে মেয়েদের স্বামী পরিবর্তনের ঘটনা এত বেশী ও এতই স্বাভাবিক ব্যাপার যে স্মার্টকার্ডে তাদের স্বামীর নাম রাখা বিড়ম্বনা বা নিষ্প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের উচ্চপদস্থ ও বিজ্ঞ কর্মকর্তারা মেয়েদের স্বামী পরিবর্তিত হতে পারে বলে স্মার্টকার্ডে তাই স্বামীর নামই রাখলেন না? এ দেশে যে বিবাহ বিচ্ছেদের দুঃখজনক ঘটনা ঘটে না তা নয়। কিন্তু তা শতকরা কয়টি? এ রকম ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হওয়া নারীর স্মার্টকার্ডটিতে সহজ পন্থায় স্বামীর নাম সংশোধন করার সুযোগ রাখলেই হত। কিন্তু এই সহজ পথ না নিয়ে তারা সকল বিবাহিতা নারীর স্বামীর নামই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এ যেন মাথাব্যথা হয় বলে মাথাই কেটে ফেলার মত।
জানা গেছে যে আগের ভোটার আইডি কার্ডে অবিবাহিতা মেয়েদের ক্ষেত্রে একই অবস্থা থাকলেও বিবাহিতা নারীদের ক্ষেত্রে স্বামীর নাম ছিল, পিতার নাম ছিল না। অন্যদিকে বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে পিতা ও মায়ের নাম থাকলেও স্ত্রীর নাম ছিল না। নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, এটাকে বৈষম্যমূলক বলা হচ্ছিল। যাহোক, আগেই নির্বাচন কমিশন নারীদের স্মার্টকার্ডে স্বামীর নামের পরিবর্তে পিতার নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
মূলত বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্মার্টকার্ডে স্বামীর নাম না রাখাটা কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি। আর এ জন্য যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা খুব সমীচীন মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, বিবাহিতা নারীদের স্মার্টকার্ডে স্বামীর নাম রাখা জরুরি। সেই সাথে তার পিতা বা মাতার নাম রাখাও যেতে পারে। অবিবাহিতা নারীদের বেলায় পিতা ও মাতার নাম ঠিকই আছে। যেসব নারীর স্বামীর পরিবর্তন হবে তাদের সহজপন্থায় দ্রæত স্বামীর নাম সংশোধনের ব্যবস্থা রাখত হবে। এ ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণ ফি নির্ধারিত হতে পারে। এক্ষেত্রে যা বিবেচিত হওয়া দরকার তা হলঃ ১. অবিবাহিতা নারী ও পুরুষদের ক্ষেত্রে পিতা ও মাতার নাম রাখা। ২. বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্বামী, পিতা ও মাতার নাম রাখা। ৩. বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে স্ত্রী, পিতা ও মাতার নাম রাখা। তাহলে আর কোনো উল্লেখযোগ্য সমস্যা হবে না বলে মনে হয়। যেসব নারীর কার্ড বিতরণ করা হয়েছে তাদের কার্ডগুলো পর্যায়ক্রমে সংশোধনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এখনো সারা দেশে স্মার্টকার্ড বিতরণের কাজ সমাপ্ত হয়নি। সুতরাং নির্বাচন কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে যৌক্তিক ও যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভেবে দেখতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।