Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পদ্মা-তিস্তার বেহাল দশা

| প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আওয়াজ উঠেছে নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও
রেজাউল করিম রাজু : বাংলাদেশ কিংবা ভারতে নদ নদী বিষয়ক সবচেয়ে বেশি আলোচিত নামটি নিঃসন্দেহে ভারতে গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে তিস্তা। এ দু’টো নদী উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ লাইন। এ দু’টো নদীর উৎসমুখে ভারতের পানি জল্লাদরা শত শত ব্যারেজ ড্যাম আর ক্যানেলের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিয়ে এর দফারফা করে ফেলেছে।
এসব বাঁধ ব্যারেজ পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে যেটুকু পানি এসেছে, তার উপরও খড়গ বসাতে একটুও দ্বিধা করেনি। মানেনি কোনো আর্ন্তজাতিক আইন-কানুন, নীতি ও মানবাধিকার বিষয়গুলো। সীমান্তের অদূরে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা আর তিস্তার উপর গজলডোবা ব্যারেজ দিয়ে পানি আটকে পদ্মা তিস্তাসহ এর অসংখ্য শাখা নদ-নদীকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলকে শুকিয়ে মারার চÐনীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। যার কুপ্রভাবে শত শত শাখা নদ-নদী ইতোমধ্যে তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। নদী তীরবর্তী প্রবীণরা বলছেন, এই রতা ৬০-৭০ বছর আগের কথা। যেখানে ছিল দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত পানির ধারা।
যার বিশাল শ্রোতধারা আমাদের করত সঞ্জীবিত সিক্ত। যা ছিল জীবনদায়িনী। কৃষি নৌ-যোগাযোগ, মৎস্য আর জীববৈচিত্রতা ও আর্থিক উৎসের আধার। সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। কি ছিল আর কি হলো? কি ভয়ঙ্কর বৈপরিত্য। এক সময়ের চঞ্চলা চিরযৌবনা আর দুরন্ত হয়ে ছুটে চলা পদ্মা তিস্তা এখন মরা নদীর নাম। অথচ একদিন যেখানে ছিল দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত পানির ধারা। এখন সেখানে একই রুপের মরীচিকা সদৃশ্য বালিচরের বিস্তার। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরা ভাসিয়ে কিংবা স্টিমার নিয়ে কলকাতা থেকে পদ্মানদী বেয়ে আসতেন তাদের জমিদারি দেখভাল করতে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর আর নওগাঁর কাচারী বাড়ি আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। এই পদ্মা নদীর রুপ রস সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ছিন্নপত্রাবলিতে বর্ণনা দিয়েছেন ‘স্টিমার যখন ইছামতি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা বেলায় পদ্মার মধ্যে এসে পড়ল, তখন সে কি সুন্দর শোভা দেখেছিলাম। সে আর কি বলব। কোথাও কোথাও কুলকিনারা দেখা যাচ্ছে না। ঢেউ নেই সমস্ত প্রশান্ত গভীর পরিপূর্ণ। ইচ্ছা করলে যে এখনই প্রলয় করে দিতে পারে সে যখন সুন্দর প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করে সে যখন প্রশান্ত প্রবল ক্ষমতাকে সৌম্য মাধুর্যে প্রচ্ছন্ন করে রেখে দেয়। এখন তার সৌন্দর্য এবং মহিমা একত্রে মিশে একটা চমৎকার উদার সম্পন্নতা ধারণ করে। ক্রমে যখন গোধুলী ঘনীভ‚ত হয়ে উঠল, তখন আমার মুগ্ধ হৃদয়ের মধ্যে সমস্ত তারগুলো যেন বেজে উঠতে লাগল’’। পদ্মার রুপ নিয়ে রবিঠাকুরের এই বর্ণনায় পদ্মা তীরবর্তী মানুষ নিজের অজান্তে বলে উঠেন, তিনি আজ বেঁচে থাকলে বর্তমান পদ্মার এ বেহাল দশা দেখে তার কি বর্ণনা দিতেন। সুকণ্ঠী ফেরদৌসী রহমানের সেই পদ্মার ঢেউরে। মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যারে...। এখন পদ্মার তীরে দাড়ালে শূন্য হৃদয় নয় একেবারে খাঁ খাঁ করে ওঠে। ভারতের আগ্রাসী পানিনীতি আর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মরণ বাঁধ হিসেবে খ্যাত ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’ বিগত সাড়ে চার দশকে পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলোর দফারফা করে ছেড়েছে। এক সময়ের অন্যতম নদী হিসেবে পরিচিত পদ্মা এখন বিশাল বালিচরের নিচে চাপা পড়ে হাহাকার করছে। দেখলে মনে হয়, নদী নয় যেন নদীর জীবাশ্ম ফসিল। এক সময়ের যৌবনা আর দুরন্ত হয়ে ছুটে চলা পদ্মা এখন মরা নদীর নাম। শাখা প্রশাখা নদ-নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবত এদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনা। নৌকা নয়, চলে চাষাবাদ। এসব নদীর নাম মানচিত্র আর কিছু বইয়ের পাতায় অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদীটি এখন নর্দমার নাম নিয়ে বেচে আছে। ফারাক্কা ছাড়াও আরো বেশকটি নদীতে ভারত বাঁধ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, আত্রাই ও ধরলা। এসব নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে এসব নদী ছাড়াও এর শাখা-উপশাখা নদীগুলো অস্তিত্ব হারানোর পথে। যেমনÑ পুনর্ভবা, টাঙ্গন, চাওয়াই, নাগর, চিলফা, টেপা, ডাহুক, ভেরসা, পাথরাজ, তিরনাই, সিনুয়া, হাতুড়ির অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি শুধু এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোকে শুকিয়ে মারেনি। যার প্রভাব পড়েছে এসব নদীর সাথে সংযুক্ত খাল-বিল। এসব শুকিয়ে গেছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত বিল যার বিস্তৃতি দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটা বিল না নদী। বিল হালতি, বিলহিলনা, মহানগর, বিলভাতিয়া, উথরাইল, খিবিরবিল, চাতরা, মান্দারবিল, বিলকুমলী, পাতিখোলা, অঙ্গরা, চাঙ্গা, দিকমী, পারুল, সতী, মালসী, ছোনী, বাঘনদী, পিয়ারুল, মিরাট, রক্তদহ, কুমারীদহ, খুকসী, জবায়ের, বাঁধ বাড়িয়া গ্রামের বিল আর দহ হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। নদ-নদী খাল বিলগুলোয় এখন বর্ষা মৌসুমে পানি জানান দেয় তাদের অস্তিত্বের কথা। নদী-খাল-বিল মরে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। খাল-বিল-দীঘি ভরা মাছ নেই। হারিয়ে গেছে অর্ধশত বেশি প্রজাতির মাছ। নৌযোগাযোগ আর নেই। নদ-নদী আর বিলের বুকে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের এতে আবাদী জমি বাড়ার সাময়িক প্রাপ্ত আর ফসল পেলেও সুদুরপ্রসারী প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে। চারিদিক থেকে মরুময়তা ধেয়ে আসছে। ভারত তার পানি আগ্রাসী নীতিতে গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশের মহাবির্পযয় ডেকে এনে ক্ষান্ত হয়নি, ভারত সীমান্তের ওপারে তিস্তা নদীর ওপারে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে পুরো উত্তরাঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীও পদ্মার পরিণতি লাভ করেছে। ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে কুষ্টিয়া যেমন গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। তেমনি গজলডোবা ব্যারেজের কারণে তিস্তার ১২৫ কিলোমিটার জুড়ে এখন পানির বদলে বালির উত্তাপ। তিস্তাসহ এ আঞ্চলে ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আলিয়া দুধকুমার, বুড়ি, তিস্তাসহ ৩৫টি ছোট-বড় নদ-নদী অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। উত্তরের নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জয়পুরহাট জেলার ৩৫ উপজেলায় সাড়ে তের লাখ একর জমিতে চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন তিস্তা ব্যারাজ পানির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পদ্মা তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলো পানি বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের দাদাগিরির নিচে চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে নদ-নদীগুলো। ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি শুধু গঙ্গা-তিস্তায় নয়, ভারতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে আসা ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টিতে উৎস হতে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বাঁধ ব্যারাজ খাল দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে একটা গ্যারান্টিক্লজহীন ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি করলেও বিগত ২০ বছরে বাংলাদেশ কখনো তার পানির নায্য হিস্যা পায়নি। চুক্তির নামে হয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। পদ্মা অববাহিকার কোটি কোটি মানুষ তাদের ইচ্ছার পুতুল হয়েছে। শুকনো মৌসুুমে শুকিয়ে মারা। আর বর্ষায় সব গেট খুলে ডুবিয়ে আবার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেনÑ চুক্তি আছে পানি নাই, তবুও ওদের লজ্জা নাই। বছর দুয়েক আগে ফারাক্কার নড়বড়ে তিনটি গেটের ফোকর দিয়ে কিছু পানি বেরিয়ে এলে পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গেল গেল বলে একেবারে হৈ চৈ-রৈ রৈ করে ওঠেন। আরেকটি ব্যারেজ নির্মাণের দাবি তুলেন। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি তার কারণে থমকে গেছে। গঙ্গা-পদ্মা চুক্তি নিয়ে প্রতারণার কারণে পদ্মা পাড়ের ভুক্তভোগী মানুষ ওদের কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। ভাবতে পারেনা ভালো বন্ধু হিসেবে। ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি তিস্তার পানি চুক্তির নামে অপরাজনীতি নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ ভয় পাচ্ছে। গঙ্গা পদ্মার চুক্তির বেহাল দশা দেখে বিভিন্ন মহল থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তিস্তা পানি নিয়ে বাংলাদেশ কি আরেক ফারাক্কার পরিণতির অপেক্ষা করছে। তিস্তা চুক্তি হলেও ফারাক্কার মতো হবে না তা কে জানে। ভারত আর্ন্তজাতিক আইন ও রীতিনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অভিন্ন নদীর পানি সরানোর অধিকার রাখে না। পানি বাংলাদেশের নায্য অধিকার। আইনি লড়াই করে আমরা যেমন সমুদ্র অধিকার আদায় করেছি, তেমনি নদীর উৎস্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে নদীর পানির সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে আর্ন্তজাতিক আদালতে মামলা করে অভিন্ন নদীগুলোর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। এ নিয়ে নোংরা রাজনীতি নয়। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজ চারিদিকে আওয়াজ উঠেছে নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও।



 

Show all comments
  • Selina ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ৬:৩০ এএম says : 0
    Generally general assembly season of UN held October month agenda finalize within May month , hope to maintain and uphold existence of our ,54 river natural water flow related mattter .no damp no barrier in natural water flow .unity ....only unity could save our dignity and soil . Thanks.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ