Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাকিস্তানী নারীর এগিয়ে চলা

| প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আহমদ আতিক, পাকিস্তান থেকে ফিরে : মটরওয়েতে ইসলামাবাদ থেকে লাহোর। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। মনোরম দৃশ্যপট পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলছে দূরপাল্লার বাসগুলো। যাত্রাপথও অসাধারণ। বিশেষভাবে সাজানো বাসগুলোর যাত্রায়ও বিমান যাত্রার অনুভূতি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মেয়েরা দূরপাল্লার এসব বাসের যাত্রীদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে।
শুধু লাহোর ইসলামাবাদই নয়, পাকিস্তানের করাচিসহ বিভিন্ন শহরে নারীদের জন্য চালু হয়েছে ক্যাব সার্ভিস। সমাজের সব অঙ্গনেই তাদের সরব উপস্থিতি দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। নারীদের নিয়ে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও মটরওয়ের সাথে সাথে পাকিস্তান নিয়ে প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিচ্ছে বাস হোস্টেজ (বাসবালা) বা ক্যাব পাইলটরা। ইসলামাবাদ থেকে লাহোরের পথে বাস ছাড়ার সাথে সাথেই কুরআন তিলাওয়াত করলো এক বাসবালা। তারপর বিমানবালাদের মতোই যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো বলে দেয়া। প্রায় ৪শ’ কিলোমিটার পথের যাত্রার শুরুতেই যাত্রীদের সরবরাহ করা হয় হেডফোন। যাতে উড়োজাহাজের কায়দায় স্থাপিত সামনের টিভি মনিটর থেকে বিনোদনের চাহিদা মেটানো সহজ হয়। কিছুক্ষণ পরই যাত্রীদের সরবরাহ করা হচ্ছে নাস্তার প্যাকেট, পানির বোতল এবং কোমল পানীয়। মটরওয়েতে যাত্রা এতটাই মসৃণ যে, হাতের গøাসের পানীয়তেও কম্পন হচ্ছে না। বোঝারই উপায় নেই যে, বাস না উড়োজাহাজ যাত্রা। আর এর চালকদের পোশাকও পাইলটদের মতোই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে পরিকল্পনার পর নির্মাণ শুরু হওয়া পাকিস্তানের এ মটরওয়ে হলো দেশটির ন্যাশনাল ট্রেড করিডর। এটি দেশটির করাচি বন্দর এবং গোয়াদার বন্দরকে যুক্ত করছে। ভবিষ্যতে এ সড়ক নেটওয়ার্ক আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ এবং চীনের সাথে সহযোগকারী হিসেবে কাজ করবে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১০ কিলোমিটার মটরওয়ে নির্মাণ শেষ হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এ সড়কপথের মোট ৩ হাজার ৬শ’ ৯০ কিলোমিটার নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এটি তখন চীনের কাশগড় শহরের সাথে গোয়াদর বন্দরের সরাসরি সংযোগ ঘটাবে। এছাড়া পাকিস্তান বিমান বাহিনী জরুরি প্রয়োজনে এ মটরওয়ের কয়েকটি স্থানকে বিমান অবতরণ এবং উড্ডয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারবে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতিনিধিদলকে আপ্যায়ন এবং যাত্রীদের নামাজের বিরতির জন্য মাঝপথে উদ্যানের মতো একটি মোটেল জোন সারগোদায় থামল হেলাল পরিবহনের বিলাশবহুল বাস। এ সুযোগেই বাসটির দায়িত্বরত সেবিকা (সুপারভাইজার)-এর সাথে আলাপ হলো। তার নাম ইকরা খান (২২)। বাড়ি ইসলামাবাদের পাশে ফয়সালাবাদে। করাচি থেকে তার পিতা এ শহরে এসে স্থায়ী হয়েছেন। তার সব ভাই-বোনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। ইকরা জানাল, পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক তরুণী বাস হোস্টেজের এ সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তারাও তিন বোন এ পেশায় যুক্ত। প্রায় প্রতিদিনই ইকরা লাহোর-ইসলামাবাদের পথে যাত্রীদের দেখভাল করছেন। তাদের রয়েছে নির্দিষ্ট পোশাক। চকলেট রঙের স্কার্ফ, পাজামা এবং কুর্তা। সাথে আকাশি রঙের জামা।
ইকরা জানালেন, এক শহর থেকে আরেক শহরে পৌঁছবার পর এসব বাস হোস্টেজদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে হোস্টেলের ব্যবস্থা। একবারের যাত্রাপথের জন্য তার আয় ৭শ’ রুপী। সিনিয়রদের আরো কিছু বেশি। ভবিষ্যতে ইকরা বিমানবালা হতে চায়। আর এজন্য বাস হোস্টেজের চাকরি তার অভিজ্ঞতা হিসেবে ভালো কাজে দেবে বলে জানান তিনি। তবে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে আছে ইকরার। গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করলেও বিয়ের পরই সে উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করবে বলে জানায় ইকরা।
শুধু বাসে কেন করাচি শহরে গত মার্চ থেকে চালু হয়েছে পিঙ্ক ক্যাব সার্ভিস। যাকে বলা হয় প্যাক্সি ট্যাক্সি। এর চালক নারী। তেমনি এর যাত্রীকেও হতে হবে নারী। ক্যাবের রং যেমন গোলাপি তেমনি চালকের মাথায়ও রয়েছে গোলাপি স্কার্ফ। নারীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য মাইক্রোবাসের এসব ক্যাব বহর ছুটে চলছে শহরময়। নারী পর্যটক বা যাত্রীরা মোবাইল ফোনকল, এসএমএস বা নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে এসব ক্যাবকে ডেকে নিয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। কোনোভাবেই এতে কোনো নারী যাত্রীর পুরুষ আত্মীয় বা সঙ্গীকে বহন করা হয় না। এর চালককে বলা হয় পাইলট। তাদের গায়ে থাকবে গোলাপি স্কার্ফ এবং কালো কোট। করাচির পূর্বাংশেই এসব ট্যাক্সি ক্যাবের সার্ভিস প্রাথমিকভাবে বেশি রাখা হয়েছে। তবে এসব ক্যাবের ভাড়ার হার বেশি বলে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ডেইলি নওসিজ করাচির প্রধান সম্পাদিকা জাহিদা আব্বাসী অবশ্য বললেন, প্রথমদিকে এর ভাড়া কিছুটা বেশি হলেও ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে হয়তো তা আরো কমিয়ে আনবে উদ্যোক্তা কোম্পানি। নারীদের জন্য এ সার্ভিস একটি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে।
জানা গেছে, করাচির পর এসব ক্যাব সার্ভিস লাহোর এবং ইসলামাবাদের মতো শহরেও চলতি বছরের প্রথমার্ধেই চালু হবে।
শুধু মহাসড়কেই নয়। পাকিস্তানে নারীরা এখন সব পেশাতেই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি টিভি চ্যানেলগুলোতে এবং সংবাদপত্রে নারী সাংবাদিকদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে মেয়েরা এখন সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি পাচ্ছেন বলে জানালেন, লাহোরের ডেইলি নওয়া-ই-ওয়াক্ত এর ডেপুটি চিফ রিপোর্টার শোয়েব উদ্দীন সাইয়্যেদ। তিনি বলেন, পাকিস্তানের মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। সেই সাথে সরকারি চাকুরিসহ বেসরকারি খাতের বিভিন্ন পেশায় আগের চেয়ে বেশি অংশ নিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, লাহোরের ন্যাশনাল আর্ট কলেজে গিয়ে সরেজমিনে দেখা গেল যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। পোশাকেও রয়েছে পাশ্চাত্য ফ্যাশনের ছোঁয়া। কলেজটির মিনিয়েচার পেইন্টিং বিভাগের আন্ডার গ্রাজুয়েট এক শিক্ষার্থী মায়মুনাকে রক্ষণশীল পাকিস্তানে কীভাবে শিল্পকলাবিষয়ক কোর্সে ভর্তি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবারতো কখনোই শিল্পকলাবিষয়ক কলেজে ভর্তি হতে দিতেই রাজি হয়নি। তবে অনেক ধকল পার হয়ে তবে ভর্তি হতে পেরেছেন বলে জানান মায়মুনা। তার সহপাঠিদেরও একই কথা।
তবে বাংলাদেশী নারীদের নিয়েও সমান আগ্রহ পাকিস্তানি নারীদের। লাহোরের নারীদের মার্কেট লিবার্টির সামনে তিন বাংলাদেশী সাংবাদিক গোলা’র (বরফের সাথে মিষ্টান্নযুক্ত আইসক্রিম) অর্ডার দিয়ে হাতে পাবার জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় এক নারীও তার সন্তানদের নিয়ে সেখানে গোলা খেতে আসেন।
বাংলাদেশী সাংবাদিকদের কথা শুনে তিনি উর্দুতে বলেন যে, ঢাকার মেয়েরা খুবই সুন্দরী। ডাগর ডাগর চোখ আর কালো লম্বা চুল। খুবই সুন্দরী। তবে এক সাংবাদিক তার কথার সাথেই বলেন যে, না লাহোরের মেয়েরাতো আরো সুন্দরী। এ কথা শুনেই ঐ নারী বলে উঠেন, হ্যাঁ। লাহোর কী লারকি তো হুরি হায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ