Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জঙ্গি : মেইড ইন বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হযরত শাহজালাল পিতৃভূমি ইয়েমেন থেকে মহান আল্লাহর নাম নিয়ে ইসলাম প্রচারে বেরিয়ে পড়েন। কথা ছিল, হযরত শাহ জালালের সঙ্গে আনা মাটির সঙ্গে যে মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানেই হুজরা স্থাপন করবেন তিনি। দেশ-উপমহাদেশ পেরিয়ে রাজা গোবিন্দের গৌড় রাজ্যে এসে সঙ্গে আনা মাটির মিল পান হযরত চাষনীপীর (রঃ)। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় এখানেই হুজরা স্থাপন করেন পীর শাহ জালাল, বীর শাহজালাল। হযরত শাহ জালালের হাতে তসবিহ এবং তলোয়ার দুটিই ছিল। তলোয়ার ইস্তেমাল করতে হয়নি এই পিরানে পীরকে। মহান আল্লাহর অপার রহমত-বরকতে আধ্যাত্মিক শক্তিতেই গৌড় জয় করেন বীর শাহজালাল। গৌড় রাজ্য হয় সিলহট থেকে সিলহেট। অতঃপর সিলহট থেকে সিলেট। এই পীরে কামেলের নামে পুণ্যভূমিকে জালালাবাদও বলা হয়। তাঁর সঙ্গে আসা আউলিয়ার সংখ্যা তিনশত ষাটজন থাকায় সিলেটকে তিনশত ষাট আউলিয়ার মুল্লুক বলা হয়। হযরত শাহজালালের প্রধান সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দীন হবিগঞ্জের মুড়ারবন্দে, হযরত সৈয়দ শাহমোস্তফা ইটা রাজ্যাধীন সামন্ত শাসক চন্দ্র নারায়ণের রাজ্যে তশরিফ আনয়ন করে হুজরা স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তারই নামে মোস্তফাপুর ইউনিয়ন, মোস্তফাপুর গ্রাম, শাহ্ মোস্তফা সড়ক, শাহ্ মোস্তফা কলেজ ইত্যাদি
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে সুসভ্য, সংস্কৃতিবান ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। বৃহত্তর সিলেটের আইনশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় ঐতিহ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ধর্মগতভাবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রমুখ ধর্মাবলম্বী এবং খাসিয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরী, মুরং ইত্যাদি উপজাতি স্মরণাতীতকাল থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সঙ্গে বসবাস করছে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধা জনতা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেরই সুসন্তান। দেশীয় অর্থনীতিতে বৃহত্তর সিলেটবাসীর ভূমিকা অনেক। সিলেট অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে জাতীয় অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করছেন। দেশে গৃহায়ন খাতে বিনিয়োগ করে দৃষ্টিনন্দন বাসাবাড়ি-হোটেল-মোটেল নির্মাণ করে আবাসিক সমস্যার সমাধান করছেন।
ধর্মীয় বিপথগামী কিছু দেশীয় জঙ্গির সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রমে বৃহত্তর সিলেটের গৌরবময় অতীত-ঐতিহ্য প্রশ্নের সম্মুখীন। ইতিপূর্বে হযরত শাহ জালালের দরগা প্রাঙ্গণে বাংলাদেশে বৃটিশ হাইকমিশনার এই সিলেটেরই সুসন্তান আনোয়ার চৌধুরীকে হামলা করে জঙ্গিরা সিলেটের ঐতিহ্য ইমেজ ও ভাবমূর্তিকে ক্ষণœ করেছিল। অতি সম্প্রতি সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন নসরতপুর এবং পৌর এলাকার বড়হাটে উপস্থিতি, অবস্থান ও কার্যক্রমের মাধ্যমে জঙ্গিরা যেন সদম্ভে জানান দিল, আমরা ছিলাম আমরা আছি। নাসিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত হয় লোকমান আলী (৪৫), তার স্ত্রী শিরিন আক্তার (৩৫) তার সন্তান আমেনা খাতুন (১৪), সুমাইয়া আক্তার (৯) এবং ফাতেমা মরিওম (৫) এবং ছয় মাস বয়সী শিশুকন্যা খাদিজা। জঙ্গিদের মূল বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। জঙ্গি লোকমানের শ্বশুর আবু বকর দেশ থেকে এসে লাশ শনাক্ত করেছেন। পৌর এলাকাধীন বড়হাটে নিহত তিন জঙ্গির একজনের নাম আশরাফুল আলম নাজিম। সে নোয়াখালী জেলাধীন সুনাইমুড়ি উপজেলার বাসিন্দা। আশরাফুল আতিয়া মহলের বোমা হামলাকারী বলে জানা যায়। হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রঃ)র স্মৃতিবিজড়িত মৌলভীবাজারের নসরতপুর এবং বড়হাটে গোয়েন্দা বিভাগ জঙ্গি অবস্থানের খবর পেয়েই নড়েচড়ে বসে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনগণ দৃঢ়তার সাথে জঙ্গিদের মোকাবেলা করে। জনগণ নিঃশর্ত সমর্থন জানায় ল-এনফোর্সিং এজেন্সিকে, প্রাসঙ্গিক সহযোগিতাও দেয়। বাস্তবে দেখা গেছে, এসব সন্ত্রাসী দাড়ি-টুপিওয়ালা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মাদ্রাসা পড়–য়া তালবে এলেম নয়। এরা দামিনামি ভার্সিটি পড়–য়া ধনীর দুলাল। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাই যথার্থই বলেছেন মাদ্রাসার ছাত্ররা জঙ্গি নয়। জঙ্গি ও জং প্রসঙ্গে তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বলা চলে, জং-একটি উর্দু শব্দ, বাংলায় যুদ্ধ। করাচীতে জং নামে একটি বিখ্যাত উর্দু দৈনিক আছে। একজন ভারতীয় কবি ও গীতিকার বলেছেন, জিন্দেগী হরকদম এক নয়ী জং হ্যায়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একটি নতুন যুদ্ধ। সত্যিকার অর্থেই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একটি নতুন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অস্ত্র ও বোমাবাজির যুদ্ধ নয়, কারণ তা কখনও ধর্ম ও দেশে প্রচলিত আইন সমর্থন করে না। সন্ত্রাসীরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম, রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পবিত্র আল-কোরআনের বিরোধিতা করছে। এদের ধ্বংস অনিবার্য। ইতিপূর্বে এই উপমহাদেশে মাওবাদী সন্ত্রাসীরা মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ কায়েমের নামে গুপ্তহত্যা সন্ত্রাস করে নিজেরাই নির্মূল হয়েছে। জনগণ কখনও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। বরং প্রশাসন জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করে।
শান্তির ধর্ম মহাপবিত্র ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা মুসলিম উম্মার কোন আলেম-ওলামা বা ফতোয়ার ক্ষমতাধারী মুফতি নয়। ইসলামী শাসনের একমাত্র নমুনা ইসলাম ধর্মের প্রচারক-আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফার শাসনামল এবং মহানবীর বিশ্বস্ত ছাহাবী খোলাফায়ে রাশেদীন নামে পরিচিত চার খলিফার শাসনামল। অতঃপর খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ ব্যতীত পৃথিবীর কোথাও কখনও ইসলামী শাসন ছিল না, মুসলিম শাসন ছিল। মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর পরবর্তীকালে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় কোথাও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ছিল না। ইসলামী দল কিংবা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে তাদের কর্মকান্ডে ইসলামী আকিদা, অনুশাসন, জীবন-দর্শন মেনে চলতে হয়। মনে রাখতে হবে, ইসলামে জঙ্গিবাদ কিংবা কোন সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই। মহান আল্লাহ কালামে পাক আল-কোরআনে বলেছেন, আলফিতানাতু ইয়াশাদ্দু মিন কাতলে। সমাজের অভ্যন্তরে ফেৎনা-ফ্যাসাদ-ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করা খুনের চাইতেও ঘৃণ্য অপরাধ। এইসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সমাজের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি-ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বোমা মেরে, আত্মঘাতী কর্মকান্ড করে আল কোরআনের বিরোধিতা করছে, গোনাহর কাজ করছে। দেশ বিদেশের তাবত আলেম একসুর, এক বাক্যে জঙ্গি-সন্ত্রীদের সন্ত্রসী কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছেন।
জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক হলেও একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। জঙ্গি দেশী না বিদেশী তা এখন ভাববার সময় নয়। বোমা বাংলাদেশী হলেও ফুটছে। মানুষ মরছে। দেশী জঙ্গিরা বিদেশী জঙ্গিদের মত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। সমস্যাটি জাতীয় বিধায় এর সমাধান জাতীয় ঐকমত্য অত্যাবশ্যক। সরকারকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে। অহংকার ও অহংবোধের চাইতে জনগণের জীবন ও সম্পত্তির মূল্য অনেক বেশি। আমাদের সেই পুরাতন প্রবাদ বাক্যটি মনে রাখতে হবে, ‘নগরে আগুন লাগলে মসজিদ-মন্দির-গির্জা কোনটাই বাদ যায় না।’ কারণ আগুন সবকিছুকে সমানভাবে পুড়িয়ে ধ্বংস করে। আমাদের চিন্তা, চেতনা, বিবেক, বুদ্ধি শানিত হোক, বোধোদয় হোক। মহান মালিক আমাদের এসব আপদ-বিপদ-আজাব-গজব থেকে পানাহ দিন।
লেখক : সেক্রেটারি, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন