Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

কৃষকদের দুর্যোগে পাশে আছি -প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ

হাওরবাসীর জন্য ইকোনমিক জোনের প্রস্তাব

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে : প্রসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন দুর্যোগের সময় যেভাবে দেশের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক তেমনিভাবে কৃষকদের দুর্যোগে পাশে আছি। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষকদের কান্না শুরু হলে ২৪ ঘণ্টা পর কিশোরগঞ্জের মানুষকেও কাঁদতে হয়। কারণ সুনামগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ একই সূত্রে গাথা। সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল ডুবলে কিশোরগঞ্জের হাওরও ডুবে। তিনি বলেন, যারা এবার আগাম বন্যায় ফসল হারিয়েছেন তাদের জন্য কতটুকু করতে পারব জানিনা। তবে আমার চেষ্টা থাকবে কিছু করার এবং সে প্রচেষ্টা একেবারে বিফলেও যাবে না ইনশাআল্লাহ। সে বিশ্বাস ও আশা আমার আছে। তিনি সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ২ মে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহŸান করেছি। সেই সংসদের অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের হাওরবাসীর জন্য জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। তুলে ধরতে হবে কৃষকদের দুর্দশার কথা, কৃষকদের দাবির কথা। না কাঁদলে দাবি আদায় হয় না। তিনি বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট হলেও সরকারের মন্ত্রীরা আছেন, আশা করি তারা ফসলহারা কৃষকদের জন্য কিছু করবেন। সোমবার রাত ১০টায় সুনামগঞ্জের শিল্পকলা একাডেমির হাসনরাজা মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ড. জয়া সেন গুপ্ত , সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুন নাহার শাহানা রব্বানী, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহমদ তৌফিক, শিক্ষাবিদ পরিমল কান্তি দে, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আলী আমজদ, সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার নাজমুনআরা খানম, সিলেটের ডিআইজি কামরুল আহসান, সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. বরকত উল্লা খান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুলহুদা মুকুট, পৌর মেয়র আয়ুব বক্ত জসলুল, সিনিয়র সাংবাদিক কামরুজ্জামান চৌধুরী সাফি, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আলী আমজদ, অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম, অধ্যক্ষ ইদ্রিছ আলী বীর প্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, অবনী মোহন দাস, সাংবাদিক বিজন সেন রায়, সাংবাদিক পংকজ কান্তি দে, অ্যাডেভোকেট শামসুল আবেদীন, সাংবাদিক আল হেলাল ও সেলিনা বেগম প্রমুখ। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ কিশোরগঞ্জ থেকে হেলিকপ্টার যোগে দুপুরে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইন মাঠের হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। হেলিপ্যাড থেকে তিনি সার্কিট হাউসে যান। সেখানে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। দুপুরের খাবার ও বিশ্রামের পর তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিনিধি এবং জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। মতবিনিময় সভায় প্রেসিডেন্ট ১০টায় বক্তৃতা শুরু করেন। প্রায় ৫৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী হলেও চলাফেরা ছিল সাদামাটা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সাদামাটা একটি ফুলশার্ট গায়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হাসনরাজা মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। হলে ঢুকে হাত নেড়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন। তিনি নিজেই উত্তরে বলেন, ফসল হারিয়ে আপনারা ভালো নেই। এর আগে প্রেসিডেন্ট সার্কিট হাউসে সুনামগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। রাত ১১টার পর সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। শিল্পকলা একাডেমির ৫৫ মিনিটের বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর নিকট হাওরবাসীর জন্য ইকোনমিক জোন করার প্রস্থাব রেখেছি। যাতে করে হারাঞ্চলের মানুষ কাজ করে বেঁচে থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে আমার এ প্রস্তাব দেয়া আছে। প্রেসিডেন্ট বলেন, হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সংশ্লিষ্টি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সাথে কথা বলব। চেষ্টা করব কিছু করা যায় কিনা। তিনি বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট হলেও সরকারের মন্ত্রীরা আছেন, আশাকরি তারা ফসলহারা কৃষকদের জন্য কিছু করবেন। তিনি বলেন, আমাদের নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদীর পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। তাই শুধু হাওর রক্ষা বাঁধ দিয়ে হাওরের ফসল রক্ষা হবে না। হাওরের ফসল রক্ষা করতে হলে নদীর উৎসস্থল থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদীগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ হলেও ফসল রক্ষার ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই। নতুবা আগাম বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত করবে। হাওর রক্ষা মাটির বাঁধ বছর বছর দিতে হয় এবং বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিও হয়। প্রেসিডেন্ট বিশিষ্টজনদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা প্রায় সবাই বলছেন হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। আপনারা এখানকার বিশিষ্টজনরা থাকতে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিটা হলো কেন। সকলে এভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি হতো না। তিনি বলেন, এবার হাওরাঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে না দাঁড়ালে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মানুষ রাজধানীমুখী হয়ে পড়বে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে রাজধানীও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। প্রেসিডেন্ট বলেন, হাওরাঞ্চলের মানুষের দুর্দশা লাঘবে আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত খোলাবাজারে চাল বিক্রির প্রয়োজনীতা রযেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমি সুনামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যুদ্ধকালীন সময়ের সুনামগঞ্জের অনেক স্মৃতি আমার মনে পড়ে। অনেক কষ্ট করেছি, না খেয়ে থেকেছি। সুনামগঞ্জে এর আগেও আসার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আসতে পারিনি। কেউ আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে আসে নাই। এবার আমার সুযোগ হয়েছে। আমি হাওরবাসীর দুর্যোগে নিজ উদ্যোগে এবার সুনামগঞ্জে এসেছি, তবে এমন দুর্যোগ আমি চাই না। এমন দুর্যোগ যেন আর কখনো না হয়। এর আগে প্রেসিডেন্ট কিশোরগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ আসার পথে হেলিকপ্টারে বসে লো-ফ্লাই করে আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি হাওর দেখেন। সুনামগঞ্জের দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর বোরো ফসলের মধ্যে এবার চৈত্রের অতিবৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢলের চাপে ও হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রায় ৯০ ভাগ বোরো ফসল তলিয়ে যায়। হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিন্তু সময়মতো বাঁধে কাজ না করে অসময়ে কাজ শুরু করায় এক এক করে ভেঙে যায় বাঁধগুলো। ডুবে যায় কৃষকের কষ্টের বোরো ফসল। অতিবৃষ্টিপাত একটি কারণ তো রয়েছেই। তবে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে শুরু থেকেই। এ অভিযোগ ছিল পাউবোর কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসির (প্রজেক্টে ইমপ্লিমেনটেশন কিমিটি) বিরুদ্ধে। বৃষ্টিপাতের কারণে পানিবদ্ধতায় ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণকারীদের গাফিলতি অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অঞ্চলের একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে কৃষকরা এখন নিঃস্ব। গত ক’দিন থেকে এ এলাকার হাওরের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একদিকে কৃষকের ঘরে নেই ফসল, অন্যদিকে নেই হাতে টাকা। ফলে দেখা দেয় হাওরাঞ্চলে কৃষকদের ঘরে হাহাকার। প্রসিডেন্ট আব্দুল হামিদের নিজ জেলা কিশোরগঞ্জেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষযটি প্রাধান্য পায়। তাই প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ও সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হাওর দেখার জন্য বঙ্গভবন থেকে বের হন। তিনি প্রথমে কিশোরগঞ্জ ও পরে সুনামগঞ্জ আসেন। প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট সাব-সেক্টর ও বালাট সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জের প্রতি তার মনের টান ছিল। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিবিজরিত সুনামগঞ্জকে দেখার। কৃষকদের দুর্দশার কথা শুনে ঢাকায় বঙ্গভবনে বসে থাকতে পারেননি। ছুটে আসেন কৃষকদের তথা দুঃখী মানুষের কথা শুনতে। এরশাদ সরকারের পর এটি ছিল কোনো প্রেসিডেন্টর প্রথম সুনামগঞ্জ সফর। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ রাতে সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে অবস্থান করেন। মঙ্গলবার দুপুরে বঙ্গভবনের উদ্দেশে সুনামগঞ্জ ত্যাগ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ