Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অধরাই থেকে গেল তিস্তা চুক্তি

| প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : অধরাই থেকে গেল তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরেও তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হয়নি। উল্টো তিস্তা নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যাকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলেও তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে আদৌ কোনো চুক্তি হবে কীনাÑ এমন সংশয় এখন জোরালোভাবেই আলোচনায় এসেছে।
দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দিনভর যে রশি টানাটানি হয়েছে; তাতে এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে যেÑ তিস্তা আদৌ আর ক‚টনৈতিক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি উপকরণেই পরিণত হয়েছে।
এদিকে, তিস্তার পানি প্রবাহ আরও কমে গেছে। পানি এসে দাঁড়িয়েছে ৪শ’ কিউসেকের কিছু উপরে। এতে করে তিস্তা অববাহিকার মানুষের মাঝে আরও হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তিস্তায় পানি নেই বলে মমতা ব্যানার্জি যখন বলেছেন, তিস্তার পানি চলে গেলে আমাদের উত্তরবঙ্গের (ভারতীয় অংশে) প্রভূত সমস্যা হবে। আর সে কারণে তিনি তিস্তার কথা সরিয়ে রেখে বিকল্প প্রস্তাব রেখে বলেন, তিস্তার বদলে আলোচনা হোক তোর্সা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে।
শুধু তোর্সাই নয়; সেই সাথে মানসাই, ধানসাই, ধরলা নদীর পানিবন্টনের প্রস্তাবনাও মমতা রেখেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়াটা বাংলাদেশের মানুষের অধিকার। কিন্তু এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে যেসব নদীর পানি ভাগাভাগির কথা বলা হয়েছে, এসব নদীর পানি এদেশের মানুষের কোনো কাজেই আসে না। পক্ষান্তরে তিস্তা হচ্ছে এ দেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। উত্তরাঞ্চলের আড়াই কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়াটা অপরিহার্য।
অপরদিকে তিস্তা নিয়ে মমতা যাই বলুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে অনুরোধ করেছেন ২০১১ সালে হওয়া সমঝোতা অনুযায়ীই তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন, তাঁর সরকার দ্রæত এই চুক্তি সম্পাদন করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে যে জট ভারত লাগিয়েছে তার সমাধানটাও ভারতের হাতেই।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত যেসব সমস্যা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, তার একটি তিস্তার পানিবণ্টন। ভারত এই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করায় উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রামে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
নদীতে পানি না থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের বিরাট এলাকায় চাষাবাদে বিঘœ ঘটছে। ভারত শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে এই নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় তিস্তা সেচ প্রকল্পে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ।
জানা গেছে, তিস্তা সেচ প্রকল্পে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ যেখানে ৬০ হাজার হেক্টর; সেখানে এই সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে ১০ হাজার হেক্টরে আনা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছেÑ পানির অভাবে এই পরিমাণ জমিতেও ঠিকমত সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে তিস্তায় পানির পরিমাণ ৪শ’ কিউসেকের কিছু উপরে অবস্থান করছে। ২০১৫ সালে তিস্তায় পানির স্মরণকালের সর্বনি¤œ প্রবাহ ছিল ৩৪২ কিউসেক।
এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষক আবদুল বাসেত বলেন, এবার বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, তার অনেক জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। কারণ হিসাবে তিনি জানান, এত বিপুল অর্থ খরচ করে তার পক্ষে আবাদ করা সম্ভব নয়।
বাসেতের মত তিস্তা অববাহিকার সকল কৃষকেরই প্রত্যাশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি হবে। এতে করে তিস্তা নদীর নাব্যতা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। তিস্তা পারের এসব হতভাগ্য কৃষকের প্রত্যাশার সেই গোড়ায় বালি। বরং মমতার উল্টো প্রস্তাব তিস্তা নদীর অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলেছে। নদী শুকিয়ে চারিদিকে শুধু ধূ ধূ বালুর চর। নদীতে কোনো নাব্যতা নেই। নদীর ক্ষীণ নাল গড়িয়ে ব্যারাজের মুখে এসে যেটুকু পানি জমছে, সেই পানি মূল খালে প্রবেশ করিয়ে চলছে সেচ কাজ।
যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানায়, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ ভালো ছিল বলে ওই সময়কালের হিসাবকে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরে। উল্লেখিত ১২ বছরে ফেব্রæয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানি প্রবাহ ছিল ৫ হাজার ৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। ২০১৫ সালে নদীর নাব্যতা ছিল ৩৪০ কিউসেকের একটু ওপরে। ২০১৬ সালেও পানির নাব্যতা ছিল একই রকম।
এ ব্যাপারে পাউবো’র ভাষ্য হচ্ছেÑ সেচ প্রকল্পের পানিসহ তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ন্যূনতম ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। গজলডোবা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ এই পরিমাণ পানি পায় না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তায় ‘রিভার ফ্লো ইজ জিরো।’ আর ‘গেট ফ্লো ইজ সামথিং।’ এভাবে তিস্তা প্রকল্প টিকবে না। তিনি বলেন, উজানে গজলডোবা ব্যারেজ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় প্রতি বছর এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়। চলতি শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর অবস্থা আরও শোচনীয়।
উল্লেখ্য, তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সাথে ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ওই চুক্তির খসড়ায় তিস্তার নাব্যতা রক্ষায় ২০ ভাগ পানি রেখে বাকি ৮০ ভাগ পানি ভাগাভাগির কথা বলা হয়। এতে ভারতের হিস্যা ধরা হয় ৪৩ ভাগ আর বাংলাদেশকে দেয়ার প্রস্তাব করা হয় ৩৭ ভাগ।
এই প্রস্তাব নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক‚টকৌশলের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ