Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস জানতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

| প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধে জাদুঘরের নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন
বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশপ্রেমিক ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস জানতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই তাদের ইতিহাস জানতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেন জানতে পারে কত মহান ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো তারা দেখবে। সেই স্মৃতিগুলো তারা উপলব্ধি করবে, অন্তরে ধারণ করবে এবং সেভাবেই নিজেদের চরিত্রকে গঠন করবে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। তিনি গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নবনির্মিত বহুতল ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর এমন একটা সময় এসেছিল, যখন যারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান- এটা বলতে ভয় পেত। এটুকু বলতে আতঙ্কগ্রস্ত হতো, দ্বিধাগ্রস্ত হতো। আর যারা সম্পূর্ণ দালালিটা করতে পেরেছে, তাদের কথা আলাদা। আমি অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি যে, ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপে মুক্তিযোদ্ধারা গর্ব করে বলতে পারেন আমি মুক্তিযোদ্ধা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সময় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান নিষিদ্ধ ছিল এবং ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে গিয়ে বহু নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে, তাদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের ছুরি মারা হয়েছে। সমাজে তারা নানাভাবে অত্যাচারিত-নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি জাতির পিতার ছবি প্রচার হতো না টেলিভিশনে। জাতির পিতার ছবি থাকলে সেই ছবিকে কৌশলে ঢেকে প্রচার করা হতো, এমনকি আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখতেও দেখা গেছে। তিনি বলেন, সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না। সত্যের শক্তি অনেক বেশি। আজকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ফিরে এসেছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীরা। পরে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোনের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী জাদুঘর চত্বরে শিখা অ¤øান প্রজ্বলন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফলক উন্মোচনের পর পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্বোধনে এসেছি। আমরা দু’টি বোন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি  পেয়েছিলাম। কিন্তু অন্য কোনো সম্পত্তি না থাকলেও আমরা  কোনোদিন ভাবিনি যে বাড়িটি আমরা ব্যবহার করব। কারণ এই বাড়ি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দিয়েছেন। এই বাড়ি থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশনা যেত। এই বাড়ি থেকেই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশবাসীর নিকট ঘোষণা প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন টেলিগ্রাম এবং  টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সেই ঘোষণা আগেই বিভিন্ন জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেন যে, দেশ আক্রান্ত হলেই যেন এই ঘোষণা প্রচার করা হয়। তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ছোট বাড়িটিতেই ছিলেন। আর এই বাড়িতেই তিনি জীবন দিয়ে গেছেন। সেই বাড়ি আমরা ব্যবহার করব আমাদের সে ধরনের আকাক্সক্ষা বা লোভ  কোনোটাই ছিল না।
তিনি বলেন, এই বাড়িকে ঘিরে সবসময় আমাদের একটা চিন্তা ছিল যে, এমন একটা কিছু করব যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে আর কোনো নেতার ছেলে-মেয়ে তাদের সম্পত্তি কিন্তু দেয়নি। সবাই ভোগদখল করেছে। কেউ সেখানে মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং করেছে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে লাগিয়েছে। একমাত্র আমরা দুই বোন, আমাদের আর কোনো জায়গা ছিল না। থাকার মতো জায়গাও ছিল না, তারপরও বাড়িটি জাদুঘরের জন্য দিয়ে দিয়েছি।
বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর ১৯৭৫- এর ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত তার প্রায় প্রতিটি কাজের সমালোচনা করা হয়েছে মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা বলেন, সদ্য স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে যে সময় তাকে দেয়া প্রয়োজন ছিল তা দেয়া হয়নি। সেই ’৭২ সালে ফিরে আসার পর থেকে তাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও লেখালেখি করা হয়। আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই লেখালেখি, সমালোচনার মধ্য দিয়ে ১৫ অগাস্ট পঁচাত্তরের ঘটনা ঘটাবার, যেন একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরই বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধীদের পদচারণা শুরু হয়। আর স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় আসার সোপান তৈরি করে দিয়েছিল যারা তখন তীব্র সমালোচনা আর লেখালেখি করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী শাহ আজিজুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলিমকে বানিয়েছিলেন মন্ত্রী। সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে বিচার বন্ধ এবং কারাগারে বন্দী যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল জিয়ার সময়ে। সেই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনরায় চালুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জিয়া। পঁচাত্তরের ঘটনার আগে যারা বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেছিলেন, তাদের বোধশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের বোধশক্তির এই অভাবটা আমার কাছে মনে হয় সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার। আজকে যারা বেঁচে আছেন, তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেন, কত ভুল চিন্তা তাদের ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ  কেবল একটি পরিবারের ওপর আঘাত বলে ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু দিনের পর দিন যখন গেছে, তখন অনেকেই উপলব্ধি করেছেন, এটা কোনো পরিবারের ওপর আঘাত ছিল না, ক্ষমতা দখলের জন্য ছিল না। এটা ছিল একটা চেতনাকে ধ্বংস করা, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে নস্যাৎ করা। আরও বেশি করে সকলের কাছে প্রমাণিত হলো; যখন ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তখনকার প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ চার সহযোগীকে  গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর ধূম্রজালের মধ্যে ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইনশাল্লাহ এই দেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এদেশের চেতনাকে সমুন্নত রাখবে। কাজেই এই স্মৃতিগুলো ধরে রাখা জাতীয় প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। সেজন্য আমি আবারো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, আমি শুধু এইটুকুই বলব আমাদের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। লাখো শহীদের এই রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যায় না।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আপনারা অনেকেই বিদেশে যান এবং দেখেছেন আগে বাংলাদেশ শুনলেই যেখানে বলত ঝড়, দুর্যোগের, ভিক্ষা চাওয়া জাতি, কিন্তু আজকে আর সেকথা তারা বলে না। তিনি বলেন, আজকে বিদেশিরাই বলে বাংলাদেশ একটা উন্নয়নের রোল মডেল। এটা তো এমনি এমনি হয়নি। সুপরিকল্পিতভাবে নেয়া আমাদের পদক্ষেপসমূহের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। আর জাতির পিতার নেতৃত্বে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ করে  দেশকে স্বাধীন করেছি তাই আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নতি হয়।
আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের বিপরীতে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর ৯তলা এই জাদুঘর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০২ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের নানা দলিলপত্র, বার্তা, চিঠি মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার নিদর্শন রাখা হয়েছে। নয়তলা ভবনের ৫ হাজার বর্গফুটের প্রদর্শনী গ্যালারিগুলো শুরু হয়েছে ৪র্থ তলা থেকে। ‘আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সংগ্রাম’ শীর্ষক এই গ্যালারিতে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনসহ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বের নানা নিদর্শন স্থান  পেয়েছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে আগুনঝরা মার্চের ঘটনাবলি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। ‘আমাদের যুদ্ধ এবং আমাদের মিত্র’ শীর্ষক তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা, রাজকারদের তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের ভূমিকা।



 

Show all comments
  • তুহিন ১৭ এপ্রিল, ২০১৭, ৪:১৮ এএম says : 0
    নতুন প্রজন্ম কি আদৌ প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছে ?
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ১৭ এপ্রিল, ২০১৭, ৬:৩৮ পিএম says : 0
    .............. আল্লাহ্ আমাদের কে সত্য জানার সত্য বলার এবং সত্যকে সর্বস্তরে ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করুন। আমীন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ