পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখলে অথবা আবহাওয়ার গুমোট ভাব ও সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হলেই চাক্তাই খাতুনগঞ্জজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এই আতঙ্ক হচ্ছে পানিবদ্ধতার। প্রতি বছর এখানে হঠাৎ করে কয়েক দফায় সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতা।
আর এতে কোটি কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়। গতকালও (শনিবার) বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের কারণে সতর্ক সঙ্কেত দেখানো হয়েছে। এর জন্য সাধারণ ব্যবসায়ীরা ফের বর্ষণ ও জোয়ারে পানিবদ্ধতার ভয়ে দিন গুজরান করছেন। তাছাড়া সামনেই ভরা জোয়ার ও বর্ষার মওসুম। তখন পরিস্থিতি কী হয় এ নিয়ে ব্যবসায়ী মহল ছাড়াও এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। দেশের প্রধান নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের ‘সওদাগরীপাড়া’ খ্যাত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ বিপুল অংকের রাজস্ব যোগানদার। বছর বছর এই পানিবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী নিরসন চেয়ে ব্যবসায়ী নেতারা ইতোমধ্যে কয়েকবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আশার বাণীও শোনানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সমাধানের আলামত নেই।
প্রতি বছর প্রাক-বর্ষা, ভরা বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর হঠাৎ ভারী বর্ষণের সাথে সামুদ্রিক প্রবল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের ‘সওদাগরীপাড়া’ চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। এ সময় ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত চাক্তাই খালের দুই ক‚ল উপচে গিয়ে নগরীর এই সুবিশাল এলাকা দফায় দফায় প্লাবিত হয়। তখন হঠাৎ করে সৃষ্টি হয় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জজুড়ে পানিবদ্ধতা। তলিয়ে যায় নিত্য পণ্যভর্তি শত শত দোকানপাট, গুদাম ও আড়ত। আর এ সময় ব্যবসায়ীরা তড়িঘড়ি করে কিছু কিছু মালামাল সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু অনেকাংশই জোয়ার, কাদা-পানিতে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। যার আর্থিক পরিমাণ কোটি কোটি টাকা।
শুধু চাক্তাই-খাতুনগঞ্জই নয়; কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, রাজাখালীসহ নগরীর বিস্তীর্ণ প্রধান ব্যবসায়িক এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকে। চাক্তাই খালের গভীরতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলীর মোহনায় নির্বিচারে দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে চাক্তাই খালের মুখ উঁচু ও ভরাট হয়ে গেছে। এতে করে অল্পক্ষণ ধরে ভারী বর্ষণের সাথে সাথেই কর্ণফুলী নদীর জোয়ার যুক্ত হয়ে চাক্তাই খালের উভয় পাড় ছাপিয়ে সমগ্র ‘সওদাগরীপাড়া’ প্লাবিত হয়। বিগত পরপর দু’বছরে এখানকার পানিবদ্ধতায় নিত্য ও ভোগ্যপণ্যসহ অন্তত একশ’ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানান ব্যবসায়ীরা। তদুপরি পানিবদ্ধতায় এ অঞ্চলের সবক’টি সড়ক, রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি ৩-৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়, যা বছর বছর রীতিমতো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের রূপ নিয়েছে। গত ২০১৫ সালে বর্ষা মওসুমের শেষ দিকে প্রবল বর্ষণ ও সামুদ্রিক জোয়ার একত্রিত হয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে টানা কয়েক দিনের পানিবদ্ধতায় পাঁচ শতাধিক দোকান, গুদাম ও আড়তে শত কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী বিনষ্ট হয়, যা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের পর সেখানে সবচেয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা। এরপর থেকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে পানিবদ্ধতা সঙ্কট উত্তরণের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে।
দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায় কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ‘সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া’ খ্যাত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে দৈনিক গড়ে ১২শ’ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী হাতবদল এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। হরেক রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি, ইন্ডেন্টিং বাজার হচ্ছে শতবর্ষের প্রাচীন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। এটি প্রাচীনকাল থেকেই দেশের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ব্যবসায়িক এলাকা। বর্ষা ও দুর্যোগের মওসুমে মারাত্মক পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসন ব্যবসায়ী মহলের দীর্ঘদিনের প্রধান দাবি। অনুন্নত রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমা সংস্কার, ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ড্রেজিং ও সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। পরিকল্পিতভাবে সওদাগরীপাড়াকে ঢেলে সাজানোরও দাবি উঠেছে।
চট্টগ্রামকে অতিক্রম করে রাজধানী ঢাকার অনেক শীর্ষস্থানীয় বণিক-শিল্পপতি ও প্রধান প্রধান ব্যবসায়ী গ্রæপের কর্ণধারদের মূল ব্যবসা-বাণিজ্যিক অফিস অথবা একেকটি করে লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ কিংবা আছদগঞ্জে। শুধুই শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের ৬ দিনে গড়ে প্রতিদিন এখানে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রায় অর্ধশত শাখা রয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের একাধিক শাখাও রয়েছে। ১২ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে প্রায় ১০-১২ হাজার ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও আশপাশজুড়ে। এখান থেকেই ব্যবসা শুরু করে আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে দেশের অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় আমদানি-রফতানিকারক, বণিক ও শিল্প গ্রæপ। সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্য ও গুরুত্বকে অটুট রাখতে হলে এর জন্য এ অঞ্চলকে দেশের ‘বাণিজ্যিক জোন’ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলাই অপরিহার্য। এই সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব যোগান দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যকে ঘিরে কর্ণফুলী নদী ও এর সংলগ্ন চাক্তাই খালের কিনারাজুড়ে ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য স¤প্রসারিত হয়ে গড়ে উঠেছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাব-জজ হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় স্ত্রী মোছাম্মৎ খাতুন বিবির নামানুসারে এখানকার সওদাগরী ব্যবসায়িকপাড়া খাতুনগঞ্জ গড়ে ওঠে। তবে পুরনো সওদাগরীপাড়া চাক্তাই গড়ে ওঠে আরো আগে। সম্রাট বাবরের শাসনামলে পাল তোলা জাহাজ নিয়ে আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়ার সওদাগররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপদ পোতাশ্রয় দিয়ে আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এ সময় তুর্কি বণিকরা চট্টগ্রামের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হন। তাদের অন্যতম ছিলেন প্রাচীন তুরস্কের অতি চৌকস, বনেদি ও ‘জাত’ ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত ‘চুগতাই’ সওদাগররা। তাদেরই নাম ও খ্যাতির স্বর্ণযুগের সাথে জড়িয়ে চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়-বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ‘চাক্তাই’ হিসেবে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।