Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নববর্ষ উৎসব দেশে দেশে

| প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল : নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রাচীন পারস্য, বর্তমান ইরানে দু’সপ্তাহ ব্যাপী নওরোজ  উৎসব পালিত হয়ে আসছে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বা ব্যাবিলনে নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকে। রোমানরা অনেক আগে থেকেই বসন্তকালে নববর্ষ উৎসব পালন করে আসছে। ব্যাবিলনীয়দের দেখাদেখি ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব “বুশ হুশনা” পালন করে আসছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা ১ জানুয়ারি Happy New Year ডে পালন করছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে পালন করে আসছে।
অন্যদিকে বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ “পহেলা বৈশাখ” পালন করছে মাত্র কয়েকশ বছর ধরে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয় নববর্ষ উৎসব। ইয়েমেনে নববর্ষ পালিত হয় ৬ এপ্রিল। নেপালে ১৪ এপ্রিল। মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে ১৩ এপ্রিল। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীনে নববর্ষ পালিত হয় ফেব্রুয়ারিতে। তিব্বতিদের নববর্ষ ‘লোসার’ পালিত হয় ১৮ জানয়ারি। পাকিস্তান ও মালদ্বীপে নববর্ষ পালিত হয় ১৭ এপ্রিল। তুরস্ক ও কুয়েতসহ মুসলমান প্রধান কয়েকটি দেশে নববর্ষ পালিত হয় গ্রেগারিন বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে অর্থাৎ জানুয়ারিতে।
পশ্চিমা দেশগুলো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করেন নববর্ষ উৎসব। সেই কারণে আগের দিন রাতে “থার্টি ফার্স্ট নাইট” পার্টির ব্যবস্থা করে। মানুষ জমায়েত হয় শহরে বড় ঘড়ির সামনে। এই দেশগুলো ঘণ্টা ধ্বনির মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। প্রায় সবশ্রেণীর ও বয়সের মানুষ নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। আতশবাজির ঝলমলে আলোয় রাতের আকাশ ছেয়ে যায়। রাতভর চলে নাচ ও গান। অনেকেই হয়তো আমরা জানি না ভিন্ন দেশের মানুষ কীভাবে তাদের নববর্ষ পালন করে।  বিভিন্ন দেশের নববর্ষ পালনের কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো-
চীন : চীনের নববর্ষ উৎসব চলে ১ মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিতে চীনের চান্দ্র নববর্ষ। এই উৎসবকে বলা হয় “চুন জি” ইংরেজিতে স্পিং ফোস্টভ্যাল বা স্পিং ফেস্ট। চীনের মহাপ্রাচীরের একটি অংশে এই দিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পর্যটকদের জন্য থাকে বিশেষ প্যাকেজ। লাল পোশাক, লাল সন্ধ্যা বাতিতে নতুন সাজে সেজে ওঠে চীনের জনজীবন “ওসেইল” নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এই দিনে। ১ মাসব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় “শস্য দিবস” নামে।
ফিলিপাইন : ফিলিপাইনের বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাই তারা সবাই জানুয়ারির ১ তারিখেই নববর্ষ উৎসব পালন করে থাকে। ফিলিপাইনরা তাদের নববর্ষকে গধহরমড়হম নধমড়হম ঃধড়হি বলে অর্থাৎ নতুন বছরে জীবন সফল হোক, আমরা সবাই যেন সুখী হই।
স্কটল্যান্ড : বৃটিশরা সবাই জানুয়ারির ১ তারিখে নিউ ইয়ার পালন করে। এর ব্যতিক্রম নয় স্কটিশরাও। বিভিন্ন হোটেল, ক্লাব, পার্টিতে তারা কেক কেটে, পানীয় পান করে এবং একে অন্যকে উপহার সামগ্রী দিয়ে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করে। স্কটিশরা অনেক জাঁকজমকভাবে নববর্ষের আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে।
আর্জেন্টিনা : আর্জেন্টিনায় নববর্ষের আগের দিন রাত্রিতে পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া ও আনন্দ উৎসব করে। নববর্ষের দিন তারা নদী বা লেকের পানিতে সাঁতার কেটে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে।
স্পেন : স্পেনে রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ১২টা করে আঙ্গুর খেয়ে, হ্যাপি নিউ ইয়ারকে স্বাগত জানায়। তারা মনে করে এই আঙ্গুর তাদের জীবনের সৌভাগ্যের প্রতীক। নববর্ষের সন্ধ্যা স্পেনে পচিরিত Visperade Ario nuevo  হিসেবে।
জাপান : জাপানিরা ইংরেজি অনুসারে ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করে থাকে। খারাপ আত্মাকে দূরে রাখার জন্য এ সময় বাড়ির বাইরে দড়ি দিয়ে খড়ের টুকরো ঝুলিয়ে রাখে জাপানিরা। এটাকে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করে। প্রার্থনা, ঘণ্টা বাজানো ও বিশেষ খাওয়া দাওয়ার মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করে জাপানিরা। আগে চীন এবং জাপানে একই দিনে নববর্ষ পালন করা হতো। এখন জাপানিরা ইংরেজি নববর্ষ বা গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করে ১ জানুয়ারি।
অস্ট্রেলিয়া : অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালিত হয় নববর্ষ উৎসব। নববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ২০ লাখ লোক উপভোগ করে এই অনুষ্ঠান। এরপর সিডনি শহরে অপেরা হাউজে স্থানীয় সময় ১২টা ১ মিনিটে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান ও আতশবাজির মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা।
কোরিয়া : কোরিয়া নববর্ষ শুরুর সময় এদেশের অধিবাসীরা কেউ ঘুমায় না। তাদের বিশ্বাস এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রæ সাদা হয়ে যায়। কোরিয়াতে প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে বর্ণাঢ্য ও জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নববর্ষের দিনটিকে পালন করে থাকে। ১ জানুয়ারি নববর্ষে কোরিয়া পরিচিত হয় ‘সিওনাল’ নামে।
নিউজিল্যান্ড : খ্রিস্টান নববর্ষ প্রথম উদযাপন শুরু হয় নিউজিল্যান্ড অকল্যান্ড দ্বীপে। এই দিনে আনন্দ, ভ‚রিভোজ ও আতশবাজি উৎসবের মধ্য দিয়ে দিনটিকে পালন করে নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা।
মেক্সিকো : মেক্সিকো শহরে রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। এই সময় প্রতি ঘণ্টায় ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে একটি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়। মেক্সিকোবাসীরা বিশ্বাস করে এই সময় যা কামনা করা হয় তাই পূরণ হয়।
ফ্রান্স : নববর্ষের দিনটিকে ফ্রান্সে “জউর দে এটরেন্স” বলে ডাকা হয়। এখানে নববর্ষ উৎসব শুরু হয় ১ জানুয়ারি থেকে। এখানে নববর্ষ উদযাপন চলে সপ্তাহব্যাপী। পরস্পর পরস্পরকে বন্নে আনেস বলে অভিবাদন করে। এই সময় ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের পাশে বর্ণাঢ্য আতশবাতি উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হয়। ফরাসিরা থার্টিফার্স্ট নাইটকে ‘লা সেইন্ট সিলভেস্ট্রে’ বলে ডাকে। এদিন প্রতিটি গৃহে একটি বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয় যার নাম ‘লে রেভেলিন ডি সেইন্ট সিল ভেস্ট্রে’। এছাড়াও এদিনের উৎসবে ফরাসিরা ‘প্যালে ডে রইস’ নামক এক ধরনের কেক তৈরি করে। প্যারিসের প্রধান প্রধান শহরগুলো রাতভর জেগে ঘটা করে নববর্ষ উৎসব পালন করে। নাচ-গান-বাজনায় মেতে ওঠে ঝলমলে শহরগুলোর দোকানপাট ও ক্লাব, রেস্তোরাঁসমূহ।
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রের নববর্ষ উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হয় টাইমস স্কোয়ারে। এখানে নতুন বছর শুরু হওয়ার ১০ সেকেন্ড আগে এক বিশালাকার ক্রিস্টাল বল নেমে নতুন বর্ষের আগমনের কাউন্ট ডাডন শুরু হয়। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউ ইয়ার পার্টি যেখানে প্রায় ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে রাতভর জেগে ঘটা করে নববর্ষ উৎসব পালন করা হয়। নববর্ষে এখানকার প্রত্যেক মলসমূহ এবং রেস্তোরাঁসমূহ নাচ-গান-বাজনায় এই দিনে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
যুক্তরাজ্য : লন্ডনে নববর্ষের আগ মুহূর্তে ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং পিকাডেলি সাকার্সে বিশাল পরিসরে মানুষ সমবেত হয়। মধ্যরাতে বিগবেনের ধ্বনি শুনে এরা একত্রে নববর্ষকে বরণ করে নেয়। লন্ডনে বিগ বেন এবং ওয়েস্ট মিনস্টার প্রাসাদের ঘড়ি ঘরের সামনে ঘটা করে উৎসব করে জনতা। এই অনুষ্ঠান বিবিসিসহ বিভিন্ন মিডিয়া সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। লন্ডনে রাতভর জেগে নর-নারীরা ঘটা করে নববর্ষ উৎসব পালন করে। আতশবাজি ও নাচে-গানে উল্লসিত হয়ে ওঠে শহরগুলোর দোকানপাট ও রেস্তোরাঁসমূহ।
ব্রাজিল : ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সমুদ্র সৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি হয়। এর প্রধান আকর্ষণ জমকালো চোখ ধাঁধানো পোশাক পরিধান করা। সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুড়ে দিলে বছরটি খুব ভালো যাবে বলে তাদের ধারণা।
থাইল্যান্ড : থাইল্যান্ডে নববর্ষের নাম ‘সংক্রান’। থাইল্যান্ডে এপ্রিলের ১৩ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত বৌদ্ধ নববর্ষ উৎসব হিসেবে এটি উদযাপিত হয়। তারা রাস্তায় পানির পিচকারি বা বালতিতে বরফ নিয়ে সেই পানি দিয়ে সব কিছু ভিজিয়ে দেয়।
ভিয়েতনাম : ভিয়েতনামের হোচি মিন সিটিতে নববর্ষ উদযাপিত হয় ৩১ ডিসেম্বর। তাদের অনুষ্ঠানে রাস্তাঘাটকে পুষ্প ও আলোক সজ্জিত করা হয়। ভিয়েতনামের নববর্ষকে সংক্ষেপে ‘টেট’ নামে অভিহিত করা হয়। ভিয়েতনামিদের বিশ্বাস, ঈশ্বর ঘরে ঘরে বাস করেন। নববর্ষে বেড়াতে যান স্বর্গে। বলা হয়, কার্প মাছের পিঠে চড়ে ঈশ্বর ভ্রমণে বের হন। এই বিশ্বাসে ভিয়েতনামের লোকেরা অনেকে এই দিনে নদী বা পুকুরে কার্প মাছ ছাড়েন।
ইরান : নওরোজ ইরানিয়ান ক্যালেন্ডারের নববর্ষ এবং একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ইরানে প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষে নওরোজ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই দিনে কৃষকেরা ক্ষেতে শস্যের বীজ বপন করেন। ঘরদোর সাজান নতুন পোশাক-পরিচ্ছেদ পরিধান করেন। ইরানিরা “হাফত-সিন” নামক এই দিনে বিশেষ খাবারের আয়োজন করে যা সাত রকমের উপকরণে তৈরি করা হয়। নওরোজ অর্থ নতুন দিন বা নতুন আলো। এই নওরোজ উৎসবটি ইরানিরা মহাসমারোহে পালন করে।
মিসর : প্রাচীন মিসরে প্রচলিত ছিল “কোপটিক” বা আলোক জান্দ্রীয় বর্ষপঞ্জি। তাতে ছিল ৩০ দিনের মাসের ১২ মাস, সঙ্গে ৫ দিনের ছোট এক মাস (সর্বমোট ৩৬৫ দিন) তৃতীয় সময় (খৃস্টপূর্ব ২৩৮) তার সংস্কার হয়। নববর্ষের দিন মিসরীয়রা পালন করতো Niyaronon  (নদীর উৎসব)। এটা থেকেই এসেছে ইরানের নববর্ষের ‘‘নওরোজ” উৎসব।
বর্তমানকালে মিসরে নববর্ষে চাঁদ দেখে নববর্ষ ঘোষণা করেন দেশের ধর্ম নেতা বা প্রধান মুফতি। বিশেষ ধরনের খাবারসহ ভোজ উৎসব এবং নতুন কাপড় পরার নিয়ম রয়েছে সেখানে। তারপর ঈদের মতো তারা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
জার্মানি : জার্মানিতে নববর্ষে মানুষ ঠান্ডা পানির মধ্যে তরল সিসার টুকরা ঠেলে দেয়। সিসার টুকরা যে রকম আকার বানায় তা দেখে এখানকার মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করে। নববর্ষের আগে খাবারের কিছু অংশ মধ্যরাতের জন্য রেখে দেয়া হয়, যাতে করে নতুন বছর ঘরে পর্যাপ্ত খাবার থাকে।
হাঙ্গের : হাঙ্গেরিতে নববর্ষের দিন “জ্যাক স্ট্র” নামক এক প্রকার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। আগের বছরে ঘটে যাওয়া সব দুর্ঘটনা এবং খারাপ কাজের প্রতীক হিসেবে “জ্যাকস্ট্র”কে গণ্য করা হয়। এই কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে দুভার্গ্যকে ছুড়ে ফেলা হয়। বছরের শেষ দিন হাঙ্গেরিবাসী হাঁস, মুরগী বা অন্য কোন ধরনের পাখির মাংস খান না। তাদের ধারণা, উড়তে পারে এমন পাখির মাংস খেলে নতুন বছরে জীবন থেকে সকল সৌভাগ্য উড়ে যাবে।
সুইডেন : সুইডেন নববর্ষে রাইস পুডিং তৈরি করা হয়। এর ভেতর একটি কাঠবাদাম লুকানো থাকে। সুইডিশরা বিশ্বাস করে, খাওয়ার সময় যে কাঠবাদামটি পাবে সে নতুন বছরে সৌভাগ্যের মুখ দেখবে।
ইতালি : ইতালিতে নববর্ষে বিশেষ ধরনের মসুর ডাল ও সসেজ খাওয়া হয়। এটিকে তারা “কোটে চিনো ই লেন টিচ্চি” বলে। ইতালিরা নববর্ষের দিনটিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করে থাকে।
অস্ট্রিয়া : অস্ট্রিয়ায় নববর্ষ উদযাপনের বিশেষ খাদ্য শূকরের রোস্ট। এটিকে তারা “সিলভেস্টেরাব্রেন্ড” বলে থাকে। অস্ট্রিয়ায় শূকরকে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। নববর্ষে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এই বিশ্বাসে অস্ট্রিয়ার লোকজন শূকরের রোস্ট খায়।
নরওয়ে ও ডেনমার্ক : নরওয়ে ও ডেনমার্কে নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে “ক্রানসেকাগে” নামক এক ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। এটি মূলত এক জাতীয় কেক। এই কেক সাজাতে ক্রিম ও অন্যান্য জিনিস ছাড়াও ছোট ছোট পতাকা ব্যবহৃত হয়।
বুলগেরিয়া : বুলগেরিয়া বর্ষবরণ রীতি বিচিত্র ধরনের। আমাদের দেশে হাঁচি নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। কিন্তু বুলগেরিয়াবাসীর কাছে বর্ষবরণের দিন হাঁচি ফেলাটা বেশ সৌভাগ্য ও মঙ্গলের প্রতীক। বাড়িতে আসা কোন অতিথি যদি হাঁচি ফেলেন তাহলে বাড়ির কর্তা তাকে নিজস্ব খামারে নিয়ে যান। এরপর হাঁচি ফেলা ব্যক্তির প্রথম নজর খামারের যে পশুটির ওপর পড়বে সেই পশুটি গৃহ কর্তা ঐ ব্যক্তিকে উপহার দিয়ে দেন। বুলগেরিয়ানদের ধারণা হাঁচি ফেলা অতিথি নববর্ষে পুরো পরিবারের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসেন।
নেদারল্যান্ডস : নেদারল্যান্ডসের নববর্ষকে মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। এই রীতিকে সে দেশের লোকজন “ওউড এন নিউ” বা “পুরনো ও নতুন” নামে অভিহিত করে। নেদারল্যান্ডসে নববর্ষে “ওলি ও বোলেন” নামক এক ধরনের মিষ্টি খাবার তৈরি করা হয় যার ভেতরে কিসমিস, আপেল ইত্যাদি ভরা থাকে। উপরে চিনির গুঁড়ো ছিটিয়ে খাবারটি তৈরি করা হয়। এটি নববর্ষে নেদারল্যান্ডসবাসীর প্রিয় খাবার ও সৌভাগ্যের প্রতীক।
নেপাল : নেপালের নববর্ষ বাঙালিদের মতোই এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১২-১৫ তারিখের মধ্যে পালন করা হয়। নেপালিরা বলে “নববর্ষ” নেপালিদের বছরের প্রথম মাস বৈশাখ। ওদের নবর্ষের গানের নাম “নয়া বর্ষা গীত”। নেপালীদের ভাষার সাথে বাংলা ভাষার অনেকটাই মিল লক্ষণীয়। তারা সকলে মিলে নববর্ষের গান গায়।
মাদাগাস্কার : আফ্রিকার মাদাগাস্কারে নতুন বছর শুরুর সাতদিন আগে থেকেই তাদের মাংস খাওয়া বন্ধ থাকে। বছরের প্রথম দিন বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হবে। প্রথমে তা খেতে দেয়া হবে বাবা-মাকে। বাবা-মাকে খেতে দেয়া হয় মুরগির লেজের দিকের অংশটা আর ভাইবোনদের দেয়া হয় মুরগির পা। এভাবেই তারা নববর্ষ পালন করে।
পাকিস্তান : পাকিস্তানিদের নিজস্ব কোন নববর্ষ নেই কারণ উর্দু ভাষায় কোন ক্যালেন্ডার নেই। যেহেতু উর্দু ভাষীরা সবাই মুসলমান তাই তারা আরবি ক্যালেন্ডারকে নিজেদের ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করে। আরবদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পাকিস্তানিরা সকল ধর্মীয় ও জাতীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
ভারত : ভারতের হিন্দী ভাষাভাষী মানুষের কাছে হিন্দী নববর্ষের গান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষাভাষীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের নববর্ষ পালন করে থাকে। হিন্দী ভাষীরা বিভিন্ন গান দিয়ে তাদের নববর্ষকে স্বাগত জানায়। ভারতীয়দের একটি সাধারণ প্রথাই হয়ে গেছে নববর্ষের অনুষ্ঠান উদযাপন করা। নববর্ষের হিন্দী গান গুলি পরিবেশিত হয় বিশেষ করে ক্লাবগুলোতে। এই দিনে তারা মিষ্টি মুখ, আনন্দ করা ছাড়াও রং ছোড়াছুড়ি করে থাকে।
আরব : আরবরা মহররমের ১ তারিখে হিজরি নববর্ষ পালন করে থাকে। তারা এই নববর্ষকে ‘‘সানা হিজরিরা জাদীদা” বলে। তাদের গানে কোন বাজনা থাকে না। ঠিক হামদ ও নাতের মতোই। আরবিরা এই দিনে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন।
বাংলাদেশ : বাঙালির অন্যতম জাতীয় উৎসব পহেলা বৈশাখ। যার ইংরেজি তারিখ গিয়ে পড়ে ১৪ এপ্রিল। গ্রামীণ গম্ভীরা, জারি, লোকগীত ছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান এখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মূল উপাদান। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপ্তি বিশাল। গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজার, ঢাকার রমনা বটমূল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকাসহ সারাদেশের গ্রাম-শহরে আবালবৃদ্ধবনিতা এই দিনে সকাল থেকে মেতে ওঠে নাচ-গান, কবিতা, নাটক, হা-ডু-ডু খেলা, গ্রাম্য মেলা, নাগরদোলা ও ঘুড়ি উড়ানো ও হালখাতা উৎসবে। নতুন সাজে, পোশাকে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই।
মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে “ছায়ানট” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে এই সংস্থা রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান সূচনা করে। বাংলাদেশে সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ওঁরাও, গারো, মো, মোরাং, হাজং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অনুসারে তাদের নিজ নিজ নববর্ষ পালন করে থাকে।
লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন