Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলা নববর্ষ আমাদের গৌরব ও অহংকার

| প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
পহেলা বৈশাখের সাথে জড়িত আছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। বৈশাখ আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের অহংকার ও গৌরবের প্রকাশ। আমাদের এ সালকে আমরা স্বাগত জানাবো না তো কে জানাবে? অনেকেই মনে করেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা উচিত নয়। কারণ এটি বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ। এর চেয়ে অধিকতর ভ্রান্ত কোনো ধারণা হতে পারে না। বাংলা নববর্ষ সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে উদযাপিত হলে তার মধ্যে ইসলামবিরোধী কোনো কিছু খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। বাংলা নববর্ষের জননী হিজরি সাল। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক হিজরতভিত্তিক হিজরি সন অবলম্বনেই এই বাংলা সন প্রণীত হয়েছে। এ সনের প্রবর্তন করেন বিশ্ববিখ্যাত মোঘল সম্রাট আকবর। তিনি এদেশে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। ইসলামী সনের উপর ভিত্তি করেই একজন মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। সুতরাং এ দিবস উদযাপনে অন্য ধর্মীয় কোনো উপাদান যোগ হওয়ার বিষয় নেই।
সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরিতে অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। আকবর তখন দিল্লি থেকে বহু দূরে পাঞ্জাবে ছিলেন। একই বছর ৫ নভেম্বর ঐতিহাসিক পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ আদিলের প্রধান সেনাপতি হিমুর নিয়ন্ত্রণাধীন বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে সম্রাট আকবর দিল্লি দখল করেন। এই ঐতিহাসিক রাজ্যাভিষেকের ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সম্রাটের আদেশে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি বহু ভাবনা-চিন্তার পর সৌর সন এবং হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। হিজরি সনের প্রথম দিন হলো পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়। ৯৬৩ হিজরি অবলম্বন করেই তারিখ-এ-ইলাহি তথা ‘বাংলা সন’ চালু করা হয়। তখন হিজরি সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে, জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বছর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশে বর্ষপঞ্জি ও দিনপঞ্জি গণনার ক্ষেত্রে সন, সাল, তারিখ শব্দ ৩টি নিত্যব্যবহৃত হয়। ‘সন’ ও ‘তারিখ’ দু’টিই আরবি শব্দ। প্রথমটির অর্থ ‘বর্ষ’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’ এবং অন্যটির অর্থ ‘দিন’। ‘তারিখ’ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়। ‘সাল’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ ‘বছর’। যারা ইতিহাসকে স্বীকার করেন না বা যারা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই মনের করেন যে, বাংলা সন অমুসলিমদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি বর্ষপঞ্জি।
যে হিজরি সাল থেকে বাংলা সালের উৎপত্তি তার সাথে পৌরাণিক যুগের রাম, দুর্গা, গণেশ বা তাদের কথিত বাহন হনুমান, সিংহ ও ল²ীপেঁচার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? পহেলা বৈশাখের দিন ধুতি পরে রাস্তায় বের হওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রা করা, কপালে তিলক দেয়া, বাঘ, ভাল্লুক, পেঁচা, ময়ূর, টিয়া, কুমীরের প্রতিকৃতি বহন করা, দেব-দেবীর মুখোশ পরা, মূর্তি-প্রতিমা নিয়ে আনন্দ করা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সংস্কৃতি নয়। আজ আমরা আশ্চর্য্য, বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় যে, হিন্দুদের চেতনা, কৃষ্টি-কালচারে দখল হয়ে গেছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত, স্মৃতিবিজড়িত বাংলা নববর্ষ উদযাপন। বছরের প্রথম দিনে ফুর্তি করায় দোষের কিছু নেই। দোষ তখনই ঘটে যখন দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে চলে কনসার্টের নামে তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা উন্মাদনা, নগ্নতা, বেহায়াপনা। রাখী-বন্ধন, শাখা-সিঁদুর, চন্দন তিলক, তরুণ-তরুণীদের খোল করতাল আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শোরগোল এগুলো কোন সংস্কৃতি? বর্ষবরণের জন্য নির্মল নিষ্কলুষ কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা যাবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশীয় ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো পরিহার করে মুসলমানদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের লালন ও বিকাশ সাধনে কাজ করতে হবে।
আমাদের দেশে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালিত হতো এখন কি সেভাবে উদযাপিত হচ্ছে? তখন পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন বাজারে বা খোলা ময়দানে মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল গৃহিণীদের হাতের তৈরি দৃষ্টিনন্দন সামগ্রী, ছোটদের খেলনা, মাটির তৈরি বিভিন্ন উপকরণ ইত্যাদি। হিন্দু-মুসলিম সবাই এটিকে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে পালন করত। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যেমন- ঘোড় দৌড়, সাপের খেলা, বানর খেলা, যাদুর প্রদর্শণী, নাগর দোলা, দুঃস্বাহসীক শারিরীক কসরত, হা-ডু-ডু, বাইস্কোপ ইত্যাদি যা ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ সকলে মিলে উপভোগ করতো। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখকে নিছক বাংলা নববর্ষের উৎসব হিসেবেই উদযাপন করত। দোকানদাররা পহেলা বৈশাখের দিনে সকলকে হাসিমুখে বরণ করত। তাদের পেছনের সব বকেয়া উসুল ও হাতে নগদ টাকা আসত। মুসলিম ব্যবসায়ীরা দোকানে আগরবাতি জ্বালিয়ে সুগন্ধি ছিটিয়ে বন্ধু, সহব্যবসায়ী, আলেম উলামা দিয়ে দু’আ ও মিষ্টিমুখ করাতেন। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ শুরুর একটা আনুষ্ঠানিকতা ঘোষিত হতো মুসলিম-হিন্দু যার যার রীতিতে। ব্যবসায়ী-খরিদ্দারের মধ্যে এমন মধুর সেতুবন্ধন যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।
সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত বরেণ্য চিন্তাবিদ ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও বাধ্য হয়ে ইতোপূর্বে লিখেছেন, ‘আমি আমার নিজের শৈশব ও কৈশোরের পহেলা বৈশাখকে যেভাবে দেখছি, আজকের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে সেই নববর্ষ উৎসবের কোন মিলই নেই। তখনকার নববর্ষের উৎসবের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম প্রাণের আমেজ, তাতে ন্যূনতম কৃত্রিমতা ছিল না, আয়োজনে বিন্দুমাত্র মেকি বা লোক দেখানো বিষয় ছিল না। যা করা হতো, তা হতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রাণের আনন্দে ও অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদী আবেগে। কারণ এ সমাজের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ খুবই দরিদ্র। তারা ক্ষুধার জ্বালায় পান্তা ভাত, পচাডাল ও অখাদ্য জাতীয় জিনিস যা পায় প্রতিদিন তাই খায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পান্তা ভাত আর ইলিশের তরকারি, মুড়িঘণ্টা যারা খায়, তারা বস্তুত এক ধরনের সংস্কৃতিক অপরাধ করে। এসব আচরণের মাধ্যমে তারা আসলে দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষকে পরিহাস করে’।
কৃষিনির্ভর বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সৌর বৎসর অবলম্বনে এই নতুন সন গণনা শুরু হয়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ‘ফসলী সন’ পরবর্তী পর্যায়ে ‘বাংলা সন’ নামে চিহ্নিত হয়। বাংলা নববর্ষ ফসলী সাল হিসেবে শুরু ও কৃষির সংস্কৃতির সাথে চমৎকার চর্চা সদৃশ্য রয়েছে। এই দিনে পান্তা ভাত খাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষেই কৃষি সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতির মধ্যে গ্রামের কৃষক তথা গ্রাম্যসাংস্কৃতির সাথে আন্তরিক সম্পর্কের সূত্র গ্রথিত বলেই আমরা মনে করি। গ্রামের চাষারা সকালে বাড়িতে বসে অথবা কাজের ফাঁকে ঘর্মাক্ত দেহে গাছের ছায়ায় মাটির শানকিতে যে পান্তা খায় তা প্রকৃতই উপভোগ্য। পান্তা ভাতের সাথে নববর্ষকে মিলনকরণের মধ্যদিয়ে মূলত কৃষক, কৃষি ও ফসলের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে বিধায় একে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বলে বিবেচনা করা কোন দোষের নেই। যদিও রমনা বটমূলের পান্তা ভাতের সংস্কৃতির ইতিহাস গ্রাম্যসাংস্কৃতির সাথে মোটেই মানানসই নয়। সমস্যা হয়েছে শহরের মানুষ আজ বিষয়টিকে উল্টো হিসেবে গ্রহণ করেছে তা নিয়ে। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট বিরাট অট্টালিকার নিকটে খাদ্য-বস্ত্রহীন, দুঃখী মানুষেরা ছিন্ন কাঁথা বিছিয়ে অনাহারে রাত পাড় করছে। সেখানে গরম ভাতে পানি দিয়ে হাজার হাজার টাকা অপব্যয় করে বছরে একটি দিন মাটির শানকিতে হাপুস-হুপুস ফ্যাশনের পান্তা-ইলিশ ভোজন কতবড় অমানবিক, অমানুষিক, অনৈতিক উৎসব যা নিঃসন্দেহে গরিবদের সাথে উপহাস করার নামান্তর।
মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন থাকে যা একজন মুসলিম কখনোই করতে পারে না। যেমন- ল²ীর বাহন পেঁচা, সরস্বতীর- রাজহাঁস, গণেশের- ইঁদুর, দুর্গার- সিংহ, মনসার- সাপ, কার্ত্তিকের- ময়ূর, মহাদেবের- ষাড়, যমরাজের- কুকুর, ইন্দ্রের- হাতি, ব্র²ার- পাতিহাঁস, বিশ্বকর্মার- ঢেকি, শীতলার বাহন গাধা ইত্যাদি। নববর্ষের প্রকৃত সংস্কৃতি উপেক্ষিত হয়ে বাবু সংস্কৃতির নামে যা চালু হয়েছে তাকে কোন বিবেচনাতেই আমাদের সংস্কৃতি বলা যাবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পহেলা বৈশাখে হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা ও উপলক্ষ বিদ্যমান। কিন্তু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কর্মকে এখন সর্বজনীন উৎসবের নামে পহেলা বৈশাখের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ মুসলমানদের ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর, মিলাদুন্নবিকে সর্বজনীন বলা হয় না। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে এই বার্তাই দেয়া হচ্ছে যে, সর্বজনীন উৎসব মানেই ওইসব আচার-আনুষ্ঠানিকতা, সর্ব সম্প্রদায়ের ধর্ম-কর্মের বিষয়, যা না করলেই নয়। আর এভাবেই একটি ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আচার-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। উৎসবের নাম করে পৌত্তলিক চেতনা ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও ঢুকছে। যেমন- হাতে, পিঠে, পেটে, কপালে ও গালে উল্কি আঁকা। ইসলামে উৎসবের নাম করে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা অবৈধ, তেমনি যুবক-যুবতীর গায়ে উল্কি আঁকাও অবৈধ।
আমাদের মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি তাই মুসলমানদের চেতনাকেন্দ্রিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মধ্য থেকে গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। থাকবে অন্য ধর্ম-বর্ণ ও গোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা। বিশুদ্ধ পানিতে দূষিত পানি মেশালে দূষিত পানি বিশুদ্ধ হয় না বরং বিশুদ্ধ পানির বিশুদ্ধতারই পরিসমাপ্তি ঘটে। একজন মুসলমান নামাজ বা ইবাদতের ক্ষেত্রে হবেন শিরকমুক্ত, নিভের্জাল, তাওহীদবাদী। একদিকে কোরআনখানি, মিলাদ, মুনাজাত অপরদিকে সামাজিক সংস্কৃতিতে হিন্দুয়ানী আচার-আচরণ। পহেলা বৈশাখ পালনে হয়ে যাবেন নির্ভজাল পৌত্তলিক যা এক অদ্ভূত তামাশা! এটা সকলেরই প্রত্যাশা, আগত বর্ষটি বিগত বর্ষের চেয়ে সুন্দর ও সফল হোক। হিজরি সনের পবিত্রতায় সুরভিত ও সুশোভিত বাংলা নববর্ষ আমরা পালন করবো অবশ্যই নিজ সত্তার চেতনা মাথায় রেখে। আমরা যেন অপসংস্কৃতির খপ্পরে পড়ে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতি-আদলকে বিকৃত না করি, আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ ইত্যাদিকে বিনষ্ট না করি।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন