Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতির ধাক্কায় :জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রমে বিপর্যয়

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:২০ এএম

নিয়ন্ত্রণে কলরেট কমানোর সিদ্ধান্ত বিপিআরসির : কার্যকর উদ্যোগের অভাব মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা : মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইর
নাছিম উল আলম : ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে দেশে জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকার মধ্যেই বাংলা নববর্ষ পালনে বাঙালি সংস্কৃতির নামে ‘পান্তা ইলিশ’ এর ব্যাপক ডামাডোলে এবারো লক্ষ লক্ষ ইলিশ পোনা নিধণ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে দক্ষিণাঞ্চলের পাইকারি মোকামসহ খুচরা বাজারে ইলিশের দাম যথেষ্ট চড়া।
আর এ সুযোগেই জাটকার বিক্রি বৃদ্ধির রেশ ধরে আহরণও বাড়ছে। গত সপ্তাহখানেক ধরে দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে ও গোপনে ইলিশ পোন-জাটকা বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী বিগত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। মৎস অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় দফতরের মতে মাঠ পর্যায়ে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যাতে জাটকার আহরণ ও বিপণন না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখার কথাও বলেছেন মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল।
এমনকি জাটকা সংরক্ষণে প্রশাসন ও আইনÑশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নানা অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার কথা বলা হচ্ছে মৎস অধিদফতরের পক্ষ থেকে। কিন্তু এর পরও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এবারো দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে জাটকা বিক্রি হচ্ছে। এমনকি জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে গত ১০ মার্চ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত দেশে ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’ পালিত হয়। এ উপলক্ষে বরগুনার আমতলী কলেজ মাঠে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী সায়েদুল হক। কিন্তু সে সপ্তাহও শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল। তবে মৎস অধিদফতর থেকে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণে অনেক অভিযানের কথা বলা হয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, এ সময়ে জাটকা নিধণ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে দুই হাজার ৭০২টি। এ সময় প্রায় ৯০ টন জাটকা ছাড়াও প্রায় প্রায় এক কোটি মিটার কারেন্ট জালসহ নিষিদ্ধ জাল আটক করে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ৬৫২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে প্রায় ২৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় ছাড়াও ১৩৭ জন জেলে ও মৎস্যজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐাদেশও দেয়া হয়েছে বলে জানয়িছে মৎস্য অধিদফতর।
সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৫০-৬০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এ দাবি আমাদের মৎস বিজ্ঞানীদের। এর বাইরে মিয়ানমারে ২০-২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ১০-১৫ শতাংশ ইলিশ ভারতে আহরিত হয়। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে তা প্রতি বছর তিন-চার শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে। ফলে জাটকা সংরক্ষণকালীন সময়সহ আশ্বিনের ভড়া পূর্ণিমার আগে-পরে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় জেলেরা অনেকটা অবাধেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের পানি সীমাসহ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে ইলিশ ধরে নিচ্ছে। অথচ অধমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এক শতাংশেরও বেশি। মৎস সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে এ মাছের অবদান প্রায় ১২-১৩ শতাংশ।
আর এ কারণেই ইলিশের বংশ বিস্তার ও এ সম্পদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে সরকার প্রজনন মওশুমে ইলিশ অহরণসহ ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত টানা আট মাস সারা দেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ করেছে। ইতোপূর্বে এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩০ নভেম্বর থেকে ৩০ মে হলেও চলতি বছর থেকে তা আরো দু’মাস বৃদ্ধি করে ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন করা হয়েছে। পাশাপাশি জাটকার সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইতোপূর্বে ৯ ইঞ্চি সাইজের ইলিশকে জাটকা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এখন ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত ইলিশকে জাটকা হিসেবে আখ্যায়িত করে তার আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের পাইকারি মোকামগুলোতে ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪৮ হাজার আট থেকে ৫৫ হাজার টাকার ওপরে। এক কেজির ওপরের সাইজের ভালোমানের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬৫ হাজার টাকা প্রতিমণ। আর ৭০০ গ্রামের নিচের ১০ ইঞ্চি সাইজের জাটকার ওপরের ইলিশের দর ছিল ১৬-২০ হাজার টাকা মণ। খুচরা বাজারে ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২ শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা কেজি দরে।
পহেলা বৈশাখের পান্তা ইলিশের সংস্কৃতির ধাক্কায় ইলিশের বাজার অরো দুই-তিনদিন চড়া থাকবে বলে ব্যাবসায়ীরা জানিয়েছেন। পহেলা বৈশাখের বাজার ধরার লক্ষে আগে থেকেই অনেক ব্যাবসায়ী প্রচুর ইলিশ হিমায়িত করেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) ও আগামীকাল পহেলা বৈশাখের দিন এসব মাছ বাজারে ছাড়া হবে বলেও জানা গেছে।
তবে বরিশালের তালতলী, শ্রীপুর, লাহারহাট, বুখাই নগর, আড়িয়াল খাঁ, নয়া ভাঙ্গুনী নদীসহ ভোলার ইলিশা, মনপুরা, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক ও এর সন্নিহিত এলাকার ইলিশের স্বাদই আলাদা। ফলে এসব এলাকার ইলিশের কদর মাছের সমঝদারদের কাছে অনেক অগ্রাধীকার প্রাপ্ত। বরিশালের বাজারে স্থানীয় নদ-নদীর তাজা ইলিশের দাম এখন প্রায় দেড়গুন।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর নিম্ন মেঘনা, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এবং পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বরÑজানুয়ারি মাসের সময়কালকে অভয়আশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় প্রতি বছর মার্চÑএপ্রিলে মাসে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সব ধরনের মৎস আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশে। উপরন্তু মৎস বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী মেঘনার ভাটিতে সাগর মোহনার চারটি এলাকার প্রায় সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশ প্রজননস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতি বছর আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন সব ধরনের মৎস আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ