Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্থবির হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বন্দর বাঘাবাড়ি

যমুনায় বালু প্রবাহ বৃদ্ধিতে নাব্য সঙ্কট জাহাজ চলাচল বন্ধের আশঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী : যমুনা নদীর বুকে জেগে ওঠা ছোট বড় একাধিক চর,অপর্যাপ্ত জেটিঘাট, পণ্য সংরক্ষণের শেডসহ অবকাঠামোগত নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে এই নৌ-বন্দরটির কার্যক্রম। এ অবস্থায় বিআইডবিøউটিএ উত্তরাঞ্চলের একমাত্র এই নদী বন্দরটি রক্ষায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় হতাশায় ভুগছেন বাঘাবাড়ি নদী-বন্দর ব্যবহারকারী ব্যাবসায়ী ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। 

যমুনা নদী বেষ্টিত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি নৌ-বন্দর ব্যবহার করে ইরি-বোরো মৌসুমে বিদেশ থেকে আমদানী করা হাজার হাজার বস্তা ইউরিয়া সার উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বাফার গুদামে পাঠানো হয়। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের এই ১৬ টি জেলার জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান মাধ্যমও এই নদী বন্দর। দ্বিতীয় শ্রেণীর এই বন্দরটি ইজারা প্রদান বাবদ প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। ৩৬ বছর আগে মাত্র একটি শেড নির্মাণ করা হলেও ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বন্দরটির মূলপথ পাটুরিয়া-আরিচা থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত যমুনা নদী ড্রেজিং করা হয়নি একবারও। ফলে শুষ্ক মৌসুমে এই নদীপথে আসা সার ও জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যবহনকারী জাহাজ যমুনা নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে ওঠা চরে আটকা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। চরে আটকা থাকা জাহাজের পণ্য খালাস করে ছোট ছোট ট্রলারে বাঘাবাড়ি বন্দরে নিয়ে আসতে বাড়তি অর্থ ব্যয়ের ফলে লোকসানের শিকার হয় এই বন্দর ব্যবহারকারীরা। এছাড়া মাঝ নদীতে আটকে থাকা পণ্যবাহী জাহাজে নৌডাকাতি’র মত ঘটনাও ঘটে প্রতিনিয়ত। জ্বালানি তেল ও সারসহ অন্যান্য পণ্য খালাসের জন্য মাত্র চারটি জেটির এই নদী বন্দরটিতে বর্ষা মৌসুমে দেশের অন্যান্য নৌ-বন্দর থেকে নদী পথে পণ্য অতি সহজে আনা হয়, তবে পর্যাপ্ত জেটির অভাবে দিনের পর দিন পণ্য খালাসের অপেক্ষায় থাকতে হয় পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে। কুলি ও শ্রমিকদের বিশ্রাম ও খাবার খাওয়ার জন্য ন্যূনতম একটি ঘর না থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দরটিতে অতিরিক্ত জাহাজের চাপ সামাল দিতে ইজারাদের নির্মাণ করা তিনটি অস্থায়ী জেটি থেকে পণ্য খালাস করতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় দরিদ্র কুলি ও শ্রমিকদের। ইজারাদার মির্জা আনোয়ার হোসেন হিরা বলেন, বাঘাবাড়ির এই বন্দরটা ১৬ জেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় সার তেল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই বন্দর অনেক সমস্যার ভিতরে রয়েছে। পুরো মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। জাহাজ কম আসে। তাই নৌকায় করে মালামাল বন্দরে আনতে হচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাঘাবাড়ি নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বাঘাবাড়িতে বন্দর স্থাপনের পর থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ধীরে ধীরে হচ্ছে। এর মধ্যে একটি গুদাম রয়েছে যেখানে মালামাল রাখা হয়। যখন অতিরিক্ত পণ্য চলে আসে তখন কিছু পণ্য খোলা বাজারে রাখতে হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিআইডবিøউটিএ’র বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে। যার মধ্যে জটিল গুদাম নির্মাণ রয়েছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন বলেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর শাহজাদপুর উপজেলা পরিদর্শনে এসে দ্রæত এই বন্দরটির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও যমুনা নদীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাঘাবাড়ি নৌ-বন্দরকে প্রথম শ্রেণীর নদী বন্দরে পরিণত করার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাঘাবাড়ি বন্দরে শেঠ নির্মাণ না করায় খোলা আকাশের নিচে সার রাখতে হচ্ছে। জাহাজ সব সময় যাতে বন্দরে আসতে পারে সেজন্য ড্রেজিং করা প্রয়োজন। মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো বর্তমানে যমুনা নদীতে পানি হ্রাস পেয়ে বালু প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে জাহাজ চলাচল বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, যমুনায় নাব্য সংকটের কারণে দেশের উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান নৌবন্দর বাঘাবাড়িতে আসতে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজ। এতে আমদানি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। বাঘাবাড়ি বন্দরমুখী জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী ছোট ছোট কার্গো জাহাজ মাঝে মধ্যেই ডুবোচরে আটকা পড়ছে। দ্রæত ড্রেজিং করা না হলে এ নৌরুটটি যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাঘাবাড়ি রিভারাইন অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ৩টি কোম্পানির বিপণন কেন্দ্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৫টি জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ আন্ডার লোড নিয়ে বাঘাবাড়ি বন্দরে আসছে। নাব্য সঙ্কটের আগে প্রতিটি জাহাজ ১০ থেকে ১২ লাখ লিটার জ্বালানি তেল বহন করত, বর্তমানে প্রতিটি জাহাজ ৫ থেকে ৬ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে বন্দরে আসছে।
চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় পাঁচ লাখ ৯০ হাজার ডিজেল চালিত সেচযন্ত্র চালাতে অতিরিক্ত প্রায় ৪৫ কোটি লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। বিপিসি’র বাঘাবাড়ি রিভারাইন অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি কোম্পানির বিপণন কেন্দ্রে আপত্কালীন মজুদ আছে মাত্র পাঁচ কোটি লিটার ডিজেল। এ অঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে এ বছর প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার টন সার মজুদ রয়েছে। চলতি ইরি-বোরো মওসুমে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৮২ হাজার টন। নৌবন্দর বাঘাবাড়ির সাথে যোগাযোগের একমাত্র নৌপথ যমুনা নদীর মোহনগঞ্জ, পেঁচাকোলা, নাকালিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মারাত্মক নাব্য সঙ্কট দেখা দেয়ায় জাহাজ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। যমুনা নদীতে বালুর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর ও ডুবোচর। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে যেকোনো মুহূর্তে বাঘাবাড়ি বন্দরমুখী জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, একটি জাহাজ চলার জন্য নদীতে ১০ ফুট গভীরতা প্রয়োজন অথচ অনেক নৌ চ্যানেলে ৬ ফুট গভীরতাও নেই। এমনকি অনেক সময় ড্রেজিং করেও নাব্যতা ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনার মংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সার এবং কয়লা বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে খালাস করে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সরবরাহ এবং আপত্কালীন সময়ের জন্য মজুদ করা হয়। নাব্য সংকটে জাহাজ চলাচল বিঘিœত হওয়ার কারণে বা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলে এ অঞ্চলে এ সব পণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বিপিসি’র বাঘাবাড়ি রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার মোঃ আব্দুল মজিদ জানান, বাঘাবাড়িতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে পাঁচ কোটি লিটার ডিজেল মজুদ আছে। প্রতিদিন একাধিক জাহাজ জ্বালানি তেল নিয়ে বন্দর ডিপোতে ভিড়ছে। জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ