Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল : লুটপাট ও বিল হজমের খেলা আর কত?

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
সুনামগঞ্জ দেশের অন্যতম ধান ও মাছ উৎপাদনকারী জেলা। এক সময় ছিল মহকুমা। ক’বছর পূর্বে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কারণে মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এ জেলায় জন্মগ্রহণ করছেন কবি, মরমী কবি, দার্শনিক, সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুণী অনেকেই। তাদের কেউ কেউ এখনও প্রতিষ্ঠিত আছেন দেশ-বিদেশে বিভিন্নভাবে। কিন্তু এত সব পরেও অনুন্নত এ জেলাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বলতে গেলে স্বাধীনতার পূর্বে যে অবস্থানে ছিল আজও আছে একই অবস্থানে। অথচ এ জেলার বিল ও হাওর ইজারা দিয়ে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছেন।
বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের প্রায় সম্পূর্ণ এলাকা হাওর বেষ্টিত, যাকে ভাটি অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। এক সময় এ ভাটি অঞ্চলের লোকজনের গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু ছিল, কিন্তু এর একটিও নেই এখন। আছে শুধু অভাব-অনটন-হতাশা। বাংলাদেশের বন্যা উপদ্রæত এলাকা বলে চিহ্নিত সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলা রয়েছে ৮১টির মতো ইউনিয়ন যার জনসংখ্যা ২০ লাখেরও অধিক। জনসংখ্যার ৯০ ভাগই কৃষক, মজুর শ্রমিক, মৎস্যজীবী, গরিব। খেটে খাওয়া এসব মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর। এদের জীবন মান দারিদ্র্য সীমার অনেক নিচে।
ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত জেলার দিরাই, তাহিরপুর, শালা, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজার এলাকার অধিকাংশ স্থানে বছরের প্রায় ৫ মাসই থাকে অথৈ পানি। মধ্যখানে দ্বীপের মতো এলাকায় মানুষের বসবাস। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। এলাকার লোকজন বোরো চাষ করে। কপাল ভাল হলে এবং আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে তাদের ভাত-কাপড়ের সংস্থান হয়। অন্যথায় দিনাতিপাত করতে হয় একবেলা খেয়ে আর দুবেলা না খেয়ে। অনেকেই স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে থাকে উপোস। দারিদ্র্য এদের নিত্যদিনের সাথী।
এবার মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম দিকের বন্যা আর পাহাড়ি ঢলে ভাটি অঞ্চলের ৯০ ভাগ কাঁচা-পাকা ফসল বিনষ্ট হয়। কাঁচা ঘর, ভিটা পানির নিচে তলিয়ে যায়। খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ গৃহপালিত জন্তু নিয়ে গৃহস্থরা পড়েছে বিপাকে। হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে সমগ্র এলাকাজুড়ে। সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের হাল অবস্থা ও বন্যাত্তোর পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ তা আঁচ করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ অতি প্রয়োজন। এবারের বন্যা আর ঢলে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক মেরুদÐ ভেঙে পড়েছে। বিবর্ণ আজ তাদের চেহারা। শ্রীহীন ফ্যাকাশে মুখে আজ আর হাসি নেই। তাদের নিস্তেজ ভাসমান জীবনে প্রাণের উচ্ছলতা ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ। আজ তারা হাহাকার করছেন, তাদের ঘরে ভাত নেই। পরনে কাপড়ে নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই কর্মসংস্থান নেই। আয়ের সকল পথই আজ তাদের বন্ধ।
ফসল রক্ষা, বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি, অনিয়ম আর গাফেলতির কারণে একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলি ধান তলিয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি পড়তে হবে এমন ধারণা সবারই। এলাকার জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা যায়, হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাই দায়ী। জনগণ এ অপকর্মের জন্য দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। এ দিকে নানাস্থানে সাধারণ মানুষ, কৃষক ও বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধনের মাধ্যমে দোষী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ধ্বনি তুলেছেন। তারা সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা এবং আগামী মৌসুমে ধান ওঠার পূর্ব পর্যন্ত ১০ টাকা কেজি করে চাল সরবরাহের আহŸান জানান। জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা যায়, এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ফসলের আবাদ করা হয়েছে। ৪২টি হাওরের ফসল রক্ষায় ৫৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগ টাকাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম জেলা দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও সুধীজনদের সম্মুখে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ওরা স্থায়ী সমাধানে না গিয়ে ঘুরেফিরে প্রতি বছর ইচ্ছা করেই লুটপাটের সুবিধার্থে একই জায়গায় যৎসামান্য মাটি ফেলে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে থাকেন। তিনি বলেন, এ খেলা আর কত দিন চলবে? জেলা প্রশাসক বলেন, হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে মাটি কেটেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি কোন বাঁধই। ফলে তলিয়ে গেছে প্রায় ৯০ ভাগ ফসল।
সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের সমস্যা একটা জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে আন্তরিকতার সাথে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ অঞ্চলের নদীগুলো পলিমাটি আর বালুতে ভরাট হয়ে গেছে। বিল আর হাওরের পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ প্রতিবন্ধকতার কারণে আজ বোরো জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলে খাল-বিল, নদী-নালা ডোবা পানিতে একাকার হয়ে যায়। অথচ এসব সমস্যা সমাধান কল্পে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। সুনামগঞ্জ জেলা থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ধান আর মৎস্য চাষ করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে শুধু উদ্যোগ আর আন্তরিকতার প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের সমস্যা নতুন নয়- কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনাও নয়। এ সমস্য কমবেশি সকলেরই জানা। এ অঞ্চলে প্রতিবছরই ঢল নামে, বন্যা হয় দুর্দশার সম্মুখীন হয় লাখ লাখ মানুষ। বিনষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। প্লাবনের পানি সাগরের ঢেউয়ের মতো উত্তাল তরঙ্গে জেগে উঠে। হাওর আর বিলের স্রোতরাশি দেখলে মনে হয় এ যেন এক বিশাল সাগর, যার কোনো সীমানা নেই।
সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন তা হলো নৌ ও সড়ক পথে প্রতিটি থানাকে জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনকল্পে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রতিটি নদী খনন করে প্রয়োজন বোধে স্থানে স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে যাতে পানির ঢলে বা স্রোতে বাঁধ ভেঙে না যায়। নদী খনন করে নাব্যতা বৃদ্ধি করে পানির গতি প্রবাহকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে যাতে পানি তীর বেয়ে উপরে উঠতে না পারে। বিল ও হাওর থেকে পানি যাতে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে, স্থানীভাবে এর ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রয়োজনীয় স্থানসমূহে ¯øুইস গেটের ব্যবস্থা করতে হবে, যাবে পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য গেট উঠানো বা নামানো যায়।
এলাকার হাল অবস্থা সার্বিকভাবে জানে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী-আমলা সবাই। বন্যার খবর পেলে তারা একটু সজাগ হোন সচেতন আসেন সুনামগঞ্জে, প্রেস ব্রিফিং করেন জনগণের সঙ্গে বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলাপ করেন, ফটো উঠান, সমবেদনা প্রকাশ করেন। এটা রাজনীতি কিন্তু সমস্যার গভীরে কেউ যেতে চান না। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কেউ যেন আন্তরিক নয়, তৎপর নয়। জনগণের জীবন মরণ সমস্যা যেখানে-সেখানে চলে রাজনীতি।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের সাথে আলাপে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে তারা তৎপর। প্রতিবছর এর স্থায়ী সমাধানে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় করা হচ্ছে। এখানে প্রশ্ন আসে সমস্যার সমাধান হয় না কেন? সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়- বরাদ্দকৃত টাকা সময়মত ব্যয় করা হয় না। অসময়ে কাজ করা হয় আর বরাদ্দকৃত টাকার বৃহৎ অংশই নাকি সঠিকপথে ব্যয় করা হয় না- বরাদ্দকৃত টাকার বড় অংশই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ অন্যান্যদের পকেটস্থ হয়।
জাতীয় সমস্যা সমাধানে আমাদের সকলেই আন্তরিক সৎ উদার ও উদ্যোগী হওয়া বঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে দেশ-প্রেমের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু দেখা যায়, এখানেও দুর্নীতি। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থকেই বড় করে দেখা হয়। রক্ষক এখানে ভক্ষকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয় যা বাঞ্চনীয় নয়।
সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের উন্নয়নে ও লাখ লাখ লোকের কল্যাণ তথা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনে প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার সঙ্গে সততা, সদিচ্ছা, নিষ্ঠা একাগ্রতা থাকতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, দেশপ্রেম থাকলে এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান সম্ভব নয়। আর তা না হলে একদিন হয়তো এমন হবে যে সুনামগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চল জনবিরল কিংবা বসতিহীন বেলাভ‚মিতে রূপ নেবে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে শেষ পর্যন্ত অনুতাপ-অনুশোচনা কোনো কাজেই আসে না, আসবেও না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন