Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেনারিশিল্প দ্রুত স্থানান্তÍর ও সিইটিপি নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বহু রশি টানাটানির পর হাজারিবাগের টেনারিশিল্প অবশেষে তার পরিবর্তিত ঠিকানা সাভারের বালিয়াপুরে নির্ধারিত চামড়াশিল্প নগরীতে যাত্রা শুরু করেছে। হাজারিবাগের অপরিকল্পিত চামড়াশিল্প বুড়িগঙ্গার মারাত্মক দূষণ এবং পুরনো ঢাকার পরিবেশগত বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল বহু আগেই। প্রতিদিন শত শত টেনারি থেকে নির্গত হাজার হাজার লিটার নানা ধরনের রাসায়নিক ও ভারী ধাতব পদার্থ সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলে নদীটিকে বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত নহরে পরিণত করা হয়েছে। এ কারণেই নব্বইয়ের দশক থেকেই ঢাকার নাগরিক সমাজ এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা হাজারিবাগের টেনারি সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। গণমাধ্যমও বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে হাজারিবাগের টেনারি স্থানান্তরের পক্ষে অব্যাহতভাবেই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জনস্বার্থে আদালতের পক্ষ থেকেও একের পর এক রুল ও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তবে কোনো দাবি, নির্দেশনা বা প্রচারণাই টেনারিশিল্প মালিকদের চেতনা স্পর্শ করতে পারেনি। তা নাহলে সরকারী সিদ্ধান্ত এবং সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও দেড় দশক ধরে টেনারি মালিকরা যথেচ্ছভাবে বুড়িগঙ্গা দূষণ চালিয়ে যেতে পারত না। বুড়িগঙ্গার দূষণ ঠেকাতে ২০০১ সালেই হাজারিবাগ থেকে টেনারিশিল্প সরিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। টেনারি মালিকদের নানা টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণের অপপ্রয়াসে এভাবেই কেটে যায় আরো একদশক। দ্বিতীয় দফায় ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারীর মধ্যে টেনারিশিল্প সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর একাধিকবার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে টেনারিশিল্প সরিয়ে নিতে মালিকরা সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।
শিল্পমালিকদের দাবি অনুসারে টেনারিশিল্প সরিয়ে নেয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইতোমধ্যে প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানা যায়। এতকিছুর পরও হাজারিবাগের টেনারিশিল্প যেন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকতে চেয়েছিল। শিল্পমন্ত্রীর ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এবং আদালতের নির্দেশ অমান্য করে শিল্প চালু রাখায় প্রত্যেক শিল্পমালিককে দিনে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দেয়ার পরও যখন তাদের টনক নড়ছিল না, সবশেষে হাজারিবাগ চামড়াশিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেন আদালত। এভাবেই বহুপ্রত্যাশিত চামড়াশিল্প স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাস্তব পথের অভিযাত্রায় সামিল হল। পক্ষান্তরে টেনারিশিল্পের স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় অন্যপ্রান্তের বিরূপ চিত্রও এখন উঠে আসছে। একদিকে বার বার আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে টেনারিশিল্প মালিকরা তাদের কারখানা স্থানান্তরের কোন উদ্যোগ নিচ্ছেনা বলে অভিযোগ করা হলেও প্রস্তাবিত চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও শোধনাগার সিইটিপি’র কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। সেই সাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির মত ইউটিলিটি সার্ভিসসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় এখনো চরম অব্যস্থাপনা বিরাজ করছে। টেনারিশিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে উঠে আসলেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের গড়িমসি ও গাফিলতিও এখানে স্পষ্ট।
হাজারিবাগ থেকে টেনারিশিল্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগের প্রতি সব শ্রেণীর মানুষের সর্বাত্মক সমর্থন থাকলে এখন সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, টেনারিশিল্প স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি এখনো অগোছালো ও অপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। প্রায় দুই দশক আগে গৃহিত সরকারী সিদ্ধান্ত, জনগণের প্রত্যাশা এবং আদালতের বারংবারের নির্দেশনার পরও টেনারিশিল্প নগরীতে সময়মত সিইটিপি চালু করতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার একটি জবাবদিহিতা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অগোছালো অবস্থায় টেনারিশিল্প স্থানান্তরে সরকারের অনড় অবস্থানে সরকার এ শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মালিক-শ্রমিকরা। যদিও বছরের পর বছর ধরে উপর্যুপরি তাগিদ দেয়া সত্তে¡ও সেখানে স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করার দায় শিল্প মালিকরাও এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমরা যখন দেখছি আদালতের নির্দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে কিছু কিছু টেনারি কারখানা সাভারে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে তখনো সিইটিপি ব্যবস্থা চালু করতে না পারার ব্যর্থতার দায় অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে হাজারিবাগ থেকে টেনারি সরিয়ে নিয়ে সিইটিপিসহ আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা ছাড়াই সাভারে টেনারি শিল্পনগরীর কাজ চালু করে যদি ধলেশ্বরীকে দূষণের মুখে ঠেলে দেয়া হয়, সেটা আরো বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের একটি শিল্প নগরী চালু করতে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলের সাময়িক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। তবে রাসায়নিক দূষণ ও বর্জ্যবব্যস্থাপনার ক্ষেত্রে একদিনের জন্য কোন ছাড় বা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। আগামী কোরবানী ঈদের আগেই টেনারিশিল্প নগরীতে সকল কারখানা ও মালিক- শ্রমিকদের পুনর্বাসন সম্পন্ন করতে হবে। দ্রæততম সময়ের মধ্যে সাভারের টেনারিশিল্প নগরীর অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনে আরো অর্থ বরাদ্দসহ সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। টেনারিশিল্প ছাড়াও যে সব শিল্প-কারখানা সরাসরি নদীতে রাসায়নিক দূষণ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন