Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ঝুঁকি

বন্ধ্যাকরণ সেবা নিয়ে মেরী স্টোপস’র অনিয়ম

| প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : দেশে জনসংখ্যার আধিক্য প্রতিদিনই বাড়ছে। আর তাই উচ্চ জন্মহার প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি চালু করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। কিন্তু এ কর্মসূচির বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সূত্র মতে, সরকারের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান মেরী স্টোপস ক্লিনিক দীর্ঘদিন থেকে পুরুষ ও মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা প্রদান করছে। এরই অংশ হিসেবে তারা দেশের পুরুষের ভেসেকটমি ও মহিলাদের লাইগেশন (বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি) সেবা প্রদান করছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মেরী স্টোপস তাদের ক্লিনিকের সাফল্য দেখাতে সেবা নিতে আসা মহিলাদের না জানিয়েই কপারটি ও ইমপ্লানন পরিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ভেসেকটমির শতকরা ৯৫ ভাগই ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। সাফল্য দেখাতে এ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। আর এ কারণে সেবা নিতে নারীরা পড়ছেন নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এদিকে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ইতিমধ্যে ২৫টি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। দাতা সংস্থা থেকেও বাংলাদেশ মেরী স্টোপসের এ সকল অভিযোগের তদন্ত চলছে। আর্থিক দুর্নীতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনার জন্যে তিনজন বিদেশী মেরী স্টোপস কর্মকর্তা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, আমি বিষয়টি জেনেছি। সরকার থেকে অর্থ নিয়ে এভাবে অনিয়ম চলতে পারে না। শিগগিরই এনজিওগুলোকে নিয়ে বসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন থেকে এনজিও’র সকল কার্যক্রম কঠোরভাবে তত্ত¡াবধান করা হবে।
ভুক্তভোগীদের মতে, মেরী স্টোপসের মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাÐে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
অনুসন্ধানে মেরী স্টোপসের ঢাকা-১ ক্লিনিকের গত বছরের নথিপত্রে দেখা যায়, ভেসিকটমী করা ৫শ’ সেবা গ্রহীতার মধ্য থেকে ৬৭ জনের খোঁজ নিয়ে ৩ জন ভেসেকটমি করা ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। বাকী ৬৪ জনের কোন অস্তিত্বই নেই। বিপরীতে মহিলাদের স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি লাইগেশন গ্রহীতা ৪ জন নারীকে পাওয়া গেছে। মহিলাদের জন্য বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানের ভেসেকটমি ও লাইগেশনের এই চিত্র অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এছাড়াও এমআর ও এমআরএম সেবা নিতে আসা মহিলাদের কাছে তথ্য গোপন করে সুই-সুতা বলে কপারটি ও ইমপ্লানন পরিয়ে দিচ্ছে শুধুমাত্র তাদের সাফল্য দেখানোর জন্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেরী স্টোপসের বিরুদ্ধে উঠে আসা বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। মেরী স্টোপস ক্লিনিকে বর্তমানে ভেসেকটমি কার্যক্রম সমায়িকভাবে বন্ধের নির্দেশ এবং অধিকতর তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এছাড়া উক্ত ক্লিনিকসমূহের এমআর ও এমআরএম সঠিকভাবে পরিপালনের নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার নামে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে মেরী স্টোপসের জাতীয়ভাবে নেয়া জন্মনিয়ত্রণ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ক্লিনিকের প্রতারণার শিকার এক নারী গত বছরের ৩০ অক্টোবর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, উক্ত ক্লিনিকে এমআরএম করাতে আসলে তাকে না জানিয়ে কাঠি বলে ইমপ্লানন (তিন বছর মেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি) পরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোগী এবং তাদের স্বজনদের কাছে এই ইমপ্লানন প্রসঙ্গে কোন ধারণা দেয়া হয় না। তড়িঘড়ি করে সম্মতিপত্রে রোগীর কাছ থেকে সই নেয়া হয়।
কামরাঙ্গির চরে বসবাসকারী জোসনা নামের এক নারী মেরী স্টোপস রেফারেল ক্লিনিক ঢাকা-১ এ এমআর করতে আসলে তাকে না জানিয়েই সূতা বলে ১০ বছর মেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কপারটি পরিয়ে দেয়া হয় বলে জোসনার স্বামী মিজানুর রহমান জানান। তিনি জানান, আমার স্ত্রীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ‘কপারটি’ পরানোর আগে আমাদের জানানো হয়নি। তারা যে এরকম প্রতারণা করবে তা ভাবতেও পারিনি।
রোগীরা জানান, রোগীর সাথে কথা বলার সময় চিকিৎসক বলেন- মাসিক নিয়মিত হওয়ার জন্য যে ওষুধ খাবেন তার সঙ্গে হাতে একটি ইনজেকশন নিতে হবে, তাহলে ভালভাবে বিøডিং হয়ে আপনার বাচ্চাটা পড়ে যাবে। এটা যে একটা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি তা রোগীকে জানানো হয় না। এমনকি এর সুবিধা-অসুবিধা, জটিলতা রোগীর কাছে গোপন রাখা হয়। ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রোগীর হাতের কাঠি (ইমপ্লানন) খুলে দেয়া হয়। ইমপ্লানন পরার চেয়ে খোলা অনেক বেশী কষ্টকর বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এছাড়া এমআর (সার্জারির মাধ্যমে মাসিক নিয়মিত করণ) এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের কথা বলে ওটউ ৩৮০-অ মডেলের দশ বছর মেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পরিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে কপারটি (সুতা) হিসেবে পরিচিত এ পদ্ধতি মহিলাদের জরায়ুতে পরিয়ে দেয়া হয় বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেরী স্টোপস ক্লিনিকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর অনিল তামবে চলে যাওয়ার পর থেকে কয়েকজন কর্তা ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করছে। তাদের অবৈধ কর্মকাÐে সংস্থাটি ক্রমেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা জানান, দিনের পর দিন মেরী স্টোপসের সার্বিক সেবার মান নিম্নমুখী। সেবা গ্রহীতারাও ক্লিনিকটির ওপর আস্থা হারাচ্ছে। চক্রটির সীমাহীন লোভ ও অযোগ্যতার কারণে ইতিমধ্যে অনেকগুলো ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। এই চক্রটি স্বজনপ্রীতি, বদলি-ছাঁটাই, নিয়োগ-বাণিজ্য, ভুয়া কর্মসূচি পালন দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত, কমদামে ওষুধ কিনে তা বেশিদাম দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার প্রদর্শনসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অডিট ও পরিসংখ্যান সঠিক রাখতে ভুয়া কাগজ-পত্র তৈরী করছেন। এই চক্রটির কাছে কর্মকর্তা-কর্মচারীও জিম্মি।
লালমাটিয়াস্থ মেরী স্টোপস ক্লিনিকের প্রধান অফিসে কর্মকর্তাদের অনৈতিক জিজ্ঞাসার শিকার একাধিক ভুক্তভোগী জানান, সেখানে এক কর্তাব্যক্তির রুমকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানে স্টাফদের ডেকে নিয়ে অশোভন আচরণের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। চাকরিচ্যুতির ভয় দেখানো হয়। আইনি ব্যবস্থা নিলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা না দেয়াসহ বিভিন্ন হুমকি দেয়া হয়। একই সঙ্গে কর্তাব্যক্তিদের নির্যাতনে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে এক ভুক্তভোগী নারী জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অযোগ্য ও দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে মেরী স্টোপস ইন্টারন্যাশনাল-এর কার্যকরি কোন ভূমিকা না থাকায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মেরী স্টোপসের ওই দুষ্টচক্রটি দুর্নীতি শুধু নিজের প্রতিষ্ঠানের সাথে করেছে এমন নয়, তারা রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ও স্বাস্থ্যসেবাকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
মেরী স্টোপস রেফারেল ক্লিনিক ঢাকা-১ এর ম্যানেজার এরশাদুল হক এম আর এবং এম আর এম রোগীদের কাছে তথ্য গোপন করে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। মেরী স্টোপসের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (কোয়ালিটি ইমপ্রæভমেন্ট) ড. মো. আবুল খায়ের-এর সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, কপারটি ও ইমপ্লানন পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয় বহুল চিকিৎসা। যা বাংলাদেশ সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এই সকল প্রতিষ্ঠানের অপকর্মের কারণে পরিকল্পনা পদ্ধতি তেমন কোন কাজেই আসছে না। তাদের পরিসংখ্যানও হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। অথচ কাগজে কলমে কার্যক্রম দেখিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন এনজিও।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ