Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন : শারীরিক শিক্ষা সম্পর্কে কিছু বলতে বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গেলে প্রথমেই শিক্ষা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। শিক্ষা শব্দটি ব্যাখ্যা প্রদান করলে শারীরিক শিক্ষা কী তা বোঝা সহজ হবে। শিক্ষা সম্পর্কে বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তি নানাভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যা বিভিন্ন অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। শিক্ষা শুধু বৃদ্ধিভিত্তিক বিকাশ নয়, ব্যক্তির শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক ও অন্যান্য দিকের সুষম বিকাশ সাধন করে। শিক্ষা ব্যক্তি জীবনের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়েই ঘটে না। শিক্ষা জীবনব্যাপী বিস্তৃত। শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা অর্জিত হয় পরিবারে, সমাজে, খেলার মাঠে এবং সর্বত্র। শারীরিক শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার অংশ। শারীরিক শিক্ষা ছাড়া সাধারণ শিক্ষা অর্থহীন বা অসম্পূর্ণ। এতসব কথা জানা সত্তে¡ও বাংলাদেশের শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি খুবই সংকুচিত এবং অবহেলিত অবস্থায় আছে, যা মোটেও কাম্য নয়। অনেক বছর পর জেএসসি এবং এসএসসিতে বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করা হয়েছে। আবার শোনা যাচ্ছে, দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ মহোদয়গণ এ বিষয়টিকে বাদ বা ঐচ্ছিক করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। শিক্ষাবিদদের এ সুপারিশ নাকি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কথাটি শুনে শারীরিক শিক্ষার সাথে যে সকল ব্যক্তিবর্গ জড়িত রয়েছে তাদের মনে খুবই কষ্ট লাগার কথা। কারণ শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস অর্থাৎ খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি না থাকলে সাধারণ শিক্ষায় প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষাকে উজ্জীবিত করার জন্য এ শিক্ষাটি দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করা খুবই জরুরি। যে দেশের সাধারণ শিক্ষা উন্নত সে দেশের শারীরিক শিক্ষাও তত উন্নত। সাধারণ শিক্ষার সাহায্যে দেশ ও জাতি যতটুকু উন্নতি করতে পারে শারীরিক শিক্ষার সাহায্যে আরো বেশি উন্নতি লাভ করতে পারে বা পরিচিত লাভ করা যায়। যেমন বিশ্ব অলিম্পিকে যে সকল দেশ অংশগ্রহণ করে পদক লাভ করেছে সে সকল দেশকে সবাই চিনেছে অর্থাৎ পৃথিবীর মধ্যে সে দেশ এর জাতীয় সংগীত বেজে উঠেছে এবং জয়ী খেলোয়াড় তার দেশের জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে পদক গ্রহণ করছে। বিশ্বের দ্রæততম মানব উসাইন বোল্টের নাম ও তার দেশের নাম সবাই জানে এবং চেনে। উসাইন বোল্ট বললে বোঝায় জ্যামাইকার সন্তান আর মাইকেল ফেলেপস বললে পৃথিবীর সকল মানুষ এক নামে চেনে মার্কিন সাঁতারু। পেলে বললেই চেনে ব্রাজিল আর ম্যারাডোনা মেসি বললে চেনে আর্জেন্টিনা। এত বড় বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড় তৈরি করতে তাদের দেশ ও জাতিকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এবং শারীরিক শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হয়েছে। আজ খেলাধুলায় যে সকল দেশ উন্নত এবং বিশ্বে পরিচিত খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেসব দেশে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হচ্ছে। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে টার্গেট ঠিক করে প্রশিক্ষণ নিলে কাক্সিক্ষত ফল পাচ্ছে। কথায় বলে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, সুস্থ দেহে সুন্দর মন। এই কথাগুলো কে না জানে? রোগমুক্ত শরীর গঠন করতে হলে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সমাজে অপরিসীম। যে শিক্ষাটি সমাজের মানুষের এত উপকার করে এ বিষয়টি আজ আমাদের দেশে অবহেলিত। শারীরিক শিক্ষা আমাদের শরীরকে সুস্থ ও সতেজ রাখে কথাটি জানা সত্তে¡ও বিষয়টির প্রতি আমাদের এত অবহেলা দেখলে খুবই করুণ লাগে। মানুষ শারীরিক এবং কায়িক পরিশ্রম না করার কারণে তাদের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠুভাবে, মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। একজন ডায়াবেটিস রোগী জানে তার শারীরিক এবং কায়িক পরিশ্রম কতটুকু প্রয়োজন? দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরাও ভালোভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করেও তার প্রতি এত না বোধক উক্তিতে আমাদেরকে খুবই হতাশ এবং আশাহত করেছে। মানুষ একটু ফুসরত পেলে খেলাধুলা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য দেশ-দেশান্তরে পাড়ি জমায়। এটাও তো শারীরিক শিক্ষার একটি অংশ। হাঁটা একটি উত্তম ব্যায়াম। আমরা কম-বেশি কে না হাঁটি। বলতে গেলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। একজন ভালো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের সমাজে যেমন দাম আছে। তদ্রুপ একজন ভালো খেলোয়াড় তথা শারীরিক শিক্ষাবিদের সমাজে অনেক প্রয়োজন আছে। আজ সমাজে ভালো খেলোয়াড়ের খুবই অভাব। একজন সেরা খেলোয়াড় দেশ ও জাতিকে বিশ্বের কাছে অতি সহজে পরিচিতি লাভ করাতে পারে। পৃথিবীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর নাম সবাই নাও জানতে পারে কিন্তু সাকিব আল-হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিক ও মুস্তাফিজের নাম অনেকেই জানে। তাদেরকে দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে বেশি বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। তাই পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশের শারীরিক শিক্ষাকে উন্নত করতে পারলে, পৃথিবীর বিখ্যাত খেলোয়াড় তৈরি করতে পারলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব অলিম্পিকসহ সাফ এবং এশিয়ান গেমস পদক পেতে সহায়তা করবে। যদিও ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে আসছে। তবে পদক পাওয়া তো দূরের কথা এ পর্যন্ত এশিয়ান এবং অলিম্পিক গেমসে মূল পর্বে উঠে লড়াই করতে পারেনি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, বাংলাদেশের শারীরিক শিক্ষা ক্রীড়ার কী করুণ দশা। তাই এ বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার মূল থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা দরকার। এ শিক্ষাটিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করে জাতীয়ভাবে নিখুঁত পরিশ্রম করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফল আসবে। শারীরিক শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া ভালো খেলোয়াড় তথা আন্তর্জাতিক পদক পাওয়ার আশা করা যায় না। তাই সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিটি থানা থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত সরকারিভাবে ১টি করে শারীরিক শিক্ষা কলেজ স্থাপন করে প্রশিক্ষণ কর্মশালা তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর প্রাচীনতম খেলাধুলা হলো দৌড়, লাফ ও নিক্ষেপ। প্রাচীনকালে শারীরিক শিক্ষা বলতে শরীর সমন্ধীয় শিক্ষাকে বুঝানো হতো। শরীর সমন্ধীয় শিক্ষা বা শারীরিক কসরতকে শারীরিক শিক্ষা নয় শরীরচর্চা বলে। শারীরিক শিক্ষা শুধু শরীর নিয়ে আলোচনা করে না। এর সাথে মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলী কীভাবে অর্জিত হয় সে ব্যাপারেও শিক্ষা দিয়ে থাকে। শারীরিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির সর্বাত্মক উন্নতি সাধন করা। অর্থাৎ সুস্থ দেহে সুন্দর মন গড়ে তোলা। শারীরিক শিক্ষার প্রধান কাজ হলো শিশুকে আনন্দ ও খেলাধুলার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা ও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা। “উইলিয়ামসের মতে, শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক ও সামাজিক ও অন্যান্য দিকের সুষম উন্নতি ঘটিয়ে ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের চেষ্টা করা”। বুক ওয়াল্টার বলেছেন, শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দিকসমূহের সু-সমন্বিত বিকাশ সাধন। এই বিকাশ সাধনের উপায় হলো- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও নিয়মনীতি অনুসারে পরিচালিত খেলাধুলা, ছন্দময় ব্যায়াম এবং জিমন্যাসটিকস ইত্যাদি ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করা। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, কোনো বিষয় বা শিক্ষাকে বড়-ছোট ভাবা ঠিক নয়। সব বিষয়কে বা শিক্ষাকে সমান মূল্যায়ন করা উচিত। শারীরিক শিক্ষাকে একেবারে মূল থেকে তুলে এনে পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মতো উন্নত করা উচিত। আমাদের এ কথাও মনে রাখা উচিত যে, বাংলাদেশের শারীরিক শিক্ষা বিশ্বমানের হলে বিশ্ব অলিম্পিকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদক পাওয়া খুব সহজ হবে। তাই আমাদের সকলের উচিত এ শিক্ষাটিকে যথাযথ সম্মান এবং মূল্যায়ন করা।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন