Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভারতের সঙ্গে সব চুক্তি সংসদে উত্থাপনের দাবি

টিআইবি পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ

| প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


সংসদের বাইরের প্রতিপক্ষকে (বিএনপি) নিয়ে ২১০১ বার কটূক্তি : কোরাম সঙ্কটে ৪৭ কোটি টাকার অপচয় সংসদের ভেতরে-বাইরে জাতীয় পার্টি ব্যর্থ
স্টাফ রিপোর্টার : জাতীয় সংসদের অধিবেশনগুলোতে সংসদ সদস্যদের অসংসদীয় আচরণ করার প্রবণতা কমেনি। সংসদে বিভিন্ন আলোচনা পর্বে অসংসদীয় ভাষা (আক্রমণাত্মক, কটু ও অশ্লীল শব্দ) ব্যবহারে মোট সময়ের ১৫ ভাগ ব্যবহার হয়েছে। এই সাত অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে, কমেছে কোরাম সঙ্কট। কিন্তু তারপরও কোরাম সঙ্কটের কারণে ৪৭ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো জাতীয় সংসদে উত্থাপন ও জনসমুক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এতে সংসদ ও জনগণের অধিকার ক্ষুণœ করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তিগুলো আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন ও তা নিয়ে আলোচনার দাবি করেছে টিআইবি।
সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে (বিএনপি) নিয়ে ২১০১ বার, সংসদের ভিতরের প্রতিপক্ষকে নিয়ে ৪৩৩ বার বিভিন্ন কটূক্তি, আক্রমণাত্মক শব্দ ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে বিধি ২৭০-এর ৬ উপবিধির ব্যত্যয় হয়েছে। বিরোধী দলের ভূমিকা, অন্যদিকে সরকারের অংশ-এমন দ্বৈত অবস্থানের কারণে সংসদের ভেতরে-বাইরে জাতীয় পার্টি ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছে টিআইবি।  ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পার্লামেন্ট ওয়াচ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল রবিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে ২ হাজার ১০১ বার এবং সংসদের ভেতরে থাকা প্রতিপক্ষকে নিয়ে ৪৩৩ বার কটূক্তি, অশালীন ও আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যাতে বিধি ২৭০-এর ৬ উপ-বিধির সংসদীয় আচরণবিধির ব্যত্যয়। আইন প্রণয়নে এমপিরা সংসদে কম অংশগ্রহণ করছেন। আইন প্রণয়নের  ক্ষেত্রে জনমত গ্রহণের সুযোগ সীমিত। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সংসদ অধিবেশনে উত্থাপিত হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তি ছাড়া সম্পাদিত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা সংবিধানে থাকলেও ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে স্বাক্ষরিত ৬৯টি চুক্তি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি। গবেষণার বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় সংসদে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। সংসদে উপস্থিতি বেড়েছে। আইন প্রণয়নের সময় বেড়েছে। বিলপ্রতি সময় বেড়েছে। কোরাম-সংকট কিছু কমেছে। আগের তুলনায় প্রধান বিরোধী দল সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে তাদের দ্বৈত ভূমিকা এখনো অব্যাহত আছে। সাংবাদিকের প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নবম সংসদের চেয়ে দশম সংসদ কার্যকর কি না, তা এখনই বলা যাবে না। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সময় টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, এই সংসদ অনেক বেশি কার্যকর- এই উপসংহারে যাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে এখনো অনেক সন্দেহ রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিধি অনুযায়ী অধিবেশন চলাকালীন গ্যালারিতে শৃংখলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্পিকারের ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সংসদে অধিকতর শৃংখলা রক্ষাসহ অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।
বিরোধী দলের ভূমিকা ও অসংসদীয় ভাষা
টিআইবি মনে করে, দশম সংসদের প্রায় তিন বছরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের ‘বিতর্কিত অবস্থানের কারণে’ তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি’র বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের চেয়ারে বসার পাশাপাশি মন্ত্রিত্বও নিয়েছে জাতীয় পার্টি। তখন থেকে বিএনপি নেতারা জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে আসছেন। একদিকে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ আছেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বে। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন তাদের তিন নেতা। এছাড়া দলটির  চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বে (মন্ত্রী পদমর্যাদায়)। সংসদীয় কার্যক্রমে সরকার দলীয় সদস্যদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোটকে নিয়ে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্যপ্রণালী বিধি ২৭০-এর ৬ উপবিধি লঙ্ঘন করে সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্যরা অসংসদীয় আচরণ ও ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন আলোচনা পর্বে সদস্যরা অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারে মোট সময়ের ১৫ শতাংশ ব্যয় করেন। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের নেতা এবং সদস্যরা সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করলেও স্পিকার অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আলোচনার সময় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম ও নবম সংসদে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করলেও দশম সংসদে এখনও এ ধরনের চর্চা দেখা যায়নি। এছাড়া অন্যান্য সংসদের তুলনায় বিরোধী দলের কম ওয়াকআউট করার মাধ্যমে সংসদীয় কার্যক্রমে তারা যে ইতিবাচকভাবে অবস্থান করছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে সংসদীয় কার্যক্রমে বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের অবস্থান বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অধিবেশনগুলোতে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে, কোরাম সঙ্কট আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কমেছে। বিরোধী দলের দ্বৈত অবস্থানে সংসদ ও সংসদের বাইরে উভয় জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। বাস্তব অবস্থা ও সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দায় বিবেচনায় নিয়ে বিরোধী দলকে এ ভূমিকা থেকে সরে আসার আহŸান জানান তিনি। সংসদ বেশি কার্যকর ও সংসদে জনগণের দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে বিরোধী দলের স্পষ্ট অবস্থান দরকার বলে মনে করে টিআইবি ট্রাস্টি  বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল। দেশে-বিদেশে স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহের বিস্তারিত সংসদে আলোচনা না হওয়াকে সংসদীয় কার্যক্রমের ব্যত্যয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কোরাম সংকটে অপচয় অব্যাহত
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনে মোট ৪৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে অপচয় হয়। এটা মোট ব্যয়িত সময়ের (৩৯৪ ঘণ্টা ২১ মিনিট) ১২ শতাংশ। সাতটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়। এতে বলা হয়েছে, সংসদ পরিচালনার ব্যয়ের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, সংসদ পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড়ে এক লাখ ৬২ হাজার ৪৩৪ টাকা খরচ হয়। এ হিসাবে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনে কোরাম সঙ্কটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৩৩ হাজার ২০৪ টাকা। প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কটের সময়ের অর্থমূল্য ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৫২ টাকা। অষ্টম, নবম ও দশম সংসদের মধ্যে তুলনাচিত্রে টিআইবি’র পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অধিবেশন প্রতি গড় কোরাম সঙ্কট ক্রমান্বয়ে কমেছে। অষ্টম সংসদের প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ৩৯ মিনিট, নবম সংসদে ৩৩ মিনিট, দশম সংসদে তা কমে ২৮ মিনিটে দাঁড়ায়। প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের মতো অধিবেশন প্রতি গড় কোরাম সংকটও ক্রমান্বয়ে কিছুটা কমেছে। অষ্টম সংসদের প্রতি অধিবেশনের গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ৩৩ মিনিট এবং নবম সংসদে ৩০ মিনিট, দশম সংসদে কমে ২৯ মিনিটে দাঁড়ায়। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী ৬০ জনের কম সংসদ সদস্য অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত থাকলে স্পিকারকে বৈঠক মুলতবি করতে হয়। তবে উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে কোনো সদস্যকে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। স্পিকার এরপর পাঁচ মিনিট ঘণ্টা বাজিয়ে কোরাম পূর্ণ করা বা বৈঠক মুলতবি করতে পারেন। টিআইবি ২০০১ সাল থেকে সংসদীয় কার্যক্রম নিয়ে অষ্টম সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এ প্রতিবেদনটি ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ ধারবাহিকের ১৩তম ও দশম সংসদের ওপর তৃতীয় প্রতিবেদন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ