Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ন্যূনতম সরকারি সহায়তা পায়নি অধিকাংশ জেলে

জাটকা আহরণ নিষিদ্ধের ৫ মাস পর

| প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মৎস্য বিভাগের চাহিদা ২ লাখ ৬৮ মে. টন বরাদ্দ মিলছে মাত্র ৩৮ হাজার ১৮৭ মে. টন
নাছিম উল আলম : নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা নিধন বন্ধে কাগজপত্রে অনেক ডামাডোলসহ নদ-নদীতে প্রায়শই অভিযান চললেও বেকার জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ তাদের খাদ্য সহায়তার বিষয়টি এবার খুবই হতাশাব্যঞ্জক। টানা আট মাস ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ থাকলেও জেলেদের মানবিক বিষয়গুলো খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
অথচ জাটকার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে পূর্বের ৯ ইঞ্চির স্থলে এখন ১০ ইঞ্চি করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়কাল পূর্বের ৩০ নভেম্বর থেকে ৩১ মে’র পরিবর্তে আরো দু’মাস বৃদ্ধি করে ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু জেলেদের জীবনমানের বিষয়টি প্রশাসন যন্ত্রের ওপরমহলে খুব একটা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। এমনকি জাটকা নিধন থেকে বিরতিকালীন সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও পুর্বাসনের কর্মসূচীগুলোতে গতবছর থেকে কোন বরাদ্দ নেই। উপরন্তু জাটকা আহরণ বন্ধের এ টানা ৮ মাস সময়কালের মধ্যে মৎস্য অধিদফতর থেকে ছয় মাসের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও তা মাত্র ৪ মাসের জন্য সীমিত করেছে সরকার। খাদ্য সহায়তায় উপকারভোগীর সংখ্যা এবং জেলাÑউপজেলার সংখ্যাও হ্রাস করা হয়েছে। এছাড়া জাটকা আহরণ বিরোধী অভিযানের নামে নির্বিচারে জেলদের জাল, মাছ ও নৌকা আটকেরও অভিযোগ উঠেছে। অনেক এলাকায় জাটকা আহরণের কথিত অভিযোগে আইন-শৃংখলা বাহিনীর চাঁদাবাজীর অভিযোগও উঠছে। ইতোমধ্যে সংঘবদ্ধ জেলেরা বরগুণায় পুলিশ-প্রশাসনসহ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধাওয়া করে বেশ কয়েকটি মোটর বাইক ভাংচুর করেছে। এ ঘটনায় কয়েক শ’ জেলের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলাও হয়েছে।
সার্বিক ঘটনায় জেলেদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভও বাড়ছে। ইতোমধ্যে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে মৎস্যজীবী ও জেলেরা বিক্ষোভ মিছিল করে জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারক লিপিও প্রদান করেছে। পুলিশসহ বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনী যে নদ-নদীতেই অভিযানে যাচ্ছে, সেখানে সরকারী সীমারেখা অতিক্রম করে নির্বিচারে সব ধরনের জাল আটকেরও অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের নির্ধারিত কয়েকটি অভয়াশ্রমে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় হাজার হাজার বেকার জেলে এখন অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর সাথে কাক্সিক্ষত খাদ্য সহায়তা না মেলায় জেলে পরিবারগুলোতে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। তবে নদ-নদীতে জেলেদের ওপর যে হারে আইন প্রয়োগ হচ্ছে জাটকা পরিবহন ও বিপণন বন্ধে প্রশাসন ততটা তৎপর নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ইলিশ পোনা-জাটকা পরিবহন ও বিপণন বন্ধ অনেকটাই সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী। জাটকা বিক্রী নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এর আহরণও বহুলাংশে হ্রাস করা সহজ বলে মনে করছেন মহলটি।
দেশের মৎস্য সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশের অবদান প্রায় ১২-১৩%। জিডিপি’তে এর অবদান ১%-এরও বেশী। মূলত আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় মা ইলিশ উপকূলীয় প্রজননস্থলে ডিম ছেড়ে সাগরে ফিরে যায়। অক্টোবরের শেষভাগ থেকে ডিম থেকে পোনা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে। আর তা ক্রমে জাটকায় রূপান্তরিত হয়ে মে-জুন মাস পর্যন্ত পরিপক্ব ইলিশে রূপ নেয়। আর একারণেই এবছর নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশেই ১০ ইঞ্চির নিচের ‘জাটকা’ আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সারা বিশ্বে ইলিশের উৎপাদন না বাড়লেও বিজ্ঞানভিত্তিক নানা কর্মসূচী প্রণয়নের ফলে আমাদের দেশে অন্য মাছের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর ৪% থেকে ৮% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সুপারিশের আলোকে এবারও পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর-জানুয়ারী মাসের সময়কালকে অভয় আশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা হয়। একইভাবে নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদীতেও ১ মার্চ থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রাখা হচ্ছে। শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় গত মার্চ থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ এলাকাটিকে দেশের ৫ম অভয় আশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে বছর কয়েক আগে।
এদিকে গত নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এবারের জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ের মধ্যে জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে দেশের ২৮টি জেলার ১১৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৫৭ হাজার পরিবারের মধ্যে মাসে ৮০ কেজি করে ২লাখ ৬৮ হাজার মে. টনের মত চাল বরাদ্দের আবেদন করেছিল মৎস্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়। কিন্তু খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় অনেক বিলম্ব করে মাত্র ৩৮ হাজার ১৮৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করেছে। যার মাধ্যমে দেশের ১৭টি জেলার ৮৫টি উপজেলার ২ লাখ ৩৮ হাজার পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে ৪ মাস খাদ্য সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
ফলে মৎস্য অধিদফতরের সুপারিশের ২৮টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলা এবং ১১৫টি উপজেলার ৩০টি উপজেলা এ কর্মসূচী থেকে বাদ পড়ছে। উপরন্তু ৬ মাসের স্থলে ৪ মাস খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে ৮০ কেজির স্থলে ৪০ কেজি করে। অথচ জাটকা আহরণ বন্ধ থাকছে টানা ৮ মাস। আর সীমিত সংখ্যক জেলে খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে মাত্র ৪ মাস।
এ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৯১ জেলের মধ্য ১ লাখ ২৯ হাজারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল প্রদান করা হবে। গত মাস থেকে এ কর্মসূচী শুরু হবার কথা থাকলেও এখনো সরেজমিনে অর্ধেক জেলেও কোন চাল পাননি। চালের বরাদ্দও ৩৬ হাজার ৪৭০ টন থেকে ২০ হাজার ৭৪৮ টনে হ্রাস করা হয়েছে। অথচ দেশে গত অর্থ বছরে যে ৩.৯৫ লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টনের মত দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে আহরিত হয়েছে। গত ৭টি অর্থ বছরে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন ১ লাখ ৬১ হাজার টন থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬০%।
মৎস্য অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান মতে, দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে পরিবার ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত। যার ৩২% সার্বক্ষণিক ও ৬৮% খÐকালীন বলে। এছাড়াও ইলিশ বিপণন পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত করণ, রপ্তানী, জাল ও নৌকা তৈরী এবং মেরামত কাজেও আরো ২০-২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
অপরদিকে দেশের ৬টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেরই প্রায় দেড় লাখ জেলে পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। যার ৬৫% সার্বক্ষণিকভাবে ইলিশ আহরণে জড়িত বলে মৎস্য অধিদফতরের এক জরিপে বলা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ