Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবৈধ দখলদার চক্র বেপরোয়া

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

| প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবৈধ দখলদার চক্র বেপরোয়া। গাড়ি ব্যবসায়ী ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। কথিত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও থেমে নেই এদের উৎপাত। বিমানবন্দরের সামনে ক্যানোপি এলাকা ও কনকোর্স হলের সামনের জায়গা এবং কার পার্কিং এলাকা ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার চালকদের দখলে রয়েছে। যাত্রী ও তাদের স্বজনদের জন্য নির্ধারিত পার্কিংয়ের জায়গায় দিনভর এসব যানবাহন দিয়ে দখল করে রাখলেও তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। অথচ যাত্রীদের গাড়ি রাখতে হলে প্রতি ঘণ্টায় টাকা গুনতে হয়। এ নিয়ে পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা লোকজনের সাথে প্রতিদিনই দেনদরবার হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, বিমানযাত্রীদের স্বজনদের গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। যাত্রীদের নিয়ে যেসব যানবাহন ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলো এক ঘণ্টার বেশি সময় রাখতে দেয়া হয় না। এক ঘণ্টার বেশি সময় রাখতে হলে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। তবে ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার পুরো এলাকায় সারাদিন দখল করে রাখলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ এসব গাড়ির ব্যবসায় জড়িত সিন্ডিকেটের সাথে গোপন লেনদেনের ও মাসোয়ারা পরিশোধের অলিখিত চুক্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দরে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ভুক্তভোগী রতন মিয়া জানান, দুবাই থেকে আসা তার ছোট ভাইকে নিতে গতকাল সকালে বিমানবন্দরে যান। প্রবেশের আগেই একজন ইজারাদার কর্মীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে কার পার্কিং রসিদ গ্রহণ করেন। ওই কর্মীর সহযোগিতায় কনকোর্স হলে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর দুইজন ইজারাদার কর্মী এসে আবারো টাকা চান। টাকা না দিলে বের করে দেয়ার হুমকি দেয় তারা। অবস্থা বেগতিক দেখে পরে বাধ্য হয়ে পুনরায় ৩৫০ টাকা দিতে হয়। তবে তারা কোনো রসিদ না দিয়েই চলে যায়। গাড়িসহ বের করে দেয়ার ভয়ে তিনি আরো কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি বলে জানান। মানিকগঞ্জ থেকে আসা কামরুল ইসলাম জানান, সৌদি প্রবাসী তার মামা আবদুল আহাদকে নিতে এসে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাকে। প্রবেশপথেই তাকে গাড়িসহ আটকিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে একজন ইজারাদার কর্মীর মাধ্যমে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করেন। কামরুল ইসলাম বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার পার্কিংয়ে যাত্রী হয়রানি বেড়েই চলেছে। দখলদার বাহিনী নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী আদায় করছে টাকা। কথিত ইজারাদার বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গাড়িপ্রতি ৫০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা এবং প্রবেশপথে অবৈধভাবে আদায় করছে ৩০০ টাকা। এ নিয়ে অভিযোগ করারও সুযোগ নেই যাত্রী ও তাদের স্বজনদের। দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রী ও তাদের স্বজনেরা প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ইজারাদার নামধারী ওই বাহিনীর কাছে মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ছেন। অথচ চোরাচালান সিন্ডিকেটের গাড়ি ও টাক্সিক্যাব দিনভর পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে বসে থাকে। তাদের কারণে সাধারণ মানুষের গাড়ি রাখার স্থান পাওয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহজালালে গাড়ি পার্কিং এলাকায় ইজারা প্রতিষ্ঠানের লাইনম্যানরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা চাহিদামতো বখশিস না পেলে গাড়ি পাঠিয়ে দেন পেছনের সারিতে। তাই বাধ্য হয়েই লাইনম্যানকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় সিএনজি, কার ও মাইক্রোচালকদের। গাড়িচালক আবুল মিয়া জানান, বাড়তি ১০০ টাকা দিয়ে তিনি পার্কিংস্থলের সামনে গাড়ি রাখার সুযোগ পেয়েছেন। টাকা দিলে সারাদিনই গাড়ি রাখা যায়। তবে তাকে এই টাকার রসিদ দেয়া হয়নি। সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রীদের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের গাড়ি পার্কিং করার পর ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে বের করে দেয়া হয়। তবে প্রতি ঘণ্টায় ৫০ টাকা করে আদায় করে থাকতে দেয়া হয়। অথচ দালাল ও চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের গাড়ি ও ভাড়ায়চালিত ট্যাক্সি ক্যাব সারা দিন পার্কিংয়ে থাকছে। মাইক্রোবাসের চালক মামুন জানান, কনকোর্স হল ইজারাদারের নামে প্রবেশপথেই ৩০০ টাকা আদায় করছে। তিনি বলেন, টাকা দিলেও তারা রসিদ দেয়নি। কনকোর্স হল ইজারাদার কর্মীরা তার কাছে অবৈধভাবে ৩০০ টাকার টিকিট দাবি করে। ফলে বাধ্য হয়েই ৩০০ টাকার টিকিট কেনেন মামুন। একই অভিযোগ করেছেন গাজীপুরের মাইক্রোবাস চালক শফিকুল, নরসিংদীর তোফাজ্জল এবং মানিকগঞ্জের কালাম। তবে মাঝে মধ্যে বিমানবন্দর ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে দালালদের জেল-জরিমানা করলেও তারা আবারও সক্রিয় হচ্ছে।
ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের জন্য ইজারা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতারণা করে টিকিট ছাপিয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা নিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইজারাদার সফিকুল ইসলাম বলেন, কার পার্কিংয়ে বেশি টাকা নেয়া হয় না। অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি কনকোর্স হল এলাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রেও বাড়তি টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। যাত্রীদের সাথে আসা লোকজন জানান, অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। কুয়েত প্রবাসী ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকার আবদুল্লাহপুরের বাসিন্দা কামাল হোসেন গতকাল জানান, তিনি ২ বছর পর ছুটিতে দেশে এসেছেন। তার স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনেরা একটি নোয়া মাইক্রোবাস নিয়ে আসেন তাকে নেয়ার জন্য। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা না দেয়াতে ইজারাদারের লোকেরা গাড়ি পার্কিং করতে দেয়নি। পরে সাড়ে ৪০০ টাকা দিয়ে ২ ঘণ্টার জন্য গাড়ি পার্কিং করতে হয়েছে। অপর এক যাত্রী জানান, তার ছোট ভাই রাসেল গাজীপুর থেকে একটি মাইক্রোবাস (হাইয়েস) নিয়ে গতকাল সকালে বিমানবন্দর আসেন। কনকোর্স এলাকায় গাড়ি নিয়ে প্রবেশের পর ৪শ’ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, টাকা দেয়ার পর অন্য এক ব্যক্তি ইজারাদারের কর্মী পরিচয় দিয়ে ৩০০ টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়াতে সেখান থেকে গাড়ি বের করে দেয়া হয়। পরে বহুতল পার্কিংয়ে ১০০ টাকা দিয়ে ৩০ মিনিট গাড়ি রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন এই বিমানবন্দরে ওঠানামা করে ৮০ থেকে ১২০টি ফ্লাইট। যাত্রীর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। যাত্রীদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানাতে আসেন ২০ থেকে ২৫ হাজার লোক। বছরে গড়ে ৫০ লাখ মানুষ এ বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করেন। তবে বখশিস ও লাগেজ চুরিসহ নানাভাবে যাত্রীদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সক্রিয় রয়েছে দালাল, পকেটমার ও প্রতারকচক্র। রয়েছে স্বর্ণ, মুদ্রা ও সিগারেট চোরাচালানি সিন্ডিকেট। সাধারণ যাত্রীদের গাড়ি পার্কিং বাবদ অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা নিলেও যাত্রীদের হয়রানি কমেনি। এদিকে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানার জন্য গত ১৫ দিনে একাধিকবার তার দফতরে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দর সূত্র জানায়, উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সফিকুল ইসলামের মালিকানাধীন সফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সকে বহির্গমন কনকোর্স হল এবং আসিফ অ্যান্ড ব্রাদার্সকে বহুতল কার পার্কিং ইজারা দেয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা কাস্টম হাউসের সামনে একটি রেস্টুরেন্টের ইজারাও পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সিভিল এভিয়েশনের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে গত ৫ বছর এককভাবে ইজারা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আগমনী কনকোর্স হলের ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহিদুর রহমান খানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানহা ট্রেডার্স। কনকোর্স হলে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ৩০০ টাকা দেয়ার নিয়ম থাকলেও ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের বেলায় টাকা দেয়ার নিয়ম নেই। অথচ ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের জন্য ইজারা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতারণা করে টিকিট ছাপিয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে বর্তমানে যাত্রী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তারপরও দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন উপায়ে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সউদী আরব থেকে দেশে আসা ছেলে তানহাকে আনতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন ঢাকা নবাবগঞ্জের শাহেনা আক্তার। তিনি গত বুধবার ভাড়া মাইক্রোবাস নিয়ে বিমানবন্দরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১ নম্বর ক্যানোপি পার্কিং এলাকায় যেতে চান। কিন্তু এর আগেই কনকোর্স হল ইজারাদার কর্মীরা তার কাছে অবৈধভাবে ৩০০ টাকার টিকিট দাবি করে। ফলে বাধ্য হয়েই তাকে ৩০০ টাকার টিকিট কিনতে হয়। এমনিভাবেই প্রতারণার শিকার হয়ে টিকিট কিনে ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশ করতে হচ্ছে বিমানযাত্রীদের স্বাগত জানাতে আসা স্বজনদের। অথচ যাত্রী কিংবা তাদের স্বজনদের হয়রানি ও প্রতারণার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ইজারাদার ওয়াহিদুর রহমান খান। তিনি বলেন, ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের জন্য টিকিটের মাধ্যমে বাড়তি টাকা নেয়ার ঘটনা তার জানা নেই। এছাড়া এখন যাত্রী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি দাবি করেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। চুক্তির বাইরে টাকা নেয়ারও কোনো সুযোগ নেই। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেন না।
বিভিন্ন কর্মকর্তার যোগসাজশে বহির্গমন কনকোর্স হলে প্রবেশের টিকিট ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ এবং বহুতল কার পার্কিং প্রবেশ ফি প্রথম তিন ঘণ্টার জন্য গাড়িপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা (নির্ধারিত সময়ের পর প্রতি ঘণ্টার জন্য ৪০ টাকা)। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় সময়ই নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট আসছে না। অথচ এ জন্য অতিরিক্ত পার্কিং ফি দিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবহন দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক যাত্রী এবং তাদের স্বজনরা অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ