Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো

| প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিবন্ধ
ইনকিলাব ডেস্ক : চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গতকাল (শুক্রবার) ভারতে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। দীর্ঘ সাত বছর পরে দ্বিপাক্ষিক এই সফরে তিস্তার মতো অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধানও প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। তবে অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর জেরে এ বিষয়ে এখনও প্রতিশ্রæতি দিতে পারেনি ভারত। প্রধানমন্ত্রীর এই ঐতিহাসিক সফর উপলক্ষে ভারতের গণমাধ্যমে তাঁর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দু’দেশের বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতাসহ বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, এই নীতি নিয়েই আমার পথ চলা। আমার রাজনৈতিক চেতনায় একটাই আকাক্সক্ষা, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্য এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই যেখানে মানুষ দারিদ্র্যে কষ্ট পাবে না, তার জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূর্ণ হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ মিলবে। জীবন হবে উন্নত মানের এবং সুন্দর।
জনকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গের শিক্ষা আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে রাজনীতি করেছেন। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করেছেন। বার বার কারাবরণ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, তবু নীতির প্রশ্নে অটল থেকেছেন। তার নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সেই স্বাধীনতার লক্ষ্য কাছে এনে দিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলির সমর্থন ও সহযোগিতা। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ভারতের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালির উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শুরু করে গণহত্যা। বাংলার মানুষ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দেয়। সেই প্রথম বাঙালি পাকিস্তানের শাসনভার হাতে নেওয়ার অধিকার অর্জন করে।
পূর্ববঙ্গের জনগণই পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবুও তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। বঞ্চিত, শোষিত বাঙালির মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জাতির পিতা তখন বাঙালিকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
পাক শাসক এবং তাদের বাংলাদেশী দোসররা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নি-সংযোগসহ নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ান। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেন। বিশ্বজনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা নেন। আমাদের দেশ শত্রæমুক্ত হয়। ভারতের জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমার মা, তিন ভাই, ভ্রাতৃবধূসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হারাই। আমার ছোট বোন রেহানা ও আমি বিদেশে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। সে সময়ও ভারত আমাদের পাশে দাঁড়ায়। ছয় বছর দেশে ফিরতে পারিনি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করে। জনসমর্থন নিয়ে আমি দেশে ফিরি। জনগণের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করি। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করি।
পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। তার ২১ বছর পর আমি জনগণের সেবা করার সুযোগ পাই। দুই দশকের সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করি। ভারতের আশ্রয়ে থাকা ৬২ হাজার শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনি। ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়।
যে কোনও একটা দেশের উন্নয়নের পক্ষে পাঁচ বছর সময় খুবই কম। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারিনি। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। যা যা অর্জিত হয়েছিল, ধ্বংস হতে বসে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুঃশাসন মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সংখ্যালঘুর ওপর নেমে আসে নির্যাতন। দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি থেমে যায়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অত্যাচারিত হন। দেশে জরুরি আইন বলবৎ হয়।
সাত বছর পর (২০০৮) নির্বাচন হলে আমরা জয়ী হই, সরকার গঠন করি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও ১০ বছর মেয়াদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করি। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করি।
বাংলাদেশে এখন প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার কমেছে ২২ শতাংশ। এই মুহূর্তে আর্থ-সামাজিক সূচকের অনেকগুলোতেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের থেকে এগিয়ে। কয়েক বছর আগেও কিন্তু আমাদের স্থান ছিল তলানিতে। তবে এই সমৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।
দারিদ্র্য এই গোটা অঞ্চলেরই প্রধান শত্রæ। ভারত ও বাংলাদেশে এখনও বহু মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। পুষ্টির অভাবে অনেক শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে না। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত। এই অবস্থা বদলাতেই হবে। আমাদের সামর্থ্য আছে, কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে, এটা বিশ্বায়নের যুগ। বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু করা খুব শক্ত। বরং একে অন্যকে সাহায্য করলে অনেক কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। এ জন্যই আমি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং উন্নত যোগাযোগকে গুরুত্ব দিই।
একমাত্র শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই শান্তি নিশ্চিত করে। দুই দেশের মধ্যে যা কিছু কথাবার্তা, শান্তিপূর্ণ ভাবেই তার সমাধান সম্ভব বলে মনে করি। স্থল-সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে আমাদের সদিচ্ছার দৃষ্টান্ত রেখেছি। দু’দেশে প্রবাহিত নদী (এখন আলোচ্য তিস্তা) ছাড়াও কিছু বিষয়ের সমাধান প্রয়োজন। আমি আশাবাদী মানুষ। ভারতের জনগণ ও নেতৃত্বের উপর আস্থা রাখতে চাই। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, তবু এই সীমিত সম্পদই আমরা দু’দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে পারি। আমরা একই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের অনেক কিছুই মেলে। লালন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ আমাদের উভয়েরই। বাংলা ভাষা আমাদের উভয়েরই। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর পানি পায় দু’দেশই। সুন্দরবন উভয়েরই গর্ব।
এ নিয়ে আমাদের কোনও দ্ব›দ্ব নেই। তবে একটি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে একমত হতে বাধা কোথায়? ‘বন্ধুতা হোক, বৈরিতা নয়,’ এই বৈদেশিক নীতি নিয়ে আমরা পথ চলছি। আমরা ক্ষমতায় আসার পর, ২০০৯ থেকে দুই দেশের সহযোগিতা বহু গুণ বেড়েছে। রেল, সড়ক ও নৌপথে যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মানবিক যোগাযোগ সবই বেশি হচ্ছে। দু’দেশের পক্ষেই তা মঙ্গলজনক। ব্যক্তি বা জাতীয়, উভয় পর্যায়েই সম্পর্ক নির্ভর করে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ওপর।
মেক্সিকোর নোবেলজয়ী কবি অক্টোভিয়ো পাজ ‘ইন লাইট অব ইন্ডিয়া’ বইতে লিখেছেন, ‘ফ্রেন্ডশিপ ইজ আ রিভার...’। তিনি বন্ধুত্বকে নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বও নদীর মতো বহমান ও উদার। উদ্দেশ্য মহৎ হলে, কল্যাণকর ফলও সম্ভব। আমার চার দিনের ভারত সফরের প্রাক্কালে সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। প্রত্যাশা রইল, এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহযোগিতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। দ্যা হিন্দু।



 

Show all comments
  • এস, আনোয়ার ৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:২৮ এএম says : 0
    বন্ধুত্ব হলো বহতা নদীর মতো - চির সত্য বটে, বন্ধুটি যদি হয় বন্ধুত্ব-বৎসল। তবে সেই বন্ধুত্ব এই দক্ষীণ এশিয়ায় (বিশেষ করে ভারতের সাথে) প্রযোজ্য নয়। কারন যে বন্ধু চির বহমান তিস্তা ও পদ্মার মতো নদীকে হত্যা করতে পারে, প্রয়োজনে বন্ধুত্বকে হত্যা করা তার জন্য কোন ব্যাপারই নয়। অতএব এমন বন্ধুকে বিশ্বাস করা মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।
    Total Reply(0) Reply
  • রফিক ৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১:১৯ পিএম says : 0
    সেই নদীর এক প্রান্তে যদি বাধ দেয়া হয় তাহলে কি সেই বন্ধুত টিকে ?
    Total Reply(0) Reply
  • Mustafa ৮ এপ্রিল, ২০১৭, ৯:১২ পিএম says : 0
    Friend cant make with killer of river and men
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ